অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ
করোনায় আমাদের সাফল্য ঈর্ষণীয়, চীনের পরেই আমাদের অবস্থান বলে সগর্ব দাবি শোনা গিয়েছে। তাই ওমিক্রনে আমাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই বলে অভিমত জনসমক্ষে ব্যক্ত হচ্ছে এবং দেশের প্রস্তুতিতেও তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। জোরেশোরে চলছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন; সভা সমাবেশ, প্রচার প্রচারণায় মুখরিত অত্যন্ত জনবহুল নগরী নারায়গঞ্জসহ দেশের হাজারো গ্রামীণ জনপদ।
থোড়াই কেয়ারভাবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ইশারাতেও করোনা সংক্রমণে নির্বাচন রোড ম্যাপ দেখা যায়নি। বিপুল ও ব্যাপক পরিসরে চলছে জনসমাগম; হাতে হাতে, বুকে বুক মিলিয়ে চলছে প্রচার, প্রোপাগান্ডা। ধারণা হয়, নির্বাচনী স্লোগানের তোপে উড়ে যাবে করোনা, ওমিক্রন।
শীতের বাজারঘাট দারুণ জমে উঠেছে, গাইবান্ধা শহরজুড়ে দেখলাম থকথকে ক্রেতা ভিড়ভাট্টা। মনে হয়, দেশের সকল মফস্বল জনপদে অনুরূপ লোকাধিক্য। সারারাতে ওয়াজ মাহফিলে মানুষ খড়ের ওমকে শারীরিক নৈকট্যে বহুদিন বাড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনছে ওয়াজ, আওয়াজ তুলছে সমস্বরে। মাস্ক-মুখোশ প্রায় নিষিদ্ধ এইসব জনসমাবেশে।
বিয়েসাদির রমরমা মৌসুম চলছে, কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে তিলধারণের ঠাঁই নেই। খাওয়াদাওয়া হাস্যরসে মৌ মৌ করছে আকাশ বাতাস। প্রতিরোধের ব্যবস্থা তো নয়ই, করোনা সম্বন্ধে আলোচনাও সেখানে আড্ডার উপজীব্য নয়। এসব বাস্তবতায় ও মানুষের সাথে সঙ্গতি রেখে দেশের করোনা প্রতিরোধ কার্যক্রমে তার প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে। অথচ সারাবিশ্বই খাবি খাচ্ছে ওমিক্রনজনিত করোনার রেকর্ড থামাতে।
এযাবৎ সবচেয়ে ছোঁয়াচে কোভিডের ধরন পাল্টিয়ে দিচ্ছে প্রতিরোধের হিসাবনিকাশ। আফ্রিকায় উদ্ভব হয়ে ইউরোপ আমেরিকা দাঁপিয়ে এখন ঝাঁপিয়ে পড়ছে এশিয়া বিশেষত, আমাদের পড়শি ভারতে। জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ভারতের করোনা সংক্রমণ, তার মূল কারণ যে ওমিক্রন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ভারতের করোনা সংক্রমণ, তার মূল কারণ যে ওমিক্রন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ডেল্টার ভারতবধে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা সুখপ্রদ নয়; সুনামি ব্যাপকতায় তা আছড়ে পড়ে বাংলাদেশে।
ডেল্টার ভারতবধে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা সুখপ্রদ নয়; সুনামি ব্যাপকতায় তা আছড়ে পড়ে বাংলাদেশে। বিশেষত, গ্রামীণ মানুষ আক্রান্ত হয়, উপচিয়ে পড়ে মফস্বলের সীমিত সঙ্গতির হাসপাতালগুলো, প্রাণ হারায় বেশুমার অরক্ষিত গ্রামীণ বয়োবৃদ্ধরা। দ্রুত শনাক্ত ও প্রচারে কালক্ষেপণ এবং লকডাউনের মতো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং সীমান্তের অন্যান্য মফস্বল জেলাগুলোতেই সংক্রমণ সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
টিকার সংকটে গ্রামীণ বয়স্ক নিরক্ষর মানুষের অত্যুল্প টিকা গ্রহণের হার প্রথমবারের মতো তাদের বড় করোনার ধাক্কায় নিপতিত করে। মফস্বল সদর হাসপাতালগুলো করোনার ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতার ঘাটতি সেবাদানকারীদের ক্লান্তিকর পর্যায়ে ঠেলে দেয়, আক্রান্তের মৃত্যুও অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেই ধাক্কা সামলাতে আমাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, সারাদেশকে অচল করে ফেলেছিল ডেল্টা; প্রলম্বিত হয়েছিল দীর্ঘদিন অর্গলবন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম।
