ডা. খান লামিয়া নাহিদ
শূন্য থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত বয়সটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এসময় শিশুর ৯০ ভাগ মস্তিষ্কের বিকাশ হয়। একটি শিশু বড় হয়ে কি হবে? তার মেধা কতটুকু হবে? সেটি সম্পূর্ণ নির্ভর করে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত তার যত্ন ও খাবার দাবারের উপর। এজন্য পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর প্রয়োজন। এসময়টাতে ব্যালেন্স ডায়েট (প্রয়োজনীয় সকল উপাদান আছে এমন খাবার) খাওয়াতে হবে। শিশুর বয়স যখন ২ বছরের উপরে হয়, তখন সে বাহিরের খাওয়ারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। যেমন: চিপস, কোলড্রিংকস এগুলো খেতে চায়। কিন্তু এসময় বাহিরের খাবার পুরোপুরি এড়াতে হবে। কারণ, শিশুকে যেভাবে খাওয়ানো হবে সেভাবে শিশু তার খাদ্য তালিকা ঠিক করবে।
ফলমূল
শিশুদের জন্য ফলের মধ্যে ভিটামিন সি আছে এমন ফল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন সি জাতীয় ফল হলো-কমলা, মাল্টা, পাকা পেঁপে, আনারস, পেয়ারা। এগুলোকে জুস করে খাওয়ানো যায়। ধীরে ধীরে কলা, আপেল, স্মেস করে খাওয়াতে হবে। তবে শক্ত ফল দেওয়া যাবে না। দেশীয় এবং মৌসুমি ফল বেশি পরিমাণ খাওয়ানো প্রয়োজন। যেমন: আম, কাঁঠাল এগুলো খুবই ভালো। এসব খাওয়ারে মস্কিষ্কের বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শিশুর বয়স বারো মাসের নিচে হলে গরুর দুধ খাওয়ানো যাবে না। ১২ মাসের নিচে দুধ খাওয়াতে চাইলে যে কোনো ইনফ্যান্ট ফর্মূলা খাওয়াতে পারেন, তবে পরামর্শ হচ্ছে-শিশুকে দুই বছর পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানো।
সব খাবার এক সাথে নয়
অনেক সময় মায়েরা ছয় মাস বয়সে শিশুকে ডিম, খিচুড়ি এসব খাওয়াতে শুরু করেন। সবগুলো খাওয়ার যখন একসাথে শুরু করা হয়, শিশুর তখন ডায়রিয়া, কনস্টিপেশন (কোষ্ঠকাঠিন্য) ও বমি এ তিন ধরনের সমস্যা হতে পারে। শিশুর ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য ও বমি যেনো না হয়; এজন্য আস্তে আস্তে একেকটা খাবার অল্প অল্প পরিমাণ দিতে হবে। যেমন: একটি ডিমের চারভাগের একভাগ থেকে শুরু করা যায়। ছয় মাস পরে শিশু বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার খাবে। এসময় কতটুকু পরিমাণ পানি খাওয়াবো? বুকের দুধের সঙ্গেও শিশু পানি পাচ্ছে। খাওয়ারের সঙ্গেও পানি আছে। শিশু ফলের রস খাবে এটির মধ্যে পানি আছে। তাই যতটুকু পানি প্রয়োজন ততটুকু দিতে হবে। গরমকালে বেশি পানি দরকার শীতকালে কম পানি দরকার। তারতম্য ও তাপমাত্রা ভেদে পানি দিতে হবে। খাবার এবং পানি এমনভাবে দিতে হবে যেনো ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিশুর প্রস্রাব ৬ বারের অধিক হয়। প্রস্রাব ছয় বারের নিচে নেমে গেলে বুঝতে হবে শিশুর পানির প্রয়োজন আছে, তখন পানির পরিমাণটা বাড়িয়ে দিতে হবে।
কিছু স্বাভাবিক সমস্যা
শিশু শুধু বুকের দুধ খাচ্ছে। সাতদিন ধরে পায়খানা করছে না। মায়েরা তখন খুবই উদ্বিঘ্ন হয়ে যায়। এটা হতে পারে এটি মারাত্মক কোনো সমস্যা নয়। তবে তিনদিন পার হয়ে গেলে শিশুকে পায়খানা করাতে হবে। গ্লিসারিন সাপোজিটার দিয়ে পায়খানা করাতে হবে। শুধু বুকের দুধ খেলেও কনস্টপিউশন হতে পারে, ছয় মাস পরে নতুন খাবার দিলাম তখনও কনস্টিপেশন হতে পারে। দুই থেকে তিন বছর বয়সে যখন টয়লেট প্লেনিং হয় শিশুকে যখন পোটিতে বসানো হয় তখন ও কনস্টিপিউশন হয়। শিশুরা যখন নতুন কোন জায়গায় যায় তখন পাবলিক টয়লেটে সে বসবে না তখনও কনস্টিপেশন হতে পারে। এ সমস্যাগুলো ৮০ ভাগ শিশুর হয়ে থাকে। ডায়রিয়া, বমি, সর্দি কাশি এটি সাধারণ রোগ। এটি কোনো ব্যাপার না। ডায়রিয়া হলেই এন্টিবায়োটিক খাওয়াতে হবে, সর্দি কাশি হলেই এন্টিবায়োটিক খাওয়াতে হবে এটি ঠিক নয়। আমরা ঘরোয়াভাবে চিকিৎসা নিবো। ডায়রিয়া হলে স্যালাইন খাওয়াবো। বমি যাতে না হয় সেক্ষেত্রে খাওয়ার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। যেসব খাবার খেলে কনস্টিপেশন হয় সেসব খাবার দিবো না। শিশুকে পটিতে ঠিকমতো বসাবো।
