হার্টবিট ডেস্ক
জনগণের কল্যাণে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুনর্গঠন জরুরি বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে অবকাঠামো গড়ে উঠেছে তা প্রশংসনীয় হলেও কিছু সমস্যার কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ফলাফল মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না।
রোববার বিকেলে রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পথরেখা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।
তারা বলেন, দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সুদূর প্রসারী রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশের সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সুনিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধুর মৌলিক চিন্তা ছিল দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের গ্রামীণ জনগণের জন্য মানসম্মত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেছিলেন জাতির এই মহান নেতা।
বক্তারা আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার রূপরেখা অনুসরণ করেই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সূচনা হয়। সে চিন্তাধারাকে পরবর্তী সময়ে ধারণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে উন্নয়ন হয়েছে তা একটি মাইলফলক।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপ-কমিটির সভাপতি, জাতীয় সংসদের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সদস্য অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক। তিনি বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রয়েছে। উপজেলা হাসপাতালের বেশিরভাগ পদগুলো খালি থাকে। স্থানীয়ভাবে শূন্য পদগুলোতে সঙ্গে সঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব, অনেক দেশেই এ ব্যবস্থা আছে। আমাদের জন্য কোন ব্যবস্থাটি সঠিক তা নির্ধারণ করতে হবে।
রুহুল হক বলেন, হাসপাতালের ভর্তি রোগীরা প্রায় সব ওষুধ বিনা পয়সায় পেয়ে থাকেন, কিন্তু বহিঃবিভাগে রোগীদের জন্য ওষুধ বরাদ্দ খুবই কম। এ বিষয়ে পরিবর্তন আনতে হবে। এছাড়া নানাবিধ অসুবিধার কারণে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে অনেক বেশি ভিড় থাকায় রোগীদের মানসম্মত চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, উপজেলা হাসপাতালে রোগীরা ডাক্তার পায় না, ঠিকমত ওষুধ পায় না, ফলে তারা জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভিড় করে। যে কারণে এসব হাসপাতালে একসঙ্গে অনেক রোগী থাকায় আমরা মানসম্মত চিকিৎসা সেবা দিতে পারছি না। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করতে পারলে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ রোগীর মানসম্মত চিকিৎসা জেলা/উপজেলা হাসপাতালে দেওয়া সম্ভব। এজন্য উপজেলা, ইউনিয়ন ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে রোগীর সেবার মানের মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে।
সাবেক এ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক সু-ব্যবস্থাপনা দ্বারা দেশ এগিয়ে গেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেড়েছে, কৃষিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন, শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবহার অনেক উন্নতি সাধিত হলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের স্বাস্থ্য সেবা সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। তাই স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়ে জনগণের অভিযোগ থেকেই যাচ্ছে।
এ সময় তিনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুনর্গঠনে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেন। সেগুলো হলো-
১. স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় পদ সৃষ্টি করা হলেও সে অনুযায়ী জনবল নেই, অব্যবস্থাপনা শুরু হয়েছে এখানেই। জনবলের নিয়োগের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল সঠিক সময়ে নিয়োগ দেওয়া হয় না। জনবল (ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকস, ল্যাব টেকনিশিয়ান) নিয়োগের ব্যবস্থাপনা বিকেন্দ্রীকরণ না করলে এ অব্যবস্থাপনার সমাধান হবে না। বিকেন্দ্রীকরণের ধাপ নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করে নির্ধারণ করতে হবে।
২. চিকিৎসা শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নবীন চিকিৎসকদের ক্যারিয়ার তৈরি করার জন্য চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থাকে চার ভাগে বিন্যাস করতে হবে। যেমন- ক্লিনিসিয়ান, শিক্ষক, প্রশাসন ও রোগ প্রতিরোধক। এই চার ভাগের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকে একজন নবীন চিকিৎসক ভবিষ্যৎ কার্যপরিধি নির্ধারণ করবেন এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অংশ নেবেন।
৩. রোগীদের উপজেলা ও জেলাভিত্তিক ইনডোর স্বাস্থ্যসেবা দিতে ডিজিটাল রেফারেল সিস্টেম চালু করতে হবে এবং অপেক্ষাকৃত জটিল রোগের জন্য উপজেলা থেকেই জেলা, বিভাগীয় ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে রেফারেল সিস্টেমের মাধ্যমে রোগী পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয় ব্যবস্থাপনা ও মেরামতের জন্য রোগীর সেবা ব্যাহত হয়। এ ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হলে মেরামতের ব্যবস্থার জন্য অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান ও ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে বিকেন্দ্রীকরণ করে দ্রুত সময়ে সব যন্ত্রপাতি মেরামত করতে হবে এবং এ ব্যবস্থাকে মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। এ জন্য বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে।