এবারেও ভারত থেকে ওমিক্রনের অভিযাত্রা ঠেকাতে অদ্যাবধি কোনো ব্যবস্থার কথা শ্রুত হয়নি। বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গে মেঘ দেখা দিলে যেখানে বাংলাদেশে মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে ওমিক্রন সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত সত্ত্বেও রেস্তোরাঁয় খেলে টিকা সনদ বাধ্যতামূলক ধরনের বায়বীয় ঘোষণা ছাড়া তেমন উদ্যোগ গ্রাহ্য হচ্ছে না।
শোনা যাচ্ছে, ওমিক্রনে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের যেকোনো গুজবে কান না দিতে দৃঢ়ভাবে সতর্ক করা হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। করোনা সংক্রমণ কোন পর্যায়ে গেলে দেশে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে চলবে তার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা এখনো জানা গেল না। ঘোষণা শুনে মনে হচ্ছে, জনমানুষকে অধিকতর অপ্রস্তুত অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আমরা অনেক প্রস্তুতি নিয়ে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করি না কেন, সেটা একটা ধাঁধা হয়ে রইলো। আমরা বরাবর পরিকল্পনাহীন ঘোষণার মধ্যে রয়ে গেলাম এবং শেষ পর্যন্ত লকডাউনের দ্বারস্থ হই। কূপমণ্ডূকতা ছেড়ে আমাদের উচিত সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা প্রণয়ন।
অনতিবিলম্বে আমাদের একটি ওমিক্রন আপদকালীন কর্মকৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করে জোরকদমে ঘোড়সওয়ার হওয়া প্রয়োজন। সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ার পর জোড়াতালি পদক্ষেপ নিয়ে শেষ পর্যন্ত লকডাউনে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়।
শিক্ষায় গত দুই বছরে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আবারও শিক্ষা লকডাউনের খড়গে পতিত হলে বিশেষত, গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের আজীবন ক্ষতি হয়ে তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের অর্গলরুদ্ধ হয়ে পড়বে।
ওমিক্রনে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের যেকোনো গুজবে কান না দিতে দৃঢ়ভাবে সতর্ক করা হলো শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।
উটপাখির মতো মরুঝড়ে মুখ গুঁজে না থেকে, ওমিক্রন ঝড় ঠেকাতে বিমানবন্দর, নৌবন্দর, স্থলবন্দরসহ শত শত মাইলে জুড়ে ভারত থেকে অবাধ প্রবেশে যতি টানতে হবে শিগগির। প্রয়োজনে বন্ধ করতে হবে সকল আসা যাওয়া।
টিকার হারে এখনো শুভঙ্করের ফাঁকফোকর অনেক; জোড়াতালিতে টিকা প্রদান ১০ কোটির মাইলফলক ছুঁলেও, প্রাধিকার তালিকায় গ্রামীণ নিম্নবিত্ত বয়োবৃদ্ধ, শিশুদের অনেকই এখনো দুই ডোজ এমনকি এক ডোজের সুরক্ষা বলয়েও ঢোকেনি। তাদের বাদ রেখে গুটিকয়েক শহুরে সুবিধাভোগীদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত মশকরা ধরনের ও বৈষম্যমূলক।
আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে বাদ পড়া ব্যক্তিদের খুঁজে উদ্বুদ্ধ করে টিকা সুরক্ষা কলসির ফুটোফাটা বন্ধ করতে হবে, ক্রমান্বয়ে সকল শিশুকে টিকার আওতায় আনতে হবে। সমাগমের লাগাম টেনে ধরতে হবে; অযুত লক্ষ মানুষে বালিকেলি জলকেলির রাশ টানতে হবে, চোঙা ফুঁকিয়ে জনসমাবেশ বন্ধ করতে হবে, বিয়েসাদির হইহল্লা কমাতে হবে।
মাস্ক নাকে মুখে ওঠাতে হবে; রাজধানী ও অন্যান্য মেট্রোপলিটন ও জেলা-উপজেলা, শহর-বন্দর হাটবাজারে শূন্য সহিষ্ণুতা আনতে হবে। তারপরেও ওমিক্রনের লেলিহান শিখা বিস্তার প্রায় পুরোপুরি ঠেকানো অসম্ভব; একমাত্র ভরসা ওর প্রায় নির্বিষ চরিত্র। সেটা পাল্টিয়ে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করলে আমাদের বড় মাশুল দিতে হতে পারে।
অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ । সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক
Discussion about this post