সারোয়ার সুমন
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ‘বি’ পজিটিভ রক্তের গ্রুপের মানুষরা। এর পরপরই রয়েছে ‘ও’ পজিটিভ গ্রুপ। এ হার যথাক্রমে ৩৬ ও ২৯ শতাংশ। এ ছাড়া বাংলাদেশে যারা এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ৭৫ শতাংশই পুরুষ। বাকি ২৫ শতাংশ নারী। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ চিত্র ভিন্ন। করোনা আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ের হার সমান। আক্রান্ত শিশুদের ৮০ শতাংশের বয়স ১০ বছরের নিচে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালসহ সাতটি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের করা এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। ৮ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা এলসেভিয়ারের অন্তর্ভুক্ত এবং ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত সাময়িকী ‘নিউ মাইক্রোবস অ্যান্ড নিউ ইনফেকশন’-এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের এক হাজার ২১ জন রোগীর ওপর গবেষণাটি পরিচালিত হয়। গবেষণার সামগ্রিক তত্ত্বাবধানে ছিল চট্টগ্রামের ডিজিজ বায়োলজি অ্যান্ড মলিকুলার অ্যাপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ। গবেষণার ফলাফল নিয়ে এখন চলছে অধিকতর গবেষণা। পাশাপাশি শিশুদের মাঝে ওমিক্রনের প্রভাব নিয়ে কাজ করছেন গবেষকরা।
কেন বেশি ‘বি’ পজিটিভ:
গবেষকরা জানান, মানব শরীরে রক্তের ধরন নির্ধারিত হয় বংশানুক্রমিকভাবে। মানুষের রক্তের ধরন প্রধানত চারটি- এ, বি, এবি এবং ও। এটি নির্ধারিত হয় পিতামাতা থেকে পাওয়া জিনের মাধ্যমে। গবেষকরা জানান, বাংলাদেশে সব রক্তের গ্রুপের মধ্যেই করোনা আক্রান্ত রোগী পেয়েছেন তারা। তবে সবচেয়ে বেশি রোগী পেয়েছেন বি পজিটিভ এবং ও পজিটিভ গ্রুপের। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা দেখেন, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক এ দুই গ্রুপের রক্ত বহন করছে। এজন্য আক্রান্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে এ দুই গ্রুপের সংখ্যা বেশি। এখন যারা ওমিক্রনে আক্রান্ত হচ্ছেন; তাদের মধ্যেও এ দুই গ্রুপের রক্তধারী বেশি।
ভিন্নতা আছে চীনের:
বাংলাদেশের সঙ্গে ভিন্নতা রয়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চিত্রের। করোনা আক্রান্তদের নিয়ে চীনের করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, চীনের উহানে ‘এ’ গ্রুপের রক্ত বহনকারীরা সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। আবার যারা ‘ও’ গ্রুপের রক্ত বহন করছেন তাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে মেডরেক্সিভ ওয়েবসাইটে। বিজ্ঞানীরা উহান ও শেনজেন হাসপাতালের দুই হাজার রোগীর তথ্য নিয়ে গবেষণাটি করেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, উহানের নাগরিকদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ ‘ও’ গ্রুপের রক্ত বহন করছেন। ৩২ শতাংশ বহন করছে ‘এ’ গ্রুপের রক্ত। ২৫ শতাংশ ‘বি’ গ্রুপের রক্ত বহন করছেন। আর মাত্র ৯ শতাংশ বহন করছেন ‘এবি’ গ্রুপ।
শিশুদের নাকাল করেছে ডেলটা:
গবেষণায় দেখা যায়, করোনা আক্রান্ত ৯৫ ভাগ শিশুর মাঝেই জ্বরের লক্ষণ এবং ৭০ ভাগ শিশুর সর্দি ও কাশি ছিল। চট্টগ্রামে গত বছর জুন থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত শিশুদের নমুনা সিকোয়েন্সিং করে সবার মাঝে ভারতীয় ধরন ডেলটার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। নবজাতক থেকে ১৬ বছর বয়সী কভিড আক্রান্ত শিশুদের এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পরবর্তী জটিলতা বেশি যাদের:
গবেষণায় দেখা গেছে, সংক্রমিত হওয়ার আগে যারা দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ গ্রহণ করছিলেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ-পরবর্তী জটিলতা দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া যাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগ তাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার হার অন্যদের তুলনায় বেশি।
গবেষণায় জানানো হয়, শ্বাসকষ্টের রোগীদের মধ্যে সুস্থ হওয়ার পরও উল্লেখযোগ্য হারে মনোসংযোগ কমে যাওয়া, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা ও বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথা পরিলক্ষিত হয়েছে।
গবেষণা দল:
গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান। তার সঙ্গে রয়েছেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. এইচএম হামিদুল্লাহ মেহেদী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. মুশতাক ইবনে আয়ুব ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডা. ফারহানা আক্তার। গবেষণার তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণের দায়িত্বে ছিলেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. নঈম উদ্দিন হাছান চৌধুরী। গবেষণা তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন রোগতত্ত্ববিদ ডা. ওমর কাইয়ুম, ঢাকা মহানগর হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ডা. সানজিদা হোসেন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ডা. প্রসূন বিশ্বাস এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আবদুর রব মাসুম।
গবেষকরা যা বলেন:
গবেষণার প্রকল্প পরিচালক ড. আদনান মান্নান বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কোনো রক্ত গ্রুপের প্রতি আসক্তি নেই করোনার। যে দেশে যে রক্তের গ্রুপের আধিক্য বেশি, সেখানে তারাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে আমরা এখন অধিকতর গবেষণা করছি। ওমিক্রনের প্রভাব শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের কার শরীরে কেমন হচ্ছে সেটি নিয়েও চলছে গবেষণা। শিগগির এটির ফলাফল জানতে পারব আমরা।’
তিনি বলেন, ‘গবেষণায় ১০ দশমিক ১১ শতাংশ করোনা রোগীর কোনো উপসর্গ পাইনি আমরা। তবে যাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ আছে যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগ তাদের কভিডে আক্রান্ত হওয়ার হার এবং কভিড-পরবর্তী জটিলতার সংখ্যা দুটিই বেশি। আবার করোনা আক্রান্তদের ৯০ ভাগেরই এর আগে সবগুলো টিকা নেওয়া ছিল।’
ডা. এইচএম হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, ‘গত দুই বছরে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে করোনা নিয়ে। কভিড থেকে সুস্থ হওয়ার চার সপ্তাহ পরও আক্রান্তদের এক-চতুর্থাংশের মধ্যে ব্যথা, শারীরিক দুর্বলতা, বিষণ্ণতা ও নিরবচ্ছিন্ন, ঘুম বাধাগ্রস্ত হতে দেখা গেছে। আগে শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগই আক্রান্ত হয়েছে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে। ওমিক্রনের প্রভাব শিশুদের মধ্যে কেমন পড়ছে, এখন গবেষণা হচ্ছে তা নিয়ে।’সৌজন্যে-সমকাল
Discussion about this post