রীতা ভৌমিক
ডা. ফওজিয়া মোসলেম। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। একাত্তরে ঢাকায় প্রশিক্ষণের জন্য নারীদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক পর্বে অংশগ্রহণ করেন। একাত্তরের মে মাসে ভারতে যান। সেখানে সিপিবি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা গ্রুপে চিকিৎসক হিসাবে যোগদান করেন।
ডা. ফওজিয়া মোসলেম একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন। তখন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে কর্মরত। একাত্তরের ১ মার্চ হাসপাতালের কাজ শেষ করে দুপুর ১টার দিকে গোপীবাগের বাসায় ফিরছিলেন। গুলিস্তানের কাছাকাছি এসে দেখেন লাঠি হাতে অসংখ্য লোক সমবেত হয়ে ‘বীর বাঙালি লাঠি ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছেন। বাসায় ঢুকে রেডিওর দিকে এগোতেই তার শ্বশুর মো. সিদ্দিক আহমেদ বলে উঠলেন ‘খবর আর কি শুনবে। জাতীয় পরিষদ বাতিল। দেশে আবার আগুন জ্বলে উঠবে।’ মহিলা পরিষদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে ৫ মার্চ প্রতিবাদ মিছিলের সিদ্ধান্ত নেন। ‘গণরায় বাতিল করা চলবে না’ দাবিতে নারীদের বিরাট মিছিল বের হলো ঢাকা শহরে। তিনি ছিলেন সন্তান সম্ভবা। এরপরও তিনি মিছিলে অংশ নেন।
এ প্রসঙ্গে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ওই দিন মিছিলের পর আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক ও নেতা মো. ফরহাদ আমাকে বললেন, ‘আপনি মিটিং মিছিলে যাবেন না। পাকিস্তানিরা গুরখা সৈন্য নামিয়েছে, যখন তখন যা কিছু হয়ে যেতে পারে। এদিকে মহিলা গণসংগ্রাম গঠিত হয়েছে। তাদের প্রশিক্ষণ চলছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ মৎস্য ভবনের কোনায় দাঁড়িয়ে শুনলাম। ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম/ যার যা হাতে আছে তা নিয়ে যুদ্ধ কর’ সেগুনবাগিচার পুরো এলাকা, প্রেস ক্লাব ছাড়িয়ে শোনা যায়। অনেক উদ্দীপ্ত হয়ে উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে বাসায় ফিরলাম। পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে, নানা খবর ভেসে আসছে। আমি সরাসরি কোনো কিছুতে যুক্ত হতে পারছি না। খুব একাকিত্ব অনুভব করছি। আমার স্বামী সাইফউদ্দীন আহমেদ মানিক তখন শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ২২ মার্চ সবাইকে ডেকে বললেন, ‘পরিস্থিতি সংকটজনক। ঢাকা শহরে সংঘাত হতে পারে। বাসায় ছোট যারা তারা মেয়েদের সঙ্গে গ্রামের বাড়ি চলে যাক।’ ২৩ মার্চ আমাকে আমার মায়ের কাছে গুলবাগে রেখে এলেন। আমার মায়ের বাড়িতে আমার ছোট বোন-ভাই তারাও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। ওদের কাছে খবরাখবর পেতে থাকলাম। হঠাৎ ২৫ মার্চ রাত দশটার দিকে আমার স্বামী গুলবাগের বাসায় এলেন, জানালেন পরিস্থিতি ভালো না। বেশ রাত পর্যন্ত রাস্তায় লোকজনের চলাচল শুনতে পেলাম। রাত ১২টার দিকে শুরু হলো কামানের আওয়াজ গোলাগুলি ও মানুষের আর্তচিৎকারের শব্দ। গুলবাগ এলাকার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মান্নান সাহেব অন্যদের দিয়ে খবর পাঠালেন আমরা যেন তার দালান বাড়িতে আশ্রয় নিই কারণ এলাকার প্রায় সব বাড়ি টিনের। তার কথামতো গলির সব বাড়ির মেয়েরা এবং শিশুরা তার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত রাত পার করলাম। পরদিন ২৬ মার্চ ভোর বেলায় বাসায় ফিরলাম। ভয়ার্ত নিস্তব্ধ ঢাকা শহর। তখনো গুলির শব্দ আসছে, আকাশে চিল উড়ছে, কাক ডেকে চলছে। হঠাৎ করে লোকজনের দৌড়ে পালানোর শব্দ শুনছি। কিছু ক্ষণ পরে বুঝলাম গুলবাগের কাছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন সেখান থেকে হয়তো জীবিতরা প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে। বাসায় এসে রেডিও ধরার চেষ্টা করি। পরদিন ২৭ মার্চ কয়েকঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলো। ঢাকা শহরের লোকজন পড়িমড়ি করে শহর ত্যাগ করতে শুরু করল। আমার স্বামী বের হয়ে গেলেন। কিছ–ক্ষণ পর ফিরলেন একটা গাড়ি সঙ্গে নিয়ে। আমাকে বললেন, হাসপাতালে চলে যেতে। আমার ছোট ভাইবোনেরা পাশের বাসার প্রতিবেশীদের সঙ্গে কেরানীগঞ্জ চলে গেল গ্রামের বাড়ি। মা আর আমাকে নিয়ে আমার স্বামী গাড়ি করে রওনা হলেন অধ্যাপক সৈয়দা ফিরোজা বেগমের ক্লিনিকে। ক্লিনিকের গেটে নামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি আসছি। তুমি এখানে ভর্তি হয়ে যাও।’ আমি ক্লিনিকের নার্সের সহায়তা নিয়ে ফিরোজা আপার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। আপা নিচে নেমে এসে সিস্টারকে পরামর্শ দিয়ে আমাকে একটা কেবিনে রাখতে বললেন। দুই দিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে বললেন, ‘ঢাকা শহরে বাড়িঘর পোড়ানো হচ্ছে, বোম্বিং হচ্ছে, ক্লিনিকও নিরাপদ নয়। তুমি হাসপাতালে চলে যাও। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি হলাম ফিরোজা আপার অধীনেই। ১ এপ্রিল সকালে ফিরোজা আপা রাউন্ডে এসে বললেন, ‘ফওজিয়াকে লেবার ট্রায়ালে দাও। বাচ্চার ডেলিভারি হয়ে যাওয়া দরকার।’ অন্যদিকে ওইদিন সকাল থেকে মিটফোর্ড হাসপাতালের সব ছাদ আর্মির দখলে। তারা কেরানীগঞ্জ তাক করে গুলি, বোমা ছুড়ছে। ওদের কাছে খবর আছে ছাত্রনেতারা এ রাস্তা দিয়ে ঢাকা শহর ত্যাগ করছে। হাসপাতালের কর্মচারীরাও প্রাণভয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করছেন। এ পরিস্থিতির মধ্যে ২ এপ্রিল ভোরে যুদ্ধরত বাংলাদেশে আমার কন্যা এলো। ৫ এপ্রিল সকালে হাসপাতাল থেকে বাচ্চা ও মাকে নিয়ে রিকশায় গুলবাগের জন্য রওনা দিই। হঠাৎ আমার ছোট মামির সঙ্গে দেখা। উনি জানালেন, ওনার ছেলেমেয়েরাও কেরানীগঞ্জে। উনি কাল সকালে যাচ্ছেন সবার খোঁজখবর নিতে। মামির সঙ্গে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় যাই। এখানে আমার স্বামীর কাছ থেকে খবর এলো তারা আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধে ব্যস্ত। আমাদের নেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। আমি যেন চলে আসি। পরিবারের মধ্যে আমার থাকাটাও সবার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। দুজন সহকর্মীর সঙ্গে ৫ মে সকালে একজন কুরিয়ারের সঙ্গে রওনা হলাম। নানা ঝঞ্ঝাটের মধ্য দিয়ে ৬ এপ্রিল সন্ধ্যাবেলায় আগরতলায় পৌঁছলাম। সেখানে উঠলাম ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত ত্রাণ শিবিরে। ২৭ মার্চের পর এই প্রথম দেখা হলো আমার মেয়ের বাবার সঙ্গে। যোগ দিলাম মুক্তিযুদ্ধে, সঙ্গে এক মাসের নবজাতক মেয়ে। ক্যাম্পের অন্যদের কাছে মেয়েকে জিম্মায় রেখে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি।
ডা. ফওজিয়া মোসলেম আগরতলা পৌঁছেই চিকিৎসক হিসাবে দায়িত্ব পেলেন। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী, পংকজ ভট্টাচার্য ও মতিয়া চৌধুরী। এ ক্যাম্পে যারা থাকতেন তাদের দেখাশোনা এবং ক্যাম্পে যে নিয়মিত শরণার্থী আসতেন প্রয়োজনে তাদের চিকিৎসা করা দিয়ে তার কাজ শুরু হয়।
ডা. ফওজিয়া মোসলেমের মতে, তখনো বেস হাসপাতাল বা যুদ্ধাহতদের জন্য কোনো হাসপাতাল চালু করা সম্ভব হয় নাই। তাই বিভিন্ন হাসপাতালে যারা যুদ্ধাহত হয়ে ভর্তি হয়েছেন তাদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য আমাদের আশ্রয় শিবিরের মেয়েদের হাসপাতালে পাঠানো হলো। যাতে আমাদের সাহায্য সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি পায়। এরপর আমাকে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয় রিক্রুটমেন্টের জন্য মেডিকেল চেকআপের। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ১টা এবং বিকাল ৪টা থেকে ৬টা আমি মেডিকেল চেকআপ করাই। এ কাজ এবং ক্যাম্পের আশ্রয় গ্রহণকারীদের জন্য কিছু ওষুধ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত হলো। ওষুধ সংগ্রহের জন্য বড় হাসপাতাল ও ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্যোগ নিই। এ কাজে আমাকে সাহায্য করেন ডা. সারোয়ার আলী। আমরা দুজনে মিলে বিভিন্ন জায়গা থেকে কিছু ওষুধ সংগ্রহ করি এবং প্রয়োজনীয় ওষুধের একটা নিয়মিত মজুত করা হয়। যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে সংগঠিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সম্পাদিকা মালেকা বেগম ইতোমধ্যে দিল্লিতে নিখিল ভারত মহিলা ফেডারেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে নারী সমাজের সমর্থনের আহ্বান জানান। তিনি আগরতলায় বিভিন্ন এলাকায় নারীদের নিয়ে সভা করেন। এভাবে চিকিৎসক হিসাবে চিকিৎসা প্রদান এবং একজন সংগঠক হিসাবে যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি ও প্রয়োজনীয় সাহায্য সামগ্রী ও ওষুধ সংগ্রহের কাজ করি। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং নিয়ে দেশে প্রবেশ করে যুদ্ধে যারা শহিদ হয়েছেন তাদের মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছি। আবার জয়ের সংবাদে আশায় বুক বেঁধেছি। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় পেলাম।
Discussion about this post