ইয়োহাই সাসাকাওয়া
বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শেষ রবিবার ‘বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। আমি ২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি অস্পৃশ্যতা ও বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী আবেদন জানিয়ে আসছি। অনেক মানুষ ও সংগঠন তাতে সমর্থন জানিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি যে অতিমারি করোনার প্রেক্ষাপটে সে আহ্বান অতীতের চেয়ে এখন বেশি গুরুত্ব পাবে।
কুষ্ঠ রোগ, যা ‘হ্যানসেন ডিজিস’ নামে পরিচিত ‘মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি’ নামের এক জীবাণুঘটিত দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক রোগ। এ রোগটি বিশেষ করে শরীরের চামড়া ও প্রান্তিক স্নায়ুকে আক্রমণ করে। এ রোগ মানব ইতিহাসের একটি প্রাচীনতম রোগ হিসেবেও পরিচিত। গড়ে বছরে পৃথিবীতে দুই লাখ মানুষ এর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে।
বর্তমানে ‘মাল্টিড্রাগ’ থেরাপি বা এমডিটির মাধ্যমে কুষ্ঠরোগের সফল চিকিৎসা পাওয়া যায়। রোগের প্রথম দিকেই যদি তা ধরা পড়ে ও তার চিকিৎসা শুরু করা হয়, তাহলে কোনো জটিলতা তৈরি হওয়ার আগেই তা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। কিন্তু চিকিৎসা গ্রহণ করতে বিলম্ব হলে ক্রমবর্ধমান জটিলতা দেখা দিতে পারে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি স্থায়ী প্রতিবন্ধিতার শিকার হতে পারেন।
বর্তমানে কুষ্ঠ রোগের কারণে পৃথিবীতে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়ে আছে। এই কঠিন বাস্তবতার কারণ হচ্ছে, এ রোগের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মনে ভুল ধারণা এবং কুসংস্কারজনিত ভয়, যার কারণে আজও কুষ্ঠাক্রান্ত ব্যক্তিরা ও এমনকি তাঁদের পরিবার-পরিজন সমাজে অনেক দুঃখদায়ক বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন।
২০০১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কুষ্ঠ রোগ নিরাময় বিষয়ক গুডউইল অ্যাম্বাসাডর পদে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকেই আমি নিজে এ রোগ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো ভালো করে দেখার ও বোঝার জন্য বাংলাদেশসহ প্রায় ১২০টি দেশে ভ্রমণ করেছি। আমার এসব ভ্রমণ থেকে কুষ্ঠ রোগের বিষয়ে আমি যা যা শিখতে পেরেছি তা একটা মোটরসাইকেলের উদাহরণ দিয়ে তুলে ধরতে পারি। মোটরসাইকেলের সামনের চাকাটিকে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসার সঙ্গে তুলনা করা যায়, আর পেছনের চাকাটিকে নিরাময় বা প্রতিরোধের প্রতীকরূপে ধরা যায়। মোটরসাইকেলের উভয় চাকা যদি একসঙ্গে না চলে তাহলে যেমন তা এগোবে না, ঠিক কুষ্ঠমুক্ত সমাজের লক্ষ্যে আমাদের পৌঁছানো সম্ভব হবে না যদি ওই দুটি দিক নিয়ে একযোগে কাজ না করা যায়।
মোটরসাইকেলের সামনের চাকাটির মতো, নতুন নতুন রোগীদের শনাক্ত করার কাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এ রোগের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করণীয় আছে। কিন্তু রোগ সংক্রমণ রোধ করাসহ সব চেষ্টা ব্যাহত হচ্ছে করোনার কারণে। জরিপে দেখা গেছে যে ২০২০ সালে নতুন রোগী শনাক্তের হার আগের তুলনায় ৩৭ শতাংশ কম হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, রোগী শনাক্তের হার বাংলাদেশে ওই বছর ছিল ২০ শতাংশের কম। তার পথে প্রধান বাধা ছিল করোনা।
মোটরসাইকেলের পেছনের চাকার কথায় ফিরে আসা যাক, গত শতকের শেষ দশকের প্রথম দিকে আমি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ে গিয়ে কুষ্ঠ রোগের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মানবাধিকারের প্রসঙ্গটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে যথাসাধ্য কাজ করেছি।
