ডা. মো. আব্দুল হাফিজ [শাফী]
করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে নেগেটিভ হয়ে সেরে ওঠার পর যে সমস্যাগুলো দেখা যাচ্ছে এবং এগুলো প্রতিরোধে কী করা যায়, তা তুলে ধরা হলো।
ফুসফুস :
ইতোমধ্যে আমরা সবাই জেনে গেছি, করোনাভাইরাস নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করে ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। করোনাভাইরাস সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে ফুসফুসে। যাদের ফুসফুসে ফাইব্রোসিস দেখা দেয় (যদিও ফাইব্রোসিসের হার খুব কম), তাদের মধ্যে অনেকের করোনাভাইরাস নেগেটিভ হওয়ার পরও শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট দীর্ঘদিন ধরে থেকে যেতে পারে। ফাইব্রোসিস হলো ফুসফুসের নরম-কোমল তন্তু, কোষ বা টিস্যু শক্ত হয়ে যাওয়া; অর্থাৎ ফুসফুসের বাইরে কঠিন আস্তরণ পড়ে যাওয়া। এতে ফুসফুসের স্বাভাবিক সংকোচন-প্রসারণ বাধা পায়। এই কারণে ধূমপায়ীরা করোনা থেকে সেরে উঠলে ধূমপান একেবারে ছেড়ে দেওয়া আবশ্যক। যতক্ষণ শ্বাস নিতে পারছেন ততক্ষণই জীবন। আমাদের শ্বাস নিতে সাহায্য করে ফুসফুস। তাই শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে করোনা থেকে সেরে ওঠার পর। এ ক্ষেত্রে হাতের কাছে একটা সহজলভ্য স্পাইরোমিটার রাখতে পারেন, যা খুব উপকার দিয়ে থাকে। খুব সহজেই সারাদিন বেশ কয়েকবার এই স্পাইরোমিটার দিয়ে শ্বাসের ব্যায়াম করে আক্রান্ত ফুসফুসকে আবার সাবলীল করতে পারেন। এখানে ছোট্ট একটা ডিভাইসের মধ্যে তিনটি বল থাকে। শ্বাস দিয়ে রোগীদের সেই বলগুলো ডিভাইসের ভেতরে তুলতে হয়। প্রথম দিন হয়তো একটা, পরের দিন আরেকটা, এভাবে আস্তে আস্তে তিনটি বলই তোলার ক্ষমতা বাড়ে। তিনটি বল তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে আবার ছেড়ে দিতে হয়। এভাবে ফুসফুসের ক্ষমতা বাড়ে। এ ছাড়া ফুসফুসের সক্ষমতা বাড়াতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠলে হাঁটা শুরু করতে পারেন।
হূৎপিণ্ড :
পোস্ট কভিড হৃদরোগজনিত সমস্যা মানেই মৃত্যু আতঙ্ক নয়- এমনটাই জানাচ্ছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বিভিন্ন বার্তা বা গবেষণা। কভিড থেকে সুস্থ হওয়ার সপ্তাহ দুয়েক পরই যেন চিকিৎসকের পরামর্শে ইসিজি করিয়ে নেওয়া হয়, ক্ষেত্রবিশেষে ইকো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে পোস্ট কভিডে। বুক ধড়ফড় বা দ্রুত হূৎস্পন্দন অত্যন্ত পরিচিত একটি পোস্ট কভিড সমস্যা, যা আমাকেও অনেক দিন ভুগিয়েছে। বিশ্রামের সময়ও অনেক বেশি বুক ধড়ফড় করে এই সময়ে, যা মাঝেমধ্যে আতঙ্কিত করে ফেলতে পারে। তাই বুক ধড়ফড়ের সমস্যা বেশি হলে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন, প্রয়োজনে ওষুধ সেবন করবেন। করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ফলোআপের সময় নতুন রোগ হিসেবে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেসারের সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই এই সময়ে ভয়ভীতিহীন স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের মাধ্যমেই একমাত্র এড়িয়ে যাওয়া যেতে পারে দীর্ঘমেয়াদি হৃদরোগের সম্ভাবনাকে।
ক্লান্তি এবং মানসিক অবসাদ :
করোনার সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার পর প্রায় সবাই এ ধরনের সমস্যায় ভুগে থাকেন। এর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে- তীব্র অবসাদ, সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব থাকলেও ঘুম না আসা; আবার কখনও ইচ্ছা না থাকলেও অল্প সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়া অন্যতম। দিনের বেলা বেশি বেশি হাই ওঠা। কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারা, কথা বলতে অনাগ্রহ ইত্যাদি। এমনকি রোগী আগে যেসব বিষয়ে খুব আনন্দ পেতেন, সেগুলোও করোনা-পরবর্তী সময়ে ভালো না লাগা কিংবা বিরক্ত লাগার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। মনে রাখবেন, এই ধরনের সমস্যা সাময়িক; এতে ভীত হয়ে নিজেকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলবেন না। করোনা থেকে সেরে ওঠার পর এই অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে যা করার ব্যাপারে চিকিৎসকরা বারবার তাগিদ দিচ্ছেন তা হলো, ঘুমের রুটিন ঠিক রাখার চেষ্টা করা এবং অযথা রাত না জাগা। দিনের বেলা কর্মময় থাকতে হবে, রাতে সঠিক সময়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে। প্রয়োজনে দিনেও অল্প সময়ের জন্য ঘুমিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, সারাদিন বিছানায় গড়াগড়ি করা যাবে না। নিজেকে চাঙ্গা রাখতে হবে। কভিড-পরবর্তী মানসিক স্থিতি ঠিক রাখতে মেডিটেশন, ধ্যান বা প্রার্থনা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। কোনো কাজে তাড়াহুড়া করবেন না। এই পোস্ট কভিড পিরিয়ডে প্রতিদিন গোসল করার অভ্যাস খুব উপকার দেয়।পর্যাপ্ত পানি আর ফলের রস পান করতে হবে। পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। কভিড থেকে সেরে ওঠার পর ব্যায়াম বা খেলাধুলা শুরু করার জন্য তাড়াহুড়া করলে আচমকা বিপদ ডেকে আনতে পারেন। তাই কিছুদিন বিশ্রাম নেওয়ার পর চিকিৎসকের অনুমতি নিয়েই ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে শরীরচর্চা শুরু করতে পারেন।
লেখক- ডা. মো. আব্দুল হাফিজ [শাফী] ,নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ, সিওমেক হাসপাতাল।
Discussion about this post