শিশির মোড়ল
দেশে করোনার টিকাদানের গতি আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। চলতি মাসে ৩ কোটি ২৭ লাখের বেশি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ এখন টিকাদানের আওতা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন বয়সী ও পেশাজীবী গোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে কাজ করছে তারা। পাঁচ বছর বয়সীদেরও টিকা দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২২ সালের জুনের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনতে সদস্যদেশগুলোকে উদ্যোগ নিতে বলেছে। এর জন্য টিকাপ্রাপ্তি যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি সংগৃহীত টিকা পরিকল্পিতভাবে প্রয়োগও করতে হবে।
টিকার আলোচনায় পাঁচ বছর বয়সীদের টিকাদানের বিষয়টি এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ নিবন্ধন ও মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এবং যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের করোনার টিকা দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। এর অর্থ দেশ দুটির পাঁচ বছরের বেশি বয়সী সব মানুষ করোনার টিকার আওতায় আসবে।
টিকাদান পরিস্থিতি : এ পর্যন্ত টিকা এসেছে ২৪ কোটি ৮৯ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছেন : প্রথম ডোজ ৫৫.৮%, দ্বিতীয় ডোজ ৩৫.০%
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দিলে বাংলাদেশও করোনার টিকা দেওয়ার বয়সসীমা পাঁচ বছরে নামাবে। সেই প্রস্তুতিও তাঁরা নিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনার টিকা প্রয়োগবিষয়ক কমিটির সভাপতি মীরজাদী সেব্রিনা গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের টিকা দেওয়া শুরু করি। তারা ফাইজারের টিকার সুপারিশ করেছিল। আমরাও সেই টিকা দিচ্ছি। ৫ থেকে ১১ বছরের শিশুদের টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে আমরা তা বাস্তবায়ন করব।’বিজ্ঞাপন
তবে জনস্বাস্থ্যবিদদের একটি অংশ মনে করে, স্বাস্থ্য বিভাগ কী উদ্দেশ্যে টিকা দিচ্ছে, তা এখনো পরিষ্কার না। টিকাদানের মূল উদ্দেশ্য থাকে রোগ প্রতিরোধ করা। করোনার টিকা কতটা রোগ প্রতিরোধ করতে পারছে, তা এখনো পরিষ্কার না। করোনার টিকা দেওয়ার অন্য উদ্দেশ্য রোগের তীব্রতা থেকে সুরক্ষা দেওয়া। টিকা পাওয়া মানুষের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ও মৃত্যুহার কম।
ওষুধবিজ্ঞানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে করোনায় মৃত্যু বেশি। কম বয়সীদের চেয়ে বেশি বয়সীদের টিকার আওতায় আনলে সুফল বেশি পাওয়া যাবে।
লক্ষ্যমাত্রা ■ চলতি মাসে দৈনিক গড়ে ১১ লাখ ৩০,০০০ ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। ■ টিকাদানের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে এক মাসের মধ্যে ৭০% মানুষ প্রথম ডোজ টিকার আওতায় আসবেন।
টিকাদান ও লক্ষ্যমাত্রা
১ থেকে ২৯ জানুয়ারি স্বাস্থ্য বিভাগ মোট ৩ কোটি ২৭ লাখ ৭৮ হাজার ডোজ টিকা দিয়েছে। অর্থাৎ এ মাসে এখন পর্যন্ত দৈনিক গড়ে ১১ লাখ ৩০ হাজার ডোজ টিকা দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কর্মকর্তারা বলেছেন, টিকাদানের এই গতি কমপক্ষে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আগামী জুন মাসের মধ্যে দেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে, অর্থাৎ ১১ কোটি ৯২ লাখ ২১ হাজার মানুষকে টিকা দিতে হবে।
