ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক শেখ মোহাম্মদ বাহার হোসেন
শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের (৯৮.৪ ফা) চেয়ে বেড়ে যাওয়া আর বেড়ে থাকা মানে জ্বর। আবালবৃদ্ধবনিতা কেউই এর থেকে রেহাই পেয়েছেন বলে মনে হয় না। এটি খুবই সচরাচর একটি উপসর্গ। জ্বর নিজে কোনো রোগ নয়, রোগের উপসর্গ মাত্র। প্যারাসিটামল খেলে জ্বরের ক্ষণিক উপশম হয়, কিন্তু সেরে যায় না। জ্বরের কারণ জানতে হয় এবং সে মোতাবেক চিকিৎসা নিতে হয়। এ নিয়ে লিখেছেন পরিপাকতন্ত্র ও লিভাররোগ বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক শেখ মোহাম্মদ বাহার হোসেন
একেক রোগের কারণে এক ধরনের জ্বর হয়। তাই জ্বরের ধরনটা জানা আবশ্যক। কোনো কোনো জ্বর অল্প দিনের। আবার কোনোটা অনেক দিনের। কোনো জ্বর সারা দিনই এক নাগাড়ে ভোগাতে থাকে। আবার কোনোটা এখন আছে তো তখন নেই। কোনো জ্বরের সঙ্গে কাঁপুনি হয়, শীত লাগে, তীব্র মাথা ব্যথা ওঠে, বমি হয়, ইদানীংকালের বহুল আলেচিত করোনা জ্বরে কোনো ধরনই নির্দিষ্ট নয়, করোনা অধ্যুষিত এলাকায় বসবাসরত, কিংবা করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসা যে কোনো ধরনের জ্বরই করোনা হতে পারে, তাই এ ধরনের সব জ্বরের রোগীকে টেস্ট করে করোনা নিশ্চিত করতে হয়। ডেঙ্গিতে আবার হাড় কাঁপানো ব্যথা হয়, গায়ে লাল লাল দাগ হয়, অনুচক্রিকা কমে গিয়ে রক্তক্ষরণের মতো জটিল অবস্থা সৃষ্টি করে।
আমাদের দেশে অপরিচিত চিকুনগুনিয়াতে আবার দুই-চার দিন পর জ্বর ছেড়ে গেলেই শুরু হয় প্রচন্ড গিরা ব্যথা। কোনো কোনো জ্বর প্যারাসিটামল ব্যতিরেকে কমানো যায় না, প্যারাসিটামলের কার্যকারিতা শেষ হলেই জ্বর বেড়ে যায়। কিন্তু ম্যালেরিয়া হলে জ্বরনাশক ছাড়াই দৈনিক দু’এক বার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে রোগী ফুরফুরে হয়ে ওঠেন।
টাইফয়েড হলে আবার মইয়ের সিঁড়ির মতো দিনকে দিন লাফিয়ে লাফিয়ে জ্বরটা বাড়তে থাকে। তাই ডাক্তার জ্বরের ধরন ও মাত্রা কখন কত ছিল জানতে চান। এসব রোগীর বাসস্থানের ঘটনা, চিকিৎসকের অজ্ঞাতেই ঘটে। রোগী হিসাবে আপনার অথবা আপনার অভিভাবকের দায়িত্ব হলো জ্বরের সঙ্গে এসব উপসর্গ লক্ষ করা, দৈনিক চার থেকে ছয়বার জ্বরের তাপমাত্রা সঠিকভাবে মেপে চার্ট তৈরি করে রাখা। আমার অনেক খারাপ লাগে, রাতে শীত লাগে, গা গরম লাগে, ঠোঁটে ফোসকা হয়, মুখ তেতো থাকে, এর কোনোটাই জ্বর নির্ণয় বা জ্বর চিকিৎসার সঠিক মাপকাঠি নয়। বিভিন্ন সময়ের সঠিক তাপমাত্রাই বলে দেয় ওই জ্বরের কারণ কী?
জ্বর মাপা কখনই কঠিন কোনো কাজ নয়। ১৫-২০ টাকা দামের একটি থার্মোমিটার কেনার সময় দোকানিই আপনাকে জ্বর মাপার পদ্ধতিটা দেখিয়ে দেন। থার্মোমিটার ঝাঁকিয়ে পারদের অবস্থান শূন্যতে নামাবেন। বগলের নিচে অথবা জিহ্বার নিচে এক মিনিট রেখে দিলে দাগাঙ্কিত স্থানে পারদের অবস্থানই রোগীর তাপমাত্রা নির্ণয় করে দেয়। আজকাল অবশ্য ডিজিটাল থার্মোমিটার তাপমাত্রার লিখিত নির্দেশ দেয়। অবশ্যই তারিখ ও সময় উল্লেখ করে জ্বরের চার্ট তৈরি করে রাখবেন।
জ্বর সাধারণত রোগীর শরীরে জীবাণু আক্রমণের ফলে প্রদাহের বার্তা প্রকাশ করে। মস্তিষ্কের পর্দায় প্রদাহ হলে মাথাব্যথা, ঘাড় শক্ত হওয়া, খিঁচুনি থেকে শুরু করে রোগী বেহুঁশও হয়ে যেতে পারেন। নাকে বা সাইনাসে প্রদাহ হলে। সর্দি হলে মাথা, কপালে বা নাকের পাশে ব্যথা হবে। টনসিলে প্রদাহ হলে গলাব্যথা হয়, ঢোক গিলতে কষ্ট হয়। নিউমোনিয়া হলে বুকেব্যথা হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হয়। প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হলে বুঝতে হবে মূত্রতন্ত্রে প্রদাহ হয়েছে। আর পাতলা পায়খানা মানে অন্ত্রে প্রদাহ। তাছাড়া রক্তে জীবাণু গেলে পুরো শরীর কিংবা সিস্টেমকেই বিকল করে দেবে। জ্বর নিত্য উপসর্গ হলেও তা কোনো এক ধরনের জীবাণু যে কোনো অঙ্গ বা সব অঙ্গে আক্রমণের ফলশ্রুতি। অনেক বিরল কারণেও জ্বর হয়, যেমন বাত, অ্যালার্জি, ওষুধের প্রতিক্রিয়া এমনকি ক্যানসারজনিত কারণেও মানুষের দেহে জ্বর হতে পারে। এক কথায় বলা যায়, একই অঙ্গে এতরূপ। তাই জ্বরের চিকিৎসা সতর্কতার সঙ্গে ধীরস্থির মেজাজে করতে হয়।
রোগী বা তার অভিভাবক জ্বরের ধরন এবং অন্য উপসর্গগুলোর পর্যবেক্ষণ করে তার চিকিৎসককে জানাবেন। জ্বরের কারণের চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ হলেও জ্বরটা স্বাভাবিক মাত্রায় রাখা আরও গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য জ্বরনাশক প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাবেন, মাথা ধুয়ে দেবেন, জল পট্টি দেবেন। মনে রাখবেন, ডেঙ্গিজ্বরের এ সময়ে জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ নিরাপদ নয়।
লেখক : কনসালটেন্ট, স্কয়ার হসপিটাল, ঢাকা।
Discussion about this post