লুনা পারভীন
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০-৫০% পর্যন্ত সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশুরও এ সমস্যা থাকতে পারে। বড় শিশুদের পাশাপাশি নবজাতকেরও এমন সমস্যা দেখা যায়। এ খেতে না চাওয়াকে বলে ফুড এভাশন বা খাদ্যে তীব্র অনীহা।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক অসুস্থতা এর জন্য দায়ী। এর পাশাপাশি অতিরিক্ত খাওয়ানো, ভুলভাবে খাওয়ানো, খাবারে অ্যালার্জি এবং ১৫% ক্ষেত্রে অটিজমের লক্ষণ হিসেবেও শিশুর খাবারে তীব্র অনীহা দেখা দিতে পারে
কেস ১: নাফিসার সন্তান ৭ মাসে জন্মেছে, ওজনও কম ছিল। ১৬ দিন আইসিইউতে রাখার পর সন্তান যখন মায়ের কাছে দেওয়া হলো তখন সন্তান আর কিছুতেই বুকের দুধ মুখে নেয় না। দিলেই ঠেলে বের করে দেয় অথবা কান্নাকাটি করে। ফলে খাওয়াতে ব্যর্থ হয়ে নাফিসাকে আবার সন্তান নিয়ে হাসপাতালে আসতে হলো। সঙ্গে জুটলো আত্মীয়-স্বজনের টিটকিরি আর চিকিৎসকদের বকাঝকা।
কেস ২: তুর্য অসম্ভব চঞ্চল একটা ছেলে। সারাদিন ছোটাছুটি করে। খাবার সময় হলেই তার বমি বমি ভাব হয়, মাংস আর ভাতের বাইরে কিছু দিলেই থু করে ফেলে দেয় অথবা বমি করে দেয়। সারাদিন না খাইয়ে রাখলেও ক্ষুধা লাগে না তার। যত শুকিয়ে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে তত মায়ের কপালে খোঁটা জুটছে সন্তানের যত্ন ঠিকমতো না নেওয়ার।
কেস ৩: ফাইজার পাঁচদিন ধরে জ্বর, গলাব্যথা, খেতে গেলেই বমি করে দিচ্ছে। চিকিৎসকের কাছে এসেই মায়ের প্রথম কথা- শিশুসন্তান একদম খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, রুচি নেই। খাবারের রুচির জন্য ওষুধ কি দেওয়া যায়? মাকে জিজ্ঞেস করা হলো, মায়ের যদি তীব্র জ্বর থাকতো তাহলে কি সে খেতে পারতো? ওষুধ দিলেই কি শিশু অসুস্থ শরীরেও গপগপ করে খাবার খাবে?
সত্যিই কি এগুলো সমস্যা না রোগ, নাকি মায়েদের মিথ্যা অভিযোগ যে সন্তান কিছুই খায় না! অন্য অনেকের মতো আমিও মনে করতাম, এসব মায়েদের অতিরিক্ত খাওয়ানোর চেষ্টা করার কুফল, আসলে কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু একটু বইপত্র, জার্নাল ঘেঁটে দেখলাম এটা আসলেই এক ধরনের অসুস্থতা বা ইটিং ডিসঅর্ডার। তাই নিয়ে আজকের আলোচনা।
কীভাবে বুঝবেন শিশুর খাবারে অনীহা আছে?
১. নবজাতকের ক্ষেত্রে, বুকের দুধ মুখে নিলে বা খাওয়ানোর জন্য পজিশন নিলেই শিশু অস্থির হয়ে কান্নাকাটি করে বা বিরক্ত হতে থাকে। হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে দূরে সরে যায় বা মুখ দিয়ে নিপল ঠেলে মুখ থেকে সরিয়ে দেয়। জেগে থাকা অবস্থায় কোনভাবে খাওয়ানো যায় না, কিন্তু ঘুমন্ত ভাব হলে আস্তে আস্তে মুখে দিলে খেতে থাকে।
২. একটু বড় শিশুদের ক্ষেত্রে, খাবার দেখলে কান্না করা, বমি বমি ভাব করা, খাবার থু করে ফেলে দেওয়া, খাবারের স্বাদ ভালো না বলা বা বাজে গন্ধ পাওয়া। নির্দিষ্ট খাবার ছাড়া অন্যকিছু দিলে বমিভাব বা বমি করা।
৩. খাদ্যে অনীহার সঙ্গে ওজন ধীরে ধীরে কমতে থাকা, স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া।
কেন হয় খাবারে তীব্র অনীহা?
