ডা. ইকবাল মাহমুদ , এমডি (কার্ডিওলজি)
বাতজ্বর বা রিউম্যাটিক ফিভার শব্দটি আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত হলেও এটি নিয়ে সাধারনের মানুষের মাঝে রয়েছে দারুণ ভুল ধারনা।আবার এই বাতজ্বরকে কেন্দ্র করে গ্রামাঞ্চলে কোয়াকদের রয়েছে অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের হিড়িক। চেম্বারে প্রায় রোগী পাই যাদের ASO titre নামে একটা পরীক্ষার লেবেল বেশি দেখে তাদেরকে বাতজ্বরের রোগী হিসেবে সনাক্ত করে চিকিৎসা দেয়া হয়।রোগীরাও নিজেকে বাতজ্বরের রোগী মনে করে মানসিক দুশ্চিন্তায় ভোগেন।অথচ এর ASO titre বাতজ্বর ডায়াগনোসিসে তেমন কাজের কিছু না।
বাতজ্বর আসলে কি,কেন হয় ?
সাধারণত মনে করা হয় গিরায় গিরায় কিংবা হাড়ে হাড়ে ব্যথা হলে সেটা বাতজ্বরের লক্ষণ। যদিও এটা সবসময় সঠিক নয়। মানবদেহ একটি বিশেষ ব্যাকটেরিয়া (group A Streptococcus) দ্বারা আক্রান্ত হলে,এটি দিয়ে মানুষের গলায় ইনফেকশন (pharyngitis) হয়।তখন দেহ রোগ প্রতিরোধ করতে গিয়ে এই দুষ্ট ব্যাকটেরিয়ার বিপক্ষে এন্টিবডি তৈরি করে।এন্টিবডি হচ্ছে রোগের বিরুদ্ধে মানবদেহের তৈরি একটি শক্তিশালী অস্ত্র।
সমস্যা হলো streptococcus জীবানুর প্রোটিনের সঙ্গে হার্টভাল্ব ও গিরার ভিতরে থাকা পাতলা পর্দার প্রোটিনের প্রচুর মিল রয়েছে। ফলে জীবানুর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এন্টিবডি জীবানুর বিরুদ্ধে কাজ করার পাশাপাশি অনেকটা আত্মঘাতীভাবে নিজের শরীরের হার্টভাল্ব ও গিরার পর্দার প্রোটিনের বিরুদ্ধে কাজ করা শুরু করে। অনেকটা রাতের অন্ধকারে চোর মনে করে নিরীহ গ্রামবাসীকে পিটানোর মতো।নিজের এন্টিবডিই নিজের হার্ট ও গিরায় আক্রমণ করে,এগুলোর ক্ষতি শুরু করে।ফলে শুরু বাতজ্বরের নামের এক জটিল রোগ।
বাতজ্বর কাদের হয় ?
অস্বাস্থ্যকর ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে বসবাসরত শিশুরা এই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত হয়ে থাকে।সাধারণত ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী বাচ্চাদের বাতজ্বর হয়ে থাকে। তবে এর পরেও হতে পারে। আমাদের দেশে এক লাখ শিশুর মধ্যে ১০০ জন বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়। উন্নত দেশগুলোতে বাতজ্বরের প্রকোপ অনেক কম।অর্থনৈতিক উন্নতি আর চিকিৎসা পদ্ধতির আধুনিকতার সাথে সাথে আমাদের দেশেও এই রোগের হার ক্রমশ কমছে। বাতজ্বরের লক্ষণ কি ?
বাতজ্বরের প্রথম ধাক্কাটা শুরু হয় গলা ব্যথা দিয়ে।প্রথমে কিছুদিন গলা ব্যথা, হালকা কাশি, জ্বর। তারপর ২ থেকে ৩ সপ্তাহ বিরতি।এরপর শুরু হয় গিরায় গিরায় ব্যথা। প্রথমে একটি বড় গিরা (হাঁটু,কনুই,কব্জি,গোড়ালির গিরা ইত্যাদি ) ব্যথা হয়ে ফুলে যাওয়া, কয়েক দিনের মধ্যে সেটি ভালো হয়ে আরেকটি বড় গিরা আক্রমণ করে।সাথে শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, জ্বর, খাদ্যে অরুচি, প্রচণ্ড দুর্বলতা ইত্যাদি থাকতে পারে।
চিকিৎসকরা কিভাবে বাতজ্বর ডায়াগনোসিস করে থাকেন ?