সে চেষ্টার একটা ফল হিসেবে ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ রোধের পক্ষে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তবে তার সফলতা নির্ভর করবে ওই সিদ্ধান্তসংক্রান্ত নীতিমালা ও নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করার ওপর। যাই হোক, করোনা অতিমারির কারণে কুষ্ঠ রোগের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ অনেক স্থানে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার করোনার কারণে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত অনেক মানুষ ও তাদের পরিবারের লোকদের আগের চেয়ে বেশি বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার হতে হয়েছে।
এ কারণেই আমি গত আগস্ট মাস থেকে ‘কুষ্ঠ রোগকে ভুলে যাবেন না’ শীর্ষক এক ক্যাম্পেইন শুরু করেছি। উদ্দেশ্য একটাই, করোনার আক্রমণ থাকলেও কুষ্ঠ রোগ ও তার শিকার কোনো মানুষ যেন অবহেলিত না থাকে। যত দ্রুত সম্ভব কুষ্ঠ রোগীদের শনাক্ত করা ও সঙ্গে সঙ্গে তাদের সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং এ রোগের কারণে কোনো মানুষ যেন অস্পৃশ্যতা ও বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করা।
‘ভুলে যাবেন না’—এ কথাটির ভেতরে অনেক বিষয় নিহিত আছে।
কুষ্ঠ রোগ এখনো আছে। এ রোগের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা অস্পৃশ্যতা ও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তদের সুচিকিৎসা ও আনুষঙ্গিক সেবাদানের জন্য পেশাদারি স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, যাঁরা নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও ভুক্তভোগীদের প্রয়োজনীয় সেবাদানের জন্য যথাসাধ্য কাজ করে যাচ্ছেন।
আমার গভীর প্রত্যাশা আছে যে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ আমাদের এই অভিযানে শামিল হবে। তাদের নিজ নিজ অবস্থান ও অভিজ্ঞতা থেকে সোচ্চার হয়ে বলবে, কেন কুষ্ঠকে ভুলে থাকা যাবে না। আমরা যে যেখানে থাকি না কেন, আমাদের ব্যক্তিগত কথা হয়তো সব জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি, কিন্তু আমাদের সবার মিলিত কণ্ঠস্বর সর্বত্র পৌঁছে দেবে কুষ্ঠমুক্ত এক পৃথিবীর স্বপ্নের কথা!
বিগত অর্ধশত বছর আমাদের কুষ্ঠমুক্ত এক পৃথিবীর বেশ কাছে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখনো আমাদের করার আরো বাকি আছে। আমরা যদি এ কাজে আরো এগিয়ে যেতে চাই, তাহলে আমাদের দরকার হবে ‘কুষ্ঠকে ভুলে যাবেন না’র অভিযানে সব মানুষকে সম্পৃক্ত করা, যাতে তারা নিজ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে কুষ্ঠ ও তার আক্রমণের শিকার মানুষের পক্ষে কথা বলা ও কাজ করার জন্য এগিয়ে আসার তাগিদ অনুভব করবে। এ বিষয়ে কোনো অবহেলার সুযোগ আর নেই।
আমাদের ব্যক্তিগত কথা ও চিন্তা সব জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি, তবে আমাদের সবার মিলিত কণ্ঠস্বর সর্বত্রই পৌঁছে যাবে। তাই সবার কাছে আমার প্রাণের প্রত্যাশা, আপনারা আমাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলান।
লেখক : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুডউইল অ্যাম্বাসাডর ফর লেপ্রসি ইলিমিনেশন, জাপানিজ গভর্নমেন্ট গুডউইল অ্যাম্বাসাডর ফর হিউম্যান রাইটস অব পার্সন্স এফেক্টেড বাই লেপ্রসি, চেয়ারম্যান, নিপ্পন ফাউন্ডেশন
মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ : রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী, সাবেক বিভাগীয় পরিচালক, লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ
Discussion about this post