ডা. রুম্মান ফেরদৌস
করোনার ভিড়ে সব রোগব্যাধি যেন চাপা পড়ে গেছে। বিশেষ করে ভাইরাসের রাজত্ব এখন যেন করোনাময় হয়ে গেছে। তবে শুধু এই কভিড-১৯ নয়, আমাদের চারপাশে আরও অনেক জানা-অজানা প্রাণঘাতী ভাইরাস ঘুরঘুর করছে। মজার ব্যাপার হলো, শিশুদের হেপাটাইটিস বা লিভারের ইনফেকশন মূলত এ ভাইরাস দিয়েই হয়ে থাকে। সাধারণত হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি, ই ভাইরাস দিয়ে বেশির ভাগ হেপাটাইটিস হয়ে থাকে। এ ছাড়া সাইটোমেগালো, ইপেসটিনবার, হারপেস সিমপ্লেক্স, মিজেলস বা হাম, হারপেস জোসটার এবং এইডস ভাইরাস থেকেও শিশুর হেপাটাইটিস হতে পারে। এর মধ্যে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস সবচেয়ে মারাত্মক। এগুলো দিয়ে আক্রান্ত শিশুর পরবর্তী সময়ে লিভারে ক্যান্সার, লিভার সিরোসিসসহ বিভিন্ন জটিল অসুখ হতে পারে। ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস ছড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ, সিরিঞ্জ, মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও মায়ের কাছ থেকে। হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ ভাইরাস সাধারণত পানি ও খাদ্য দিয়ে ছড়ায়।
হেপাটাইটিস বা জন্ডিস হলেই শিশুদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন পড়ে না। তবে অতিরিক্ত জন্ডিস, অত্যধিক বমি, রক্তক্ষরণ, পেট ফোলা, অত্যধিক ঘুম বা ঘুমের অনিয়ম, অস্বাভাবিক পেট ব্যথা ইত্যাদি হয় তাহলে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে যেমন- রক্তের বিলিরুবিনসহ লিভার ফাংশন টেস্ট, আলট্রাসনোগ্রাম, রক্তের ভাইরাস অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পরীক্ষা। যদি হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাহলে সাধারণ উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করালেই সেরে যাবে। কিন্তু ‘বি’ ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হলে শিশুকে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ও ইনজেকশন ইন্টারফেরন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এ চিকিৎসা পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত ব্যয়বহুল।
শিশুর হেপাটাইটিস হলে তাকে চাহিদামতো সহজপাচ্য খাবার অল্প করে বারবার দিতে হবে। প্রতিদিন যাতে নিয়মিত পায়খানা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সে জন্য ল্যাকটুলোজ ও আর রক্তক্ষরণ বন্ধের জন্য কোনোকুইন ইনজেকশন দিতে হবে। এসব করতে হবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।
শুধু স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি করেই অধিকাংশ ভাইরাস দ্বারা যকৃতের রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। পায়খানার পর, শিশুদের ডায়াপার পরিবর্তন করার সময়, রান্না করার সময় ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত পরিস্কার করলে হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ জীবাণু দ্বারা হেপাটাইটিস রোগের প্রতিরোধ সম্ভব। সিরিঞ্জ ও অন্যান্য মেডিকেল যন্ত্রপাতি এবং রক্ত দেওয়ার আগে তা হেপাটইিটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসমুক্ত কিনা, তা পরীক্ষা করে নিতে হবে। প্রসবকালীন মায়ের রক্ত তথা কর্ডের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ছড়ায়; এ জন্য মায়েরা যাতে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত না হন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। হলেও সে ক্ষেত্রে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে মায়ের বুকের দুধ থেকে ভাইরাস ছড়ালেও শিশুর প্রাণরক্ষার্থে এই দুধ দেওয়া যেতে পারে। যদি মা ‘বি’ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন তাহলে নবজাতক শিশুকে জন্মের পরপরই হেপাটাইটিস ‘বি’ রোগের টিকা ও ইমুনোগ্লোবিন দিতে হবে।
নিয়মিত টিকা দেওয়ার মাধ্যমেও হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘বি’ আক্রমণ থেকে শিশুদের রক্ষা করা যায়। এক বছর বয়সের পর থেকে ‘এ’ ভাইরাসের টিকা দেওয়া যায়। শিশুদের হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের টিকা টিকাদান কেন্দ্রে বিনামূল্যে দেওয়া হয়। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের টিকা যে কোনো বয়সে নেওয়া যায়।
[নবজাতক ও শিশু বিশেষজ্ঞ , শিশু কার্ডিওলজি বিভাগ ,জাতীয় হদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসাপাতাল]
Discussion about this post