স্বাস্থ্য বিভাগ ইতিমধ্যে ৯ কোটি ৬৪ লাখ ৮৯ হাজার মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দিয়েছে। ৭০ শতাংশ মানুষকে প্রথম ডোজের আওতায় আনতে আরও ২ কোটি ২৭ লাখ ৩২ হাজার মানুষকে টিকা দিতে হবে। এই জানুয়ারি মাসেই প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ২৭ লাখের বেশি মানুষকে। অর্থাৎ টিকাদানের বর্তমান গতি অব্যাহত থাকলে আগামী এক মাসের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার ৭০ শতাংশ প্রথম ডোজ টিকার আওতায় আসবে।বিজ্ঞাপন
দ্বিতীয় ডোজের ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ পর্যন্ত পূর্ণ দুই ডোজ পেয়েছেন ৬ কোটি ৫ লাখ ৮ হাজার মানুষ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে যা মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ। আর ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর পূর্ণ দুই ডোজের আওতায় আনতে আরও ৫ কোটি ৮৭ লাখ ১২ হাজার ডোজ টিকা দিতে হবে। অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলে আগামী ৫ মাসে ৮ কোটি ১৪ লাখ ৪৪ হাজার ডোজ টিকা দিতে হবে। এটা সম্ভব বলে মনে করছেন ইপিআইয়ের কর্মকর্তারা।
অবশ্য পাঁচ বছর বা তার বেশি বয়সীদের টিকার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হলে লক্ষ্যমাত্রায় পরিবর্তন আসবে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে বাংলাদেশে পাঁচ বছর বা তার বেশি বয়সীদের মোট সংখ্যা ১৫ কোটি ৫৭ লাখ ৮৫ হাজার। এদের দুই ডোজ নিশ্চিত করতে কমপক্ষে ৩১ কোটি ১৫ লাখ টিকার প্রয়োজন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট টিকা এসেছে ২৪ কোটি ৮৯ লাখ ডোজ।
নতুন চ্যালেঞ্জ
স্বাস্থ্য বিভাগ প্রথমে রাজধানীসহ জেলা শহরের নির্ধারিত সরকারি হাসপাতালে ও উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে টিকা দেওয়া শুরু করে। এরপর ১২টি মহানগর ও দেশের সব কটি পৌরসভার ওয়ার্ডে টিকাকেন্দ্র তৈরি করে টিকা দেওয়া শুরু হয়। ইউনিয়ন পর্যায়েও টিকা দেওয়া হয়। সর্বশেষ দেশের ১ লাখ ১০ হাজার ইপিআইয়ের নিয়মিত টিকাকেন্দ্রে টিকা দেওয়া শুরু হয়। ইপিআই কেন্দ্রে এখনো টিকা দেওয়া চলছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।
অবশ্য কেন্দ্রভিত্তিক টিকাদানে গতি কিছুটা কমে এসেছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, কেন্দ্রের আশপাশে যাঁদের টিকা নেওয়ার প্রয়োজন, তাঁরা প্রায় সবাই তা নিয়েছেন। উপজেলা বা ইপিআই কেন্দ্রে টিকার জন্য ভিড় কম হচ্ছে। তাই টিকাদানের আওতা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা বলেছেন, সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যেমন পরিবহন খাতের সবাইকে কীভাবে টিকা দেওয়া যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ১২-১৭ বছর বয়সী স্কুলশিক্ষার্থীরা টিকা পাচ্ছে, কিন্তু একই বয়সী আরও প্রায় এক কোটি শিশু-কিশোরকে টিকা দিতে নতুন পরিকল্পনা করতে হচ্ছে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের টিকা দিতে পৃথক উদ্যোগ নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া বেশ কিছু মানুষ ভাসমান অবস্থায় থাকে। তাদের সংখ্যা, অবস্থান নির্ণয় করে তাদেরও টিকা দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
টিকাদানে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সিলেট বিভাগের চারটি জেলা, অর্থাৎ সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় টিকাদানের হার কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনার টিকা প্রয়োগ কমিটির সদস্যসচিব মো. শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এই বিভাগে টিকাদানের হার বাড়াতে বাড়তি কী উদ্যোগ নেওয়া যায়, তা স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে। সৌজন্যে- প্রথম আলো
Discussion about this post