হার্টবিট ডেস্ক
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ (NIH of US) এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী মহিলাদের ক্ষেত্রে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার তালিকায় চতুর্থ প্রধান কারণ হলো (Cervical cancer) যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত।বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে এক জন নারী এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। অথচ এর প্রতিরোধ করা সম্ভব একটু সচেতন হলেই।
জরায়ুর ক্যান্সার কি? (What is cervical cancer?)
চলুন জরায়ু ক্যান্সার সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে জরায়ু সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানা যাক। জরায়ু (Uterus) মহিলাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা তলপেটে অবস্থান করে। জরায়ুর প্রধান কাজ হলো গর্ভকালীন সময়ে ভ্রূণের (Fetus) সংরক্ষণ এবং বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। জরায়ু উল্টানো নাশপাতি আকৃতির (Inverted Pear) মত একটি অঙ্গ যার তিনটি প্রধান অংশ রয়েছে। যেমন:
- Fundus: সবচেয়ে উপরের অংশ
- Body: জরায়ুর প্রধান অংশ এবং এই অংশে জরায়ু গহ্বর অন্তর্ভুক্ত
- Cervix: জরায়ুর নিচের সরু অংশ যাকে জরায়ু মুখ বলা হয়ে থাকে
জরায়ুর যে অংশে সবচেয়ে বেশি ক্যান্সার সংক্রমণ হয়ে থাকে তা হলো জরায়ু মুখ (Cervix) যাকে মেডিকেলের ভাষায় সার্ভিকাল ক্যান্সার (Cervical cancer) বলা হয়। তবে যেহেতু জরায়ু মুখ জরায়ুরই একটি অংশ তাই সাধারণ মানুষ সার্ভিকাল ক্যান্সারকেই জরায়ু ক্যান্সার নামে চিনে থাকেন। আর তাই এই অনুচ্ছেদে জরায়ু ক্যান্সার বলতে জরায়ু মুখের ক্যান্সার বা সার্ভিকাল ক্যান্সারকে বোঝানো হয়েছে।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার হওয়ার কারণ
জরায়ু মুখের ক্যান্সার হওয়ার রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো কী?
জরায়ু ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ হলো HPV (Human Papillomavirus) এর সংক্রমণ। HPV ভাইরাসের সংক্রমণ নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই হতে পারে অর্থাৎ, নারী থেকে পুরুষ এবং পুরুষ থেকে নারীতে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। তবে HPV এর সংক্রমণ হলেই তা জরায়ুর ক্যান্সার বলে বিবেচিত নয় কারণ HPV এর অনেক গুলো প্রকরণ রয়েছে যার মধ্যে মাত্র দুইটি প্রকরণ (HPV-16 & HPV-18) জরায়ু ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। HPV এর সংক্রমণের সাথে সাথে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব এবং অন্যান্য আরো কিছু বিষয় (Risks factors) রয়েছে যা জরায়ু ক্যান্সারের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়। যেমন:
১) অল্প বয়সে বিয়ে করা
২) অল্প বয়সে বাচ্চা নেয়া
৩) কোন ব্যক্তির পূর্বের স্ত্রীর এই রোগ হয়ে থাকলে, তার সাথে যৌন মিলন করা
৪) একাধিক ব্যক্তির সাথে যৌন মিলন করা
৫) ঘন ঘন বা অধিক বাচ্চা নেয়া
৬) খাবার বড়ি ব্যবহার করা
৭) ইনফেকশন – এইচ.আই.ভি. , হিউম্যান পেপিলমা , ক্লামাইডিয়া ভাইরাসে ইনফেকশন
৮)অতিরিক্ত ওজন (Obesity)
৯)ধুমপানের অভ্যাস (Smoking)
