ডা. সেলিনা সুলতানা
ব্রঙ্কিওলাইটিস হলো একটি সংক্রমণ, যা সাধারণত নিম্ন শ্বসনতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। ফুসফুসের ক্ষুদ্রনালী ব্রংকিউলে ভাইরাসের কারণে প্রদাহ হলে তাকে বলে ব্রঙ্কিওলাইটিস। ব্রঙ্কিওলাইটিস দুই বছরের কম বয়সী শিশুদেরকে বেশি আক্রমণ করে। এ রোগে নাক দিয়ে পানি পড়ার পাশাপাশি কাশি ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
শীতের শুরুতে শিশুর শ্বাসকষ্টের অন্যতম কারণ হয়ে থাকে ব্রঙ্কিওলাইটিস। আগে শিশুদের সব শ্বাসকষ্টকে নিউমোনিয়া বলে ধরে নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হত। আর এটা বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্স বাড়াতে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। ব্রঙ্কিওলাইটিস রোগটি সঠিকভাবে নির্ণয় করে চিকিৎসা দিতে পারলে শিশুদের জন্য ভালো হবে।
এই অসুস্থতা সাধারণত ৩-৫ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যায়। ৭-১০দিনের মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসকষ্টের রেজোলিউশনসহ দেখা যায়। কাশি ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে। কিছুক্ষেত্রে গুরুতর উপসর্গ থাকলে হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
ব্রঙ্কিওলাইটিস সৃষ্টিকারী ভাইরাস সহজেই ছড়িয়ে পড়ে, যখন অসুস্থ কেউ কাশি-হাঁচি বা কথা বলে তখন ড্রপলেট বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কারো ব্যবহৃত জিনিস স্পর্শ করলে যেমন- পাত্র, তোয়ালে বা খেলনা ও তারপর চোখ, নাক বা মুখ স্পর্শ করলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷
ব্রঙ্কিউলাইটিসের প্রধান কারণ হলো রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস। রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শিশুদের শরীরে প্রবেশ করে ও শ্বাসনালির ব্রঙ্কিউলসে প্রদাহ করে। এক্ষেত্রে ৩টি কারণে শ্বাসনালি সরু হয়ে যায়।
এর ফলে শ্বাসনালির দেওয়ালে পানি জমে, শ্বাসনালিতে অনেক শ্লেষ্মা উৎপাদন ও প্রদাহের কারণে শ্বাসনালির মৃত কোষ ঝরে পড়ে। শিশুর ফুসফুসে বাতাস আটকে যায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয়। এই প্রদাহ হুইজি শ্বাস ও ক্রমাগত কাশি সৃষ্টি করে। এক বছরের কম, বিশেষ করে দুই থেকে ছয় মাস বয়সের শিশুরাই প্রধানত আক্রান্ত হয়।
ব্রঙ্কিউলাইটিসের উপসর্গ
সামান্য জ্বর, নাক দিয়ে পানি পড়া, অস্থিরতা, কিছু খেতে না পারা, অবিরাম কান্না, গলা বসে যাওয়া, শিশুর হাসি থেমে যাওয়া, ঘন ঘন শ্বাস নেওয়া, শ্বাসকষ্ট হওয়া ইত্যাদি ব্রঙ্কিউলাইটিসের উপসর্গ। শারীরিক পরীক্ষা করলে দ্রুত শ্বাস হার ৬০-৭০ প্রতি মিনিটে বা এর বেশি পাওয়া যায়। বুকের পাঁজরের নিচের অংশ ডেবে যায়।
ঠোঁট বা হাত-পা নীল হয়ে যায়, শিশুর নাকের কাছে কান পাতলে শ্বাস ফেলার সময় বাঁশির মতো আওয়াজের লক্ষণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বুকে বাঁশির মতো শব্দ ও অনেক সময় চুল বা কাপড়ের ঘর্ষণের শব্দ শোনা যায়। এই শিশুরা ৩-৪ দিনের মধ্যেই সুস্থ হতে থাকে ও শ্বাসকষ্ট, কাশি থাকা সত্ত্বেও হাসতে থাকে।
যেসব শিশু বুকের দুধ খেতে পারেনি, স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, ধূমপানকারী পরিবারের শিশুরা, জন্মগত হৃদ্রোগে আক্রান্ত শিশুরা ব্রঙ্কিওলাইটিসে আক্রান্ত হলে অসুখটি দীর্ঘস্থায়ী হয়। তামাকের ধোঁয়া, ঠান্ডা বাতাস ও বায়ু দূষণকারীর সংস্পর্শ এড়ালে ব্রঙ্কিওলাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
ব্রঙ্কাইটিস ও ব্রঙ্কিওলাইটিস উভয়ই ভাইরাসের কারণে হতে পারে। উভয়ই ফুসফুসের শ্বাসনালীকে প্রভাবিত করে। তবে ব্রঙ্কাইটিস বৃহত্তর শ্বাসনালীকে (ব্রঙ্কি) প্রভাবিত করে। ব্রঙ্কিওলাইটিস ছোট শ্বাসনালীকে আক্রান্ত (ব্রঙ্কিওল) করে। ব্রঙ্কাইটিস সাধারণত বয়স্ক শিশুদের ও প্রাপ্তবয়স্কদের প্রভাবিত করে,আর ব্রঙ্কিওলাইটিস ছোট শিশুদের মধ্যে বেশি সাধারণ।
অনেক ক্লিনিকাল গবেষণায়, ৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের হাঁপানি ব্যতীত অন্যান্য সব শ্বাসজনিত অসুস্থতা যেমন ব্রঙ্কিওলাইটিস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হাঁপানি হলো শ্বাসনালীগুলোর একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ। হাঁপানি সাধারণত বংশগত রোগ।
পারিবারিক ইতিহাস (জেনেটিক কারণ সমূহ) অথবা শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, ধুলা-ময়লা, উৎকট গন্ধ বা স্প্রে, সিগারেট বা অন্যান্য ধোঁয়া, পরাগ বা ফুলের রেণু, পশুপাখির পালক, লোমশ খেলনা, ছত্রাকের স্পোর এর জন্য হাঁপানির আক্রমণ হতে পারে। এভাবেই হাঁপানিকে ব্রঙ্কিওলাইটিস থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব।
ব্রঙ্কিওলাইটিস সনাক্ত ও চিকিৎসা
একজন ফিজিসিয়ান শ্বাসকষ্ট নির্ধারণের জন্য লক্ষণগুলো ও শিশুর বুকের শব্দ শোনার মাধ্যমে ব্রঙ্কিওলাইটিস সনাক্ত করতে পারেন। এভাবে রোগ নির্ণয় না করা গেলে রক্ত বা মূত্র পরীক্ষা, স্পুটাম নমুনা বা আঙ্গুলের মনিটর ব্যবহার করে শিশুর রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরীক্ষা করতে পারে।
সাধারণত ব্রঙ্কিউলাইটিস রোগ নির্ণয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষা বা বুকের এক্স-রে করার প্রয়োজন নেই। তবে পরীক্ষা করলে বুকের এক্স-রে তে ফুসফুসে বাতাস আটকে থাকার আলামত পাওয়া যায়। রক্ত পরীক্ষায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্বেতকণিকার মাত্রা স্বাভাবিক থাকে ও ইএসআর, সিআরপি খুব বেশি বাড়ে না।
শিশু স্বাভাবিক থাকলে, খেতে পারলে, জ্বর বেশি না হলেও শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা না কমে গেলে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করতে হবে। মাথা উঁচু করে রাখতে হবে, বুকের দুধ বা অন্য স্বাভাবিক খাবার দিতে হবে ওপর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। যদি খেতে সমস্যা হয়, শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়, জ্বর বেড়ে যায়, তাহলে হাসপাতালে নিতে হবে।
পালস অক্সিমিটার যন্ত্রের সাহায্যে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা নিরূপণ করা যায়। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯০ থেকে ৯২ শতাংশের নিচে হলে শিশুকে অক্সিজেন দিতে হবে। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫ শতাংশের ওপরে রাখতে হয়। খেতে না পারলে নাকে নল দিয়ে খাওয়াতে হবে অথবা শিরায় স্যালাইন দিতে হয়।
যেহেতু ব্রঙ্কিওলাইটিস সাধারণত একটি ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়, ড্রাগ চিকিৎসা সাধারণত কার্যকর হয় না। হাইপারটোনিক স্যালাইন (জীবাণুমুক্ত লবণের জলের দ্রবণ) নেবুলাইজারে ব্যবহার করে নিঃশ্বাসে নিলে শিশুদের কাশি ও শ্বাসকষ্ট উপশম হতে পারে। নেবুলাইজেশন দিয়ে চিকিৎসা করা বহুদিনের প্রচলিত চিকিৎসা।
সলবিউটামল দিয়ে নেবুলাইজ করলে কিছুসংখ্যক শিশুর উপকার হয়, অনেকের হয় না। তাই উচ্চমাত্রার স্যালাইন দিয়ে নেবুলাইজ করলে বুকের শ্লেষ্মা তরল হয় এবং শিশুর শ্বাসকষ্ট কমাতে সাহায্য করে। এসব চিকিৎসা সত্ত্বেও যদি শিশুর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়, তবে শিশুকে আইসিইউতে ভর্তি করাতে হয়।
যেহেতু ব্রঙ্কিউলাইটিস একটি ভাইরাসজনিত রোগ। তাই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কোনো দরকার নেই। তবে শিশু যদি বেশি অসুস্থ হয়, জ্বর বেশি থাকে, কম বয়সে (২ মাসের মধ্যে) বেশি ঝুঁকি থাকে, তবে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
শিশু যদি খেতে পারে, শ্বাসকষ্ট কমে যায়, অক্সিজেনের প্রয়োজন না হয়, জ্বর না থাকে, শিশুকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই অনেক শিশু বাড়ি যেতে পারে। তবে যেসব শিশুর ঝুঁকি বেশি, যেমন বুকের দুধ খায়নি, সময়ের আগে জন্মগ্রহণ করেছে, রক্তস্বল্পতা থাকলে, জন্মগত হার্টে সমস্যা থাকলে সুস্থ হতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।
অভিভাবকের জন্য বার্তা
ব্রঙ্কিওলাইটিস ছোট্ট শিশুদের ফুসফুসের ভাইরাসজনিত অসুখ, এটি নিউমোনিয়া নয়। আক্রান্ত শিশুরা তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে দ্রুত সুস্থ হয়, যদি ঝুঁকি না থাকে। কিন্তু কাশি থাকতে পারে ২১ দিন পর্যন্ত।
শ্বাসকষ্ট কমে গেলে ও অক্সিজেনের প্রয়োজন না হলে, খেতে পারলে হাসপাতালে থাকার কোন দরকার নেই।
পরবর্তী সময়ে শিশুটি আবারও ব্রঙ্কিউলাইটিসে আক্রান্ত হতে পারে, এমনকি হাঁপানিও হতে পারে। ব্রঙ্কিওলাইটিস সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসকষ্টের কারণ হয় না, তবে এটি আপনার সন্তানের শ্বাসনালীর কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
কিছু কিছু শিশুর এই ক্ষতি ৩-৪ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। যার ফলে ক্রমাগত শ্বাসকষ্ট ও কাশি হয়। নিকটস্থ জিপি বা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে শিশুকে নিয়ে যেতে হবে- যদি শ্বাস নিতে অসুবিধা হয়, অনিয়মিত শ্বাস নেওয়া হয় বা বিশ্রামে দ্রুত শ্বাস নেওয়া হয় ও কাশি বা শ্বাসকষ্টের কারণে খাওয়ানো না গেলে।
ব্রঙ্কিওলাইটিসের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুরুতর নয়, তবে শিশুটি যদি গত ২ বা ৩ টি ফিডের সময় তাদের স্বাভাবিক পরিমাণের অর্ধেকেরও কম গ্রহণ করে, ১২ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে শুকনো ন্যাপি থাকে বা ক্রমাগত উচ্চ তাপমাত্রা ১০২º F বা তার বেশি জ্বর (বা তিন মাসের কম বয়সী শিশুর ১০০.৪º ফারেনহাইট বা তার বেশি জ্বর), অথবা কম জ্বর যা দুই থেকে তিন দিনের বেশি স্থায়ী হয় তাহলে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করা ভালো।
ব্রঙ্কিওলাইটিস প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় হলো শিশুকে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা। শিশুকে অন্যান্য শিশু বা সর্দি-কাশি বা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে দূরে রাখুন, জনাকীর্ণ এলাকা থেকে দূরে থাকুন (যেখানে ভাইরাস সহজেই ছড়াতে পারে), আপনার হাত এবং আপনার সন্তানের হাত ঘন ঘন ধুয়ে নিন ।
জীবনধারা ও ঘরোয়া প্রতিকার
বাতাসকে আর্দ্র করুন, ঘুমানোর সময় শিশুকে আধা-বসা অবস্থায় শুইয়ে দিন, শিশুকে তরল পান করতে দিন, স্যালাইন নাকের ড্রপ ব্যবহার করেন, ধূমপানমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখুন, উষ্ণ গোসল, শিশুকে গরম পানিতে গোসল করাতে পারেন।
ব্রঙ্কিওলাইটিসের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুরুতর নয়। যেসব শিশু প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ খায়, তাদের এ অসুখের ঝুঁকি কম থাকে। এখন পর্যন্ত এর জন্য কোনো প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কার হয়নি। তাই শিশুদের প্রতি বাড়তি যত্ন ও অভিভাবকদের একটু সচেতনতাই শিশুটিকে ব্রংকিওলাইটিস থেকে নিরাপদে রাখতে পারে।
লেখক: কনসালটেন্ট, নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার ও চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল। প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ: ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল।
Discussion about this post