হার্টবিট ডেস্ক
২০১৯ সালে প্রথম জানতে পারি আমি ক্যানসারে আক্রান্ত। তাও একটা নয়, স্তন ও থাইরয়েড দুটি ক্যানসারে আক্রান্ত হই। প্রথমে জানতে পারি আমার স্তন ক্যানসার। পরে থাইরয়েড ক্যানসারের কথা। দুটো ক্যানসার যখন কোনো মানুষের শরীরে বাসা বাঁধে, তখন তাঁর জীবনটা কেমন হওয়ার কথা?
অথচ আমার ছিল প্রজাপতি জীবন। ঘুরতাম, ছবি তুলতাম, রান্নাবান্না করতাম। ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। ইচ্ছা হলেই দেশ–বিদেশে উড়াল দেওয়া। শখের শাড়িগুলো পরে কখনো কাশফুলের বাগানে, কখনো বা হলুদ শর্ষেখেতে ছবি তোলা। স্বামী-সন্তানসহ অপার আনন্দের জীবন। সুখের কথা, দুইটা ক্যানসারের পরও এখনো আছে আমার সেই প্রজাপতি জীবন। এর মধ্যে আমাকে, আমার পরিবারকে অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে। মাসে মাসে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে নিতে, নানাবিধ ওষুধ–ইনজেকশন নিতে আমি হয়তো বেছে নিতে পারতাম রোগীর জীবন। কিন্তু জীবন তো একটাই, তাকে যাপন করতে হবে নিজের মতো করে, এই বোধ আমার মধ্যে কাজ করে সব সময়। তাই আগের প্রজাপতি জীবনের মতো দুটো ক্যানসারের রোগী হয়েও এখনো আমি বাঁচতে জানি। হাসতে জানি।
আমার মা–ও ছিলেন স্তন ক্যানসারের রোগী। সেই হিসেবে আমার হওয়ারও একটা আশঙ্কা ছিল। তাই আমি নিয়মিত নিজ উদ্যোগে স্তন পরীক্ষা করাতাম। আমার স্বামী সিঙ্গাপুর পোর্টে কর্মরত আর আমি সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে। চল্লিশ বছর শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত স্তন পরীক্ষার ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ২৭ মে প্রথমে জানতে পারি, আমার স্তন ক্যানসার হয়েছে।
তখন আমার বয়স ৫৩। প্রথমে মন খারাপ হয়েছিল। অনেক কান্নাকাটি করি। পরিবারের সবার মন খারাপ হয়েছে, দেখে কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু চিকিৎসা নিতে দেরি করিনি। সৃষ্টিকর্তার রহমতে আমার দুটো ক্যানসারের একটাও অ্যাগ্রেসিভ ছিল না। আমি স্টেজ-২–তে ছিলাম। তাই চিকিৎসা নিতে মোটেই দেরি করিনি। সে সময় সিঙ্গাপুরের এনইউএইচ হাসপাতালে ডাক্তার মাইকেল হার্টম্যানের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় আমার চিকিৎসা। তিনি নিজেই অস্ত্রোপচার করেন। রোজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপি নিতে যেতে হতো। শরীরে কষ্ট ছিল। কিন্তু মনে জোরও ছিল, আমি সুস্থ হয়ে যাব।
চিকিৎসক মাইকেল হার্টম্যানও আমাকে খুব সহায়তা করেছেন। একসঙ্গে দুটো ক্যানসারের চিকিৎসা কীভাবে নেব, এই ভাবনায় পুরো পরিবার কিছুটা চিন্তিত ছিল। সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা আগে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার পরামর্শ দিলেন। তাঁরা জানান, স্তনের চিকিৎসার সব ধাপ শেষ করে থাইরয়েড ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু করতে হবে। আমরা তা–ই করি। স্তন ক্যানসারের সব চিকিৎসা শেষে শুরু হয় থাইরয়েডের চিকিৎসা। স্তন ক্যানসারে আমাকে যে ইনজেকশন দেওয়া হতো, সেটা দিত হাড়ে। এটা ছিল খুব যন্ত্রণার। দাঁতে দাঁত চেপে সময়টা পার করেছি। ক্যানসার চিকিৎসার প্রতিটি ধাপই তো অসহ্য যন্ত্রণার, ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন।
আশপাশে আমি অনেক ক্যানসার সারভাইবার দেখেছি। তাঁরা সেটাকে জয় করেছেন। চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপশি রুটিনমাফিক সুন্দর জীবন যাপন করছেন। আবার অনেকে একেবারে ভেঙে পড়েছেন। ক্যানসার রোগী, আমার আবার কিসের জীবন?—এমন ভাবনা নিজে ভাবেন, পরিবারের সদস্যরাও তা–ই মনে করেন। তাঁরা হয়তো সারাক্ষণ মানুষটির পাশে সহানুভূতি নিয়ে সেবা দিতে থাকেন। কিন্তু আগের মতো জীবনযাপন যেমন সেই আক্রান্ত ব্যক্তি করতে পারেন না, তাঁর পরিবারও তেমনি বিষয়টি ভাবনায় আনেন না। আমি যেহেতু হাসতে জানি, বাঁচতে জানি—তাই দুটো ক্যানসারের চিকিৎসা নেওয়ার পরও জীবনকে এখনো আনন্দের সঙ্গে যাপন করি।
নিজেকে ব্যস্ত রাখি, মানসিক জোরে শারীরিক কষ্ট ঢেকে রাখি। আগের মতোই চাকরি করি। রান্নাবান্না করি। নাতি, ছেলে-মেয়ে নিয়ে পারিবারিক হইহল্লায় যোগ দিই। বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, নিজের বাসায় আনন্দ উদ্যাপনের পাশাপাশি দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াই। বাংলাদেশে গেলে সেই আগের মতো প্রিয় শাড়ি পরে কাশফুলের বনে হারিয়ে যাই। জীবন তো একটাই। প্রজাপতি হয়ে তাই উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াই। সৌজন্যে- প্রথম আলো
অনুলিখন: জোহরা শিউলী
Discussion about this post