৫. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা হাসপাতালের পরিবেশ উন্নতির জন্য অপরিহার্য। রোগী ও রোগীদের সঙ্গে থাকা স্বজনের কথা চিন্তা করে সে অনুযায়ী টয়লেট ও পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োগ ও তদারকির জন্য জনবল জরুরি।
৬. হাসপাতালের সেবা সম্পর্কে তথ্য প্রদানের এবং তত্ত্বাবধায়নের জন্য মানবিক জ্ঞানসম্পন্ন জনবল নিয়োগ দিতে হবে। তারা রোগীদের সঙ্গে ‘পাবলিক রিলেশন’ রক্ষায় ভূমিকা পালন করবে।
সবশেষে রুহুল হক আরও বলেন, দেশের জনগণের জন্য সর্বজনীন চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করণের জন্য এবং একই সঙ্গে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার চিহ্নিত ত্রুটিসমূহ বিজ্ঞানসম্মত ও আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। এ লক্ষ্য পূরণে যথাযথ পর্যালোচনার মাধ্যমে আমাদের দেশের জনগণের উপযোগী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্য একটি কমিটি গঠন করে সবার অংশগ্রহণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়া জরুরি।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অনেক এগিয়েছে। আমরা বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছি করোনা মোকাবিলায় ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে। কিন্তু অগ্রগতিতে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারছি কি না সেটিও আমাদের দেখতে হবে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ পুরোপুরি খরচ করা যায় না। মানুষের এত সমস্যা থাকার পরও কেন বরাদ্দ খরচ করা যায় না, এটাও আমাদের দেখতে হবে। বাস্তবতা হলো, আমরা কিছু অসঙ্গতির কারণে এগোতে পারছি না। সরকারি যেকোনো খাতেই যাদের টাকা আছে, তারা ভালো কিছু করতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে টাকাও খরচ হচ্ছে না, অব্যবস্থাপনাও দূর হচ্ছে না।
কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতেই আসরা সফল হতে পারছি না। আমাদের কাছে খবর আসে চিকিৎসক থাকে না, চিকিৎসক থাকলে ওষুধ থাকে না। নজরদারির অভাব রয়েছে। জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। এ বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে।
সবশেষে তিনি আরও বলেন, আজকের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে সংকটগুলো উঠে এসেছে, সেগুলোতে সরকার যদি নজর দেয়, তাহলে স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। একইসঙ্গে কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সব স্বাস্থ্য সেবা সংশ্লিষ্ট কর্মসূচিগুলোতে সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যেসব সমস্যা আছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমি সেগুলো নিয়ে কথা বলেছি। সমস্যাগুলো দ্রুততম সময়ে সমাধান করতে না পারলে সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে না।
তিনি বলেন, আমি যেখানেই যাই রোগীর পক্ষে একটু বেশি কথা বলি। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের সেবায় রোগী হয়তো শতভাগ সন্তুষ্ট হবে না, কিন্তু তাদেরকে শতভাগ সেবা দিয়ে যেতে হবে। রোগীর সন্তুষ্টি ছাড়া ভালো চিকিৎসক হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় না।
এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, দেশের বাইরে যারা চিকিৎসা সেবা নিতে যায়, তারা যে চিকিৎসাই পাক, তারা মেন্টালি সন্তুষ্ট হয়। যদিও অনেক অনেক টাকা তাদের খরচ করতে হয়। এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালগুলোতে যারা চিকিৎসা সেবা দেয়, তাদের অধিকাংশই জুনিয়র চিকিৎসক। তাই তাদের দিকে নজরটা একটু বেশি দেওয়া উচিত। একজন চিকিৎসককে এমবিবিএস শেষ করে বিসিএস পাস করতে গেলেই দশ বছর লেগে যায়। অন্যদিকে যারা সাধারণ পড়াশোনা করে বিসিএস করছে, তাদের কিন্তু পাঁচ থেকে ছয় বছরেই হয়ে যায়। কিন্তু ডাক্তারদের আবার এফসিপিএসসহ নানা উচ্চশিক্ষায় পড়াশোনা করতে হয়। অর্ধেক সময় চলে যায় পড়াশোনাতেই। দীর্ঘ সময় পড়াশোনা করে, এত ডিগ্রি নিয়েও তারা অন্যদের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা কম পায়। চাকরিতে তাদের পদোন্নতিও কম হয়। এতে করে করে চিকিৎসকদেরও মানসিক সন্তুষ্টি আসে না, ফলে রোগীর চিকিৎসাও ভালো করে তারা দিতে পারে না। তাই এটিকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।
কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলায় সরকারের চিকিৎসা সেবা আছে। কিন্তু এর মাঝে ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো ধরনের স্বাস্থ্য সেবা নেই। এদিকে আমাদের নজর দেওয়া উচিত। তাহলে উপজেলা হাসপাতালে রোগীর চাপ অনেকাংশেই কমে আসবে। সেক্ষেত্রে ইউনিয়ন পর্যায়ে আলাদা একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বলতে আমরা শুধু চিকিৎসককেই বুঝি। কিন্তু রোগীরাও এ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া অর্থনৈতিক বিষয়, সরঞ্জাম ও জনবলও গুরুত্বপূর্ণ। সবমিলিয়েই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। শুধু চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করলেই হবে না। এমনকি সকল দায়ও তাদের ওপর চাপালে হবে না। মুখের ওপর আমরা অনেক সময়ই বলে ফেলি, একজন চিকিৎসক কীভাবে ৫০/৬০ জন রোগী দেখে! আমাদেরও দেখতে হবে দেশে জনসংখ্যা ও রোগীর সংখ্যা।
বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসক আরও বলেন, একজন শিক্ষকের দায়িত্ব শিক্ষা দেওয়া। একজন শিক্ষক পরবর্তী কতজন শিক্ষক তৈরি করলো, তা দেখা হয় না।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী, জাতীয় সংসদের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সদস্য ও কিশোরগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ডা. জাকিয়া নূর লিপি, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত মুন্না, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এএইচএম এনায়েত হোসেনসহ আরও অনেকে।
সৌজন্যে- ঢাকা পোস্ট
Discussion about this post