জাকিয়া আহমেদ
দেশে করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি চলছেই, টানা তৃতীয়দিনের মতো গত ২৪ ঘণ্টায় (২৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত) দৈনিক ১৫ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে, শনাক্তের হারও ৩০ শতাংশের বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন শনাক্ত রোগী ১৫ হাজার ৮০৭ জন। এর আগের দুদিন, অর্থাৎ বুধবার ও মঙ্গলবারে যথাক্রমে ১৫ হাজার ৫২৭ ও ১৬ হাজার ৩৩ জন রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছিল অধিদফতর।
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ৪৯ হাজার ৫৭৯টি, আর পরীক্ষা হয়েছে ৪৯ হাজার ৪২৫টি। দেশে এখন পর্যন্ত করোনার মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১ কোটি ২৩ লাখ ১০ হাজার ৬৭৭টি। এরমধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা হয়েছে ৮৩ লাখ ৮৩ হাজার ৯৮৭টি আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩৯ লাখ ২৬ হাজার ৬৯০টি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের করোনার নমুনা পরীক্ষা করানোর হার বেড়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যত মানুষ টেস্ট করাতে চান, তাদের অনেকে কেবল সরকারি পরীক্ষায় ভোগান্তি আর বেসরকারিতে উচ্চ ফি’র কারণে বিরত থাকছেন। আর যারা বয়স্ক কিংবা অন্য কোনও সমস্যায় পড়ে সরকারিভাবে টেস্ট করাতে বাসায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সুবিধা নিতে চান, তারা তা সময় মতো পাচ্ছেন না। আবার কেউ নমুনা দিতে পারলেও সময় মতো রিপোর্ট পাচ্ছেন না।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র বলছে, আগের যেকোনও সময়ের তুলনায় নমুনা পরীক্ষা বেড়েছে। তাদের বড় একটা অংশই বাসায় ডাকছেন স্যাম্পল কালেকশনের জন্য। কিন্তু তার জন্য যে পরিমাণ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট দরকার, তার অনেক কম জনবল দিয়ে হোম স্যাম্পল সংগ্রহ করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জনবল কম হওয়ার কারণে তাদের একেকজনকে দ্বিগুণ, কখনও তারও বেশি কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু তাতেও দিনের কাজ দিনে শেষ করা যাচ্ছে না। নমুনা সংগ্রহের জন্য অনেক বাসাতেই তারা নির্ধারিত দিনে যেতে পারছেন না। অথচ দেশে এখন প্রায় ২৫ হাজারের মতো মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট বেকার বসে আছেন। তাদের কাজে লাগাতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। গত দুই বছরের মহামারিতে প্রতিবার যখন সংক্রমণের ঢেউ আসে তখন সেটা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এমনিতেই সংকট রয়েছে, সেইসঙ্গে প্রতিটি ল্যাবে একাধিক টেকনোলজিস্ট করোনাতে আক্রান্ত হয়ে যখন আইসোলেশনে যায় তখন সেই সংকটের তীব্রতা হয় ভয়ংকর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে পাঁচ জন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট থাকতে হবে। সে হিসাবে দেশে এখন প্রয়োজন ১ লাখের বেশি টেকনোলজিস্ট। কিন্তু বাংলাদেশ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে টেকনোলজিস্টের পদ রয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৯২০টি, কর্মরত আছেন ৫ হাজার ১৬৫ জন। এরমধ্যে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরেটরি) পদ ২ হাজার ১৮২টি। আর কাজ করছেন ১ হাজার ৪১৭ জন।
দীর্ঘ ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত থাকায় মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের ঘাটতি ছিল। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের বিষয়টি আবার সামনে আসে। করোনার নমুনা সংগ্রহ ও ল্যাবরেটরি বাড়ানোর ফলে সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের দাবি ওঠে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগের নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক ২০২০ সালের ২৯ জুন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের ৮৮৯টি, মেডিকেল টেকনিশিয়ানদের ১ হাজার ৬৫০টি, কার্ডিওগ্রাফার পদে ১৫০ জনসহ মোট ২ হাজার ৬৮৯টি পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
পরে লিখিত পরীক্ষায় ২৩ হাজার ৫২২ জন অংশ নিয়ে উত্তীর্ণের মধ্যে থেকে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় পরের বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেই নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম ও ঘুষের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ২ হাজার ৮০০ পদের সেই নিয়োগ বাতিল করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতর নতুন এক অফিস নির্দেশনায় জানায়, ২০ সেপ্টেম্বরের নির্দেশনার আলোকে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান ও কার্ডিওগ্রাফার পদে চলমান জনবল নিয়োগের কার্যক্রম বাতিল করা হলো। পুনরায় নতুন নিয়োগে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। ইতিপূর্বে যারা আবেদন করেছেন, তাদের নতুনভাবে আবেদনের প্রয়োজন নেই; তারা নতুন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। পরে সে নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল চেয়ে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়।
দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষা হওয়া একাধিক হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগগুলো বলছে, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের অভাবে তারা ঠিকমতো নমুনা পরীক্ষা ও সময় মতো পরীক্ষার রিপোর্ট দেওয়া যাচ্ছে না। যা কিনা এই ঊর্ধ্বগতির সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।
যখন নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কম থাকে তখন অসুবিধা হয় না জানিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কিন্তু যখন এরকম ঊর্ধ্বগতি হয় তখন খুব সমস্যা হয়ে যায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের স্যাম্পল প্রসিডিউর অন্যান্য জায়গার তুলনায় ভিন্ন রকম জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে অনেক স্পট রয়েছে স্যাম্পল কালেকশনের জন্য। যেমন চিকিৎসকদের জন্য, নার্সসহ টেকনোলজিস্টদের জন্য, বহির্বিভাগ, বার্ন ইউনিট, কোভিড এবং নন-কোভিড ইউনিটের মতো পৃথক জায়গায় স্যাম্পল কালেকশনের জন্য টেকনিশিয়ানরা গিয়ে থাকেন।
‘আর বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে একটি জায়গাতেই ৪০ থেকে ৫০টি নমুনা নিতে হয়। কিন্তু একজনের পক্ষে সীমিত সময়ের মধ্যে এত নমুনা নেওয়া আসলেই খুব কঠিন।’
আবার ল্যাবের ভেতরেও চিকিৎসকরা সাংঘাতিক সংকটময় সময় পার করছে মন্তব্য করে ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, ‘স্যাম্পল আনার পর থেকে পুরো প্রসেসিংয়ে চিকিৎসকদের সাহায্য করার মতো টেকনোলজিস্টের খুবই অভাব। তারা নমুনা নেবে নাকি ভেতরে কাজ করবে? এই মুহূর্তে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের ল্যাবে ডেপুটেশন, দিনভিত্তিক চুক্তিসহ বিভিন্নভাবে নিয়োগ করা ১৩ জনের মতো কাজ করছেন, যেখানে এখন দরকার নিদেনপক্ষে ২০ জন। তারাও রোস্টারভিত্তিক কাজ করে। আর যখন কেউ করোনায় আক্রান্ত হন, তিনি আইসোলেশনে চলে যান; তখন পরিস্থিতি আরও সংকটপূর্ণ হয়ে ওঠে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনাকালে ফ্রন্টলাইনারদের মধ্যেও ফ্রন্টলাইনার হচ্ছেন নার্স আর মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টরা। কারণ, তারাই রোগীর সংস্পর্শে বেশি যান। তাই তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে।
তার নিজের ল্যাবে করা ব্যক্তিগত এক গবেষণার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের মধ্যেই আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। অনেকেই একবার থেকে একাধিকবার, এমনকি তৃতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছেন। গত এক সপ্তাহেই আমার ল্যাবে তিন জন টেকনিশিয়ান পজিটিভ হয়েছে, তাদের কাজগুলো কীভাবে হবে, কে করবে?’
‘স্বাভাবিক সময়ে কোনও রকমে কাজ চালিয়ে নেওয়া গেলেও সংক্রমণের যখন ঊর্ধ্বগতি হয়, তখন পরিস্থিতি খুবই সংকটময় আর কঠিন হয়ে পড়ে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একদিকে কাজের চাপ বাড়ে, আরেকদিকে লোক কমে যায়।’
দেশে গত একযুগেরও বেশি সময় ধরে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না জানিয়ে ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘করোনার কারণে সে প্রক্রিয়া শুরু হলেও দুর্নীতির কারণে সেটা বাতিল হয়ে গেল। তবে একটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার। আগে থেকেই সংকট; তার ওপর হাজার হাজার টেকনোলজিস্ট পাস করে বসে আছে, অথচ এই কঠিন সময়ে তাদেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’
বেকার অ্যান্ড প্রাইভেট সার্ভিসেস মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দেশে যেভাবে টেস্ট দরকার এই করোনার সময়ে, সেভাবে কখনোই টেস্ট হয়নি। আর এর একমাত্র কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের অভাব। সংকট আগে থেকে থাকলেও করোনা আসার পর তার প্রয়োজনীয়তা চোখের সামনে আসে। এরপর আমাদের আন্দোলনের কারণে এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ১ হাজার ২০০ পদ তৈরি করা হয়। কিন্তু পরীক্ষাসহ সবকিছুর পর দুর্নীতির কারণে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। অথচ করোনা মোকাবিলা করার জন্যই বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে পদ তৈরি করে, নিয়োগ পরীক্ষা হয়। বলা হয়েছিল দ্রুততম সময়ে পরবর্তীতে আবার সার্কুলার দেওয়া হবে, কিন্তু সেটা এখনও হয়নি। অথচ প্রায় ২৫ হাজার টেকনোলজিস্ট বেকার বসে রয়েছে। তাদের অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে হলেও পরবর্তীতে পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ দেওয়া যায়।
মেডিক্যাল টেকনোলিজস্ট নিয়োগ না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, করোনা মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ দেওয়া হলেও মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ না দেওয়াটা খুবই হতাশার কথা। অথচ তারাই নমুনা পরীক্ষা থেকে শুরু করে ল্যাবের ভেতরেও কাজ করে থাকেন। বর্তমান সময়ে এই সংকট প্রখর হয়ে উঠেছে। হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা করা যাচ্ছে না ঠিকমতো, রিপোর্ট পাচ্ছে না মানুষ। খুব দ্রুত এর সমাধান হওয়া উচিত। সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post