ডা. সেলিনা সুলতানা
প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩-৬ শতাংশ শিশু একটি গুরুতর জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। আর জন্মগত ত্রুটি শিশুর আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ধর্ম, জাতি ও সামাজিক মর্যাদাকে প্রভাবিত করতে পারে।
জন্মগত ত্রুটি সাধারণত জন্মের সময় উপস্থিত গঠনগত পরিবর্তন। যা শরীরের যে কোনো অংশ বা অংশকে প্রভাবিত করতে পারে যেমন- হৃদয়, মস্তিষ্ক, পা, ঠোঁট কাটা ইত্যাদি। এটি শারীরিক গঠন, কার্যক্ষমতা বা উভয়ের উপর প্রভাব ফেলে।
শিশুর জন্মগত ত্রুটিগুলো হালকা থেকে গুরুতর পর্যন্ত পরিবর্তিত হতে পারে। যা গর্ভকালীন সময়ে ঘটে ও জন্মের সময় শনাক্ত করা যায়। কখনো কখনো দেরি করেও শনাক্ত হতে পারে।
জন্মগত ত্রুটিগুলো এক বা একাধিক জেনেটিক, সংক্রামক, পুষ্টি বা পরিবেশগত কারণে ঘটে থাকে।
বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৮ মিলিয়ন নবজাতক প্রতি বছর জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ মারা যায় সংশ্লিষ্ট জটিলতার কারণে। যার মধ্যে আনুমানিক ৯০ হাজার মৃত্যু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঘটে।
মৃত্যুহার ছাড়াও, জন্মগত ত্রুটি দীর্ঘমেয়াদী অক্ষমতা সৃষ্টি করে। যা ব্যক্তি, পরিবার, স্বাস্থ্য-পরিচর্যা ব্যবস্থা ও সমাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
২০১০ সালে শিশুর জন্মগত ত্রুটির বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক অফিস অব সাউথ-ইস্ট এশিয়া ও সিডিসি-ইউএসএ’র সহযোগিতায় জন্মগত ত্রুটির উপর একটি সামগ্রিক উদ্যোগ শুরু করে ২০১১- ২০১২ সালে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৯টি দেশকে জন্মগত ত্রুটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি করতে সহায়তা করেছে। ১২টি সংস্থার সহায়তায় ৩ মার্চ ২০১৫ সালে প্রথম বিশ্ব জন্মগত ত্রুটি দিবস পালিত হয়েছিল। অনেক আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড বার্থ ডিফেক্ট ডে’ এর প্রস্তুতির জন্য সমর্থনে যোগ দিয়েছিল।
সিডিসির পরিসংখ্যান অনুসারে, জন্মগত ত্রুটিগুলোর মধ্যে শীর্ষ ১০টির মধ্যে হার্টের ত্রুটির হার প্রতি ১১০ জনে ১ জন। এছাড়া হাইপোস্প্যাডিয়াস, ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ত্রুটি, ক্লাবফুট, ডাউনসিন্ড্রোম, পালমোনারি ভালভ অ্যাট্রেসিয়া অ্যান্ড স্টেনোসিস, ঠোঁট ও তালুকাটা রয়েছে।
করোনা মহামারি চলাকালীন সময়ে সামাজিক সমর্থন পাওয়াও একটি চ্যালেঞ্জ ছিল জন্মগত ত্রুটিতে আক্রান্ত শিশুদের। পরিবারে পরিচর্যাকারীর অভাব ছিল। পিয়ার সাপোর্ট পাওয়া সম্ভব হয়নি। শিশুরা বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও দেখা করতে সক্ষম হননি।
৩ মার্চ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘বিশ্ব জন্মগত ত্রুটি দিবস’। জন্মগত ত্রুটি, এর কারণ ও বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর প্রচেষ্টায় এ দিবস পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘অনেক জন্মগত ত্রুটি, একটি কণ্ঠ’।
দিবসটি পালনের লক্ষ্য হলো জন্মগত ত্রুটি ও তার প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, এই অবস্থার প্রাথমিক শনাক্তকরণ উন্নত করা, প্রাথমিক চিকিৎসা ও সময়মতো হস্তক্ষেপ বাড়ানো।
এ শিশুরা ‘কোভিড শিশু’, ‘ক্লাবফুট বেবি’ বা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেওয়া শিশু নয়। সবার প্রথমে তারাও একজন মানুষ, সহজ, সরল ও শক্তিশালী। সে সক্ষম এ পৃথিবীতে টিকে থাকতে।
একই সঙ্গে জন্মগত ত্রুটির প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি এ সমস্যা প্রতিরোধের সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যেও কাজ করা হয়। শিশুর জন্মগত ত্রুটির কারণ চিহ্নিত করার জন্য সঠিক পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি ও গবেষণার গুরুত্ব প্রচার করা জরুরি।
লেখক: কনসালটেন্ট, নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার ও চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল।
প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল।
Discussion about this post