১. জন্মের পর বা অসুস্থতার জন্য দীর্ঘ সময় নাকের নল দিয়ে খাবার দিলে বা মুখে খাবার বন্ধ থাকলে, কৃত্রিম শ্বাসের জন্য গলায় নল দেওয়া থাকলে মুখে ও গলায় ঘা হলে শিশু বিশেষ করে নবজাতকদের খাবার গেলা বা চোষার ক্ষমতা কমে যায়।
২. বড় শিশুদের ক্ষেত্রে, খাবার বা অন্যকিছু শ্বাসনালীতে গিয়ে বিষম খেলে বা শ্বাসকষ্ট হলে পরবর্তীতে ভীতি থেকে খাদ্যে অনীহা তৈরি হয়। আবার মুখে বা জিভে ঘা থাকলে বা আঘাত পেলে, দীর্ঘ সময় অসুস্থ থাকলে বা কড়া এন্টিবায়োটিক বা কেমো পেলে জিভে সাদা পর্দার মতো ময়লা জমে বা ফাংগাস জমে। এসব ক্ষেত্রে শিশু খাবারের স্বাদ না পাওয়ায় খাদ্যে অনীহা জন্মায়। ফলে শিশুর খাবারের প্রতি ভীতি জন্মে, খেলে ব্যথা পায় বা গিলতে কষ্ট হলে অল্প খেয়ে আর খেতে চায় না।
৩. অনেক সময় মায়েরা বাড়তি খাবার তিনবেলা খাওয়ান, সেই হিসেবে ভাবেন শিশুকে তো কমই খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু এর বাইরে যে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন সেটাকে অনেকে খাবার মনে করেন না। ফলে বুকের দুধ খেয়ে যে শিশুর পেট ভরে থাকলো, এরপর দিতে চাইলে বাড়তি খাবার শিশু না-ই খেতে চাইতে পারে, এটা তারা বুঝতে পারেন না । এটাকে কিন্তু তখন খাদ্যে অনীহা বলা যাবে না। আবার, সবার খাবারের চাহিদা এক রকম নয়। কারো তিন চামচ খেলেই পেট ভরে যায়, আবার কারো এক প্লেটেও পেট ভরে না। কাজেই, আপনার সন্তানের খাবারের চাহিদা বুঝুন, খিদে লাগতে দিন এবং কখনোই জোর করবেন না।
খাদ্যে অনীহা মোকাবিলায় কী করবেন?
নবজাতক বা বুকের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে:
১. মায়ের গায়ের চামড়ার সঙ্গে শিশুকে গা লাগিয়ে রাখুন
২. আগে যেভাবে খাওয়াতেন সেভাবে না খাইয়ে অন্য কোনো পজিশনে খাওয়ান
৩. এ সময়টাতে কোনো ধরনের ফিডার, চুষনি, প্যাসিফায়ার দেওয়া যাবে না। তবে দাঁত হওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে বা মায়ের নিপলে ব্যথা থাকলে নিপল সিল্ড বা প্লাস্টিকের কভার নিপলের উপর দিয়ে চুষতে দেওয়া যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে জীবাণুর আক্রমণ, মায়ের ব্রেস্টে ইনফেকশন বা বুকের দুধ কম পাওয়ার মতো সমস্যাগুলো হতে পারে।
৪. জাগা অবস্থায় না দিতে পারলে প্রাথমিকভাবে ঘুমঘুম ভাব হলে দেওয়ার চেষ্টা করবেন, যেন নবজাতক টানা ৪-৫ ঘণ্টা না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা না হয়। তবে ২৪ ঘণ্টায় শিশুকে অন্তত মোট ১২-১৮ ঘণ্টার ঘুম দিতে হবে৷
বুকের দুধ না পেলে কী করবেন?