এই অংশটা লিখার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাতজ্বর সম্পর্কে ভুল ধারণার অবসান করা,সঠিক চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণা দেয়া। বাতজ্বর নির্ণয় মূলত রোগের ইতিহাস ও লক্ষণনির্ভর। অর্থাৎ ল্যাব টেস্ট এখানে মূল ভূমিকা পালন করে না। যে কারণে এই রোগটি অনেক সময় মিস হয়ে যায়। এসব বিবেচনায় এনে বাতজ্বর সঠিকভাবে নির্ণয় করবার জন্য major পাঁচটি এবং minor পাঁচটি ক্রাইটেরিয়া বা বৈশিষ্ট্য ঠিক করা হয়েছে। এগুলোকে Jones criteria বলা হয়।
Major_criteria :
১। গিরা প্রদাহ বা migrating polyarthritis:প্রথমে একটি বড় গিরা (হাঁটু,কনুই,কব্জি,গোড়ালির গিরা) ব্যথা হয়ে ফুলে যাওয়া, কয়েক দিনের মধ্যে সেটি ভালো হয়ে আরেকটি বড় গিরা আক্রমণ২। হৃদপিণ্ডের প্রদাহ…বুকে ব্যথা,শ্বাসকষ্ট,বুক ধড়ফড়,অনেকক্ষেত্রে হার্ট ফেইল হয়ে পায়ে পানি আসতে পারে।৩। সিডেনহাম কোরিয়া…হাত পায়ে অনিচ্ছাকৃত এক ধরনের বা নৃত্যভঙ্গির মতো কাঁপুনি।৪। চামড়ায় নিচে ছোট ব্যথাযুক্ত গোটা বা subcutaneous nodules ৫। বুকে ও পিঠের চামড়ায় ছোপ ছোপ রক্তের ছাপের লালবর্ণের চাকা বা Erythema marginatum
Minor_criteria:
১। এক বা একাধিক গিরা ব্যথা ( ফুলবে না)২। হালকা জ্বর ৩। ECG তে সমস্যা (Prolong PR)৪। রক্তে ESR বাড়া ৫। CRP বাড়া এছাড়া পূর্ববর্তী ইনফেকশন এর প্রমাণ হিসেবে ১। culture positive of group A streptococcus ২। high ASO টাইটার।
রোগ_নির্ণয়:
উপরের লক্ষণগুলোর দুইটি মেজর লক্ষনঅথবা একটি মেজর লক্ষণ+দুইটি মাইনর লক্ষণ এবং পূর্ববর্তী ইনফেকশন এর প্রমাণ থাকলেই কেবল বাতজ্বর বলা যাবে। তাহলে শুধু ASO টাইটার কত কম গুরুত্ববহন করে।বাতজ্বর ডায়াগনোসিস এ ASO titre হলো নানী শ্বাশুড়ীর খালাতো বোনের ননদের মত।এতই কম গুরুত্বপূর্ণ।অন্যান্য লক্ষণ না থাকলে এর বৃদ্ধিতে কিছু আসে-যায় না।
বাতজ্বর ছাড়াও ASO টাইটার বাড়তে পারে।Streptococcus ব্যাকটেরিয়া দিয়ে গলায় infection হলে ASO titre বেড়ে যাবে।বাংলাদেশে এমন মানুষ পাওয়া যাবে না,যার জীবনে একবারো এই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে গলা ব্যথা হয় নি। তাই ASO টাইটার বেশি পেলেই আতঙ্কিত হবেন না। বাতজ্বর আছে কি না, তা নিশ্চিত হয়ে তবেই চিকিৎসা শুরু করুন।
কেননা, এ রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি।বাতজ্বর হলে কী ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে? বাতজ্বরের ফলে কখনো কখনো দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা দেখা দিতে পারে যেমন:বাতজ্বরের ফলে বাতজনিত হৃদরোগ হয়, যা থেকে হৃৎপিণ্ডের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। হৃৎপিণ্ডের ভালভের সমস্যা দেখা দেয়। বিভিন্ন জোড়া বা জয়েন্টে ব্যথা থাকে।তবে মনে রাখতে হবে বাতজ্বর আর বাতরোগ এক জিনিস নয়।
চিকিৎসা কি?