একটি শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার পর অনেক ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুরা কিছু বলতে পারে না। তাই কান্নার মাধ্যমে তারা তাদের অসুবিধেটা ব্যক্ত করে। অনেক সময় দেখা যায়, শিশু অনেক কান্নাকাটি করছে, এটাকে বলে ইনফ্যান্টাইল কলিক। শিশুরা প্রস্রাব-পায়খানা করার আগে অনেক মোচড়ামুচড়ি করে, এটি সব মায়েরা বলে থাকেন। এটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। এ কান্নাকাটি করা কোনো সমস্যা নয়। শুধু বুকের দুধ খেলেও এ কান্নাকাটি করতে পারে। বাহিরের দুধ খেলেও কান্নাকাটি করতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় শিশু শুধু মায়ের বুকের দুধ খাচ্ছে, তাও অতিরিক্ত পায়খানা করছে। শিশু চারদিন পরেও পায়খানা করতে পারে অথবা দিনে বিশবারও করতে পারে। দুটি বিষয়ই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।। কিন্তু নতুন মায়েরা বুঝতে পারে না। তারা মনে করে এটি ডায়রিয়া। আসলে এটি ভয়ের কিছু না। এটি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। আরেকটি বিষয় হলো শিশুর পায়খানা হলুদ হতে পারে,সাদা হতে পারে, অথবা সবুজ হতে পারে এভাবে বিভিন্ন কালার হতে পারে। এসময় মায়েরা ভয় পেয়ে যায়। এটি ভয়ের কিছু না। তবে শিশুর পায়খানার সঙ্গে যদি রক্ত দেখা যায় তাহলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
লিকুইড খাবারে যেসব রোগ হয়
জন্মের ছয় মাস পর শিশুদের বাড়তি খাবার দিতে হবে। অনেক সময় শিশু মায়ের বুকের দুধ পায় না, তখন বাড়তি খাবার দেওয়া হয়। বাড়তি যে ইনফ্যান্ট ফর্মূলা অর্থাৎ বাইরের যে দুধগুলি খাওয়ানো হয়। সেগুলো ফিডারের মাধ্যমে খাওয়ানো হয়। অনেক সময় ফিডার পরিষ্কার করা হয় না, কিংবা বাটি চামচে দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে জীবানু শিশুর শরীরে প্রবেশ করে। সেখান থেকে রোটা ভাইরাস ডায়রিায়াসহ অন্যান্য রোগ হতে পারে। রোটা ভাইরাস ডায়রিয়া খুব মারাত্মক। প্রচুর পরিমাণে পাতলা পায়খানা হয়। সেখান থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়। এ সময় পানি শূন্যতা দেখা দেয় এবং শিশু নেতিয়ে পড়ে। এ অবস্থায় শিশুকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। অকেন সময় শিশু শুধু বুকের দুধ খায়, কোনো পানীয় খায় না। তারপরও রোটাভাইরাস ডায়রিয়া হতে পারে। কারণ, শিশুদের যখন গোসল করানো হয় বা অন্য কোনভাবে শিশুর মুখের মধ্যে পানি চলে যেতে পারে তখন সেভাবেও রোটাভাইরাস ডায়রিয়া হতে পারে।
করণীয়
ডায়রিয়া হলে শিশু যদি নেতিয়ে না পড়ে বা চরম পানি শূন্যতা না দেখা দেয় তাহলে তাকে ওরস্যালাইন খাওয়াতে হবে। বড়দের জন্য যেভাবে ওরস্যালাইন তৈরি করা হয় শিশুদের জন্য একইভাবে তৈরি করতে হবে। শিশুর ওজন যত কেজি তত চামচ ওরস্যালাইন প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর খাওয়াতে হবে। এভাবে ঘরে শিশুদের ডায়রিয়া চিকিৎসা করা যায়। অনেক সময় দেখা যায়, শিশু ঘনঘন বমি করছে, তিন-চার মাস বয়সের একটি শিশু যতবার খাওয়ানো হয় ততবার বমি করছে, এটাকে গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স বলে। অনেক সময় রিফ্লাক্সের জন্য অথবা খাবার পদ্ধতির ভুলের জন্য শিশুর বমি বেশি হতে পারে। যেমন: শিশুকে খাওয়ানোর সময় বেশি বেশি পানি খাওয়ানো। বমি যাতে নায়, এজন্য খাওয়ানোর পনের থেকে বিশ মিনিট পর পানি খাওয়ানো উচিত। অতিরিক্ত তরল করে খাবার না দেয়া। শিশুর খাবার একটু ঘন রাখা দরকার। খাওয়ানোর পর শিশুকে একটু বামকাতে শোয়াতে হবে।
সহকারী অধ্যাপক, পেডিয়াট্রিক এন্টারোলজি ও পুষ্টি বিভাগ ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post