১. প্রস্রাব ঠিক থাকলে কোনো ফর্মুলা বা ফিডার দেওয়ার কথা ভুলে যান। তবে মা যদি অসুস্থ হন বা বুকের দুধ খাওয়ানোর বারণ থাকে সেটা আলাদা কথা।
২. প্রয়োজনে মা বেশি করে পানি, দুধ, তরল খাবার, পোনামাছ, সবজি, কালিজিরা খাবেন। বিশেষ করে বুকের দুধ দেওয়ার আগে পরে ২ গ্লাস পানি খাবেন।
৩. সন্তানের সঙ্গে মায়েরও পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুমের প্রয়োজন আছে।
৪. দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার জন্য মা গান শুনতে পারেন, বই পড়বেন, গরম পানিতে গোসল নিতে পারেন।
৫. বুকের দুধ বাড়ানোর জন্য গরম সেক, ম্যাসাজ, পাম্পের মাধ্যমে কিছু দুধ বের করে নেওয়া যেতে পারে।
বড় শিশুদের ক্ষেত্রে খাদ্যে অনীহার সমাধান
১. অসুস্থতা, মুখে আঘাত বা ঘা সাময়িক সমস্যা। এসব ক্ষেত্রে তরল খাবার বা অল্প অল্প করে বারবার খাওয়ানো, চামচে করে খাবার গিলতে দেওয়া যেতে পারে।
২. দাঁত ব্রাশ করার সময় দুইবেলা জিভ ব্রাশ করে দিতে হবে যেন জিভে ময়লা না জমে।
৩. শিশুকে খাবারে আগ্রহী করে তোলার জন্য খাবার তৈরির সময় শিশুকেও সঙ্গে নিন সাহায্য করার জন্য। তাকেও মতামত দিতে দিন।
৪. খাবার পরিবেশনের সময় খাবার ডিজাইন করা, ঘরবাড়ি, কার্টুন আঁকা, ছোট পশুপাখি তৈরি করা, খাবারগুলো শিশুর খেলনা হাঁড়ি-পাতিল বা থালাবাটিতে দেওয়া, খাবার নিয়ে গল্প তৈরি করা; এভাবে খাবার পরিবেশটা শিশুর জন্য আনন্দদায়ক করা যেতে পারে ভীতি দূর করার জন্য।
৫. মোবাইল-টিভি বন্ধ করে ছড়াগান বা গল্পের মাধ্যমে বা পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে গল্পগুজবের মাধ্যমে শিশুর আগ্রহ তৈরি করতে পারেন খাবারে।
৬. শিশুকে নিজ হাতে খেতে উৎসাহিত করুন। বারবার খাওয়ার জন্য বিরক্ত না করে, টেবিলে খাবার রেখে আসুন ও শিশুকে খিদে লাগলে নিজেই খাবার খুঁজে খেতে দিন।
৭. কখনোই জোর করবেন না বা চাহিদার অতিরিক্ত খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন না। তরল বা ব্লেন্ড করা খাবার নিরুৎসাহিত করুন, শিশুকে চিবিয়ে খেতে উৎসাহিত করুন।
৮. আস্তে আস্তে করে খাবারের পরিমাণ ও সময় বাড়ান। এক দুই চামচ ১০ মিনিট পর্যন্ত খেলো, তারপর বন্ধ। আবার ৬-৭ চামচ ১৫-২০ মিনিট সময় ধরে খেলো। তবে আধা ঘণ্টার পর আর কোন খাবার দেবেন না, তাহলে হজমে সমস্যা হবে।
চিকিৎসা কখন প্রয়োজন?
১. দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকলে, স্বাস্থ্য কমতে থাকলে সেভাবে চিকিৎসা করাতে হবে।
২. রক্তস্বল্পতা রোগ থাকলে আয়রন, ফলিক এসিড ও আয়রনযুক্ত খাবার যেমন মুরগির কলিজা, কাঁচা কলা, লালশাক, রঙিন শাকসবজি খাওয়াতে হবে।
৩. আচরণগত সমস্যা বা অটিজমের লক্ষণ থাকলে কাউন্সেলিং ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে হবে।
শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে, খাবারকে ভীতিকর কিছু ভাবতে দেওয়া যাবে না। শিশুকে উৎসাহিত করুন তার নিজের খাদ্য তালিকা বাড়ানোর জন্য, প্রতিবার নতুন খাবারের জন্য তাকে পুরস্কৃত করুন, খাবার দিয়ে গল্প তৈরি করতে দিন এবং কিছুদিন পর পর তার উন্নতি পর্যালোচনা করুন।
আগে দশ-বারোটা সন্তান নিয়ে যৌথ পরিবারে মায়েদের এত সময় ছিল না ঝামেলা করার। তাদের সন্তানদের সন্তানরা আজ বাবা-মা হয়েছেন। এখন একটা সন্তান, একক সংসারেও যেন এ সন্তান নিয়ে দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই। দুধে আলতা রং হতে হবে, আপেলের মতো গাল হতে হবে, আইনস্টাইনের মতো জ্ঞানী হতে হবে, বিল গেটসের মতো সফল হতে হবে, পড়ালেখায় টপার হতে হবে, নাচগান ছবি আঁকায় পারদর্শী হতে হবে, পাশের বাড়ির শিশুর থেকে এগিয়ে থাকতে হবে। সব চাপ এসে পড়ে মায়েদের ঘাড়ে।
এজন্য চার্ট করে গুগল ঘেঁটে ভালো ভালো বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার বানিয়ে খাওয়াতে হবে যেভাবেই হোক। সবকিছুতেই এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা কি আসলেই শিশুকে মানুষ হয়ে গড়তে সাহায্য করছে নাকি অসুস্থ আর অমানুষ বানাচ্ছে তা ভাবতে হবে সবাইকে।
লেখক পরিচিতি: শিশু বিশেষজ্ঞ, বহির্বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল
Discussion about this post