বাতজ্বর সন্দেহ হলে একজন রেজিস্টার্ড (এমবিবিএস) চিকিৎসকের শরনাপন্ন হয়ে রোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে।চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত বিভিন্ন ওষুধ খেতে হবে।
প্রাথমিক প্রতিকার :
১। বাতজ্বর রোগ নির্ণয় হবার সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে পর্যাপ্ত শারীরিক বিশ্রাম নিতে হবে। বিশ্রাম হার্টের উপর কাজের চাপ কমায়। ফলে হার্ট দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে।
২। Inj Benzyl penicillin 1.2 million units deep IM stat or Tab Penoxymethyl penicillin 250 mg 6 hourly for 10 days দিতে হবে।
৩। সাপোর্টিভ চিকিৎসা: গিরার তীব্র প্রদাহে এ্যাসপিরিন, হৃদপিণ্ডে প্রদাহে স্টেরয়েড, হার্ট ফেইল্যুর-এ ডাইয়্যুরেটিকস ইত্যাদি ঔষুধ ব্যবহার করা হয়।
পরবর্তী প্রতিরোধঃ
বাতজ্বর একটি পুনঃপুন আক্রমণের রোগ। যতবার এটি হবে তত হার্টের বিশেষ করে ভাল্বের ক্ষতিসাধন করবে। তাই এটি যাতে বারবার না হতে পারে সেজন্য তিন সপ্তাহ পরপর inj Benzathine penicillin বা Tab Penvik/ Oracyn K 250 mg দিন দুইবার নিয়মিত দিতে হবে। এছাড়াও হার্ট আক্রান্ত হলে বছরে একবার কালার ডপলার ইকোকার্ডিওগ্রাম করে হার্টের কনডিশন চেক করতে হবে। ভাল্বের ক্ষতি তীব্রমাত্রায় পৌঁছালে অপারেশন বা বেলুন চিকিৎসা করতে হবে।যেগুলো আমাদের দেশে খুব ভালোভাবেই হচ্ছে।
চিকিৎসা কতদিন চলবে?
উপসর্গ ভালো হয়ে গেলে বাতজ্বরের চিকিৎসা বন্ধ করা যাবে না।যদি হার্টের ভাল্বের ক্ষতি না ও হয়ে থাকে তাহলে ২৫ বৎসর বয়স পর্যন্ত অথবা শেষ ইনফেকশন থেকে কমপক্ষে ৫ বছর পর্যন্ত এন্টিবায়োটিক দিতে হবে। কিন্তু যদি ইতিমধ্যে ভাল্বের ক্ষতি হয়ে থাকে তাহলে এই ওষুধগুলো শেষ অ্যাটাক থেকে ১০ বছর বা ৪০ বৎসর বয়স পর্যন্ত দিতে হবে।মনে রাখবেন, এই ওষুধ গ্রহণ বাতজ্বরের আগের আক্রমণের জন্য নয়। এটি ভবিষ্যতে বাতজ্বর না হওয়ার জন্য কাজ করে।
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে বাতজ্বর এখনো একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে আছে। প্রাথমিক অবস্থায় এর ক্ষতিকর প্রভাব তেমন ব্যাপক না হলেও পরবর্তীকালে যদি হার্টের ভাল্ব আক্রান্ত হয়। বাতজ্বর একবার হলে বারবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই বাতজ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতে ওষুধ ব্যবহার করতে হবে, যাতে পুনরায় বাতজ্বর না হয়। শুরুতেই যদি রোগটি প্রতিরোধ/প্রতিকার করা যায় তাহলে দূরবর্তী জটিলতা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
বাতজ্বর কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়ঃ
এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ।অস্বাস্থ্যকর ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ বা বস্তি এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যেই এই রোগ বেশি হয়ে থাকে। তাই এমন পরিবেশ এড়িয়ে চলা উচিত। ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা যেমন খাবার পরে দাঁত-মুখ ভালো করে পরিষ্কার করা।গলায় সংক্রমণ বা গলাব্যথা হলে অবহেলা না করে তাৎক্ষণিক সঠিক চিকিৎসা করলে বাতজ্বর হওয়ার সম্ভাবনা কম হয় বা একেবারেই থাকে না। বাতজ্বর সম্পর্কে সঠিক ধারণাই পারে বাতজ্বর রুখে দিতে।আসুন সচেতন হই।
লেখক: ক্লিনিক্যাল ও ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিষ্ট , পাকর্ভিউ হাসপাতাল
Discussion about this post