সাধারণত HPV সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে যৌন সঙ্গম (Sexual intercourse) করার মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। তবে সংক্রমণের ফলে উদ্ভূত সমস্যা বা উপসর্গ দেখা দিতে ক্ষেত্রবিশেষে কয়েক মাস থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। এই ভাইরাসের সংক্রমণে Cervical cancer ছাড়াও আরো যে সমস্ত রোগ হতে পারে তা হলো যৌনাঙ্গে আঁচিল, পায়ুপথের ক্যান্সার ইত্যাদি।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধ
১০ বছরের পর থেকেই জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রতিরোধক ভ্যাক্সিন নেওয়া যায়। একবার ক্যান্সার হয়ে গেলে ভ্যাক্সিন কোন কাজে আসে না। তিনটি ডোজ আছে। প্রথমটির এক মাস পরে দ্বিতীয় টিকা এবং তারও পাঁচ অর্থাৎ প্রথমটির ছয় মাস পরে তৃতীয় ডোজের টিকাটি নিতে হবে। ভ্যাক্সিন যে এই ক্যান্সারকে ১০০% ঠেকিয়ে রাখতে পারেনা তা ইতোমধ্যে বলেছি। কিন্তু রেগুলার চেক-আপে, pap smear নামে একটি টেস্ট আছে, আপনার জরায়ু মুখে ক্যান্সার জনিত কোন পরিবর্তন হলে ডিটেক্ট করা সম্ভব।
এটি একটি স্ক্রিনিং টেস্ট। প্রতি ৩-৫ বছরে একবার করানো ভালো। ২১ বছরের পর থেকেই করা যায়। ৪০ বছরের পর থেকে নিয়মিত করা উচিত, ৫০ এর পর থেকে বছরে একবার করালে আরও ভালো। ভ্যাক্সিন দেয়া থাকলেও টেস্ট করাতে হবে। উন্নত বিশ্বে এর ব্যবহার অনেক বেশি। আগেই কোষে ক্যান্সার হবার মত পরিবর্তন ধরা পড়ে গেলে লেজার এব্লেশন, ক্রায়ো থেরাপি সহ আরও চিকিৎসার মাধ্যমে এটি প্রতিকার করা যায় আর ক্যান্সার হলে কী করতে হবে আলাদা ভাবে নিচে উল্লেখ করা আছে।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার হওয়ার লক্ষণসমুহ
Early stage এ কোন লক্ষণ সাধারণত থাকেই না। এই রোগের উল্লেখযোগ্য লক্ষণ গুলো হচ্ছে –
১) যোনিপথে রক্তপাত, সহবাসের সময় রক্ত পাত বা কন্টাক্ট -এ অর্থাৎ কোন কিছুর স্পর্শে রক্তপাত
২) যোনিপথে দুর্গন্ধযুক্ত নিঃসরণ
রোগটি মেটাস্টেসিসের মাধ্যমে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে। Advanced stage- এ পেট , ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে এর লক্ষণ আরও বেশি প্রকাশ পায়, যেমন –
৩) ওজন কমে যাওয়া, ক্ষুধা মন্দা, শরীর অবসন্ন লাগা
৪) কাশি, কাশিতে রক্ত আসা
৫) ডায়রিয়া, পায়খানার সাথে রক্ত আসা , প্রস্রাবে জ্বালা পোড়া , ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
৬) রক্ত শূন্যতায় ভোগা
৭) পিঠে ব্যথা, তলপেটে ব্যথা, পায়ে ব্যথা ও পা ফুলে যাওয়া
জরায়ু মুখের ক্যান্সার ও বাংলাদেশ
২০১০ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর জরায়ু মুখ ক্যান্সারে নতুন করে আক্রান্ত হন ১৩০০০ নারী এবং মারা যান ৬৬০০ জন। সংখ্যাটি নেহায়েত কম নয়। আর দিনের হিসাবে সংখ্যাটিও চমকে দেয়ার মত, গড়ে ১৮ জন। সরকার ভ্যাক্সিন প্রয়োগের জন্য সমাজ সচেতনতা মূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। আশা করা যায় ২০২০ এর মধ্যে জরায়ু মুখ ক্যান্সারে মৃত্যুর হার কমে আসবে।
জরায়ু মুখের ক্যান্সার হলে চিকিৎসা কি?
স্টেজ এর উপর ভিত্তি করে একেক স্টেজে একেক চিকিৎসা দেয়া হয়। সার্জারি, রেডিও এবং কেমোথেরাপি এই তিন ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়। সাধারণ কিছু চিকিৎসা মূল চিকিৎসার পাশাপাশি দেয়া হয়। লক্ষণের উপর নির্ভর করে ব্যথানাশক, এন্টিবায়োটিক, ব্লাড ট্রান্সফিউশন ইত্যাদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সার্জারির মধ্যে wertheim’s radical hysterectomy, pelvic exenteration উল্লেখযোগ্য। First এবং second stage -এ সার্জারি করা হয়। Advanced হয়ে গেলে সার্জারি করে লাভ হয় না কারণ ক্যান্সারের বীজ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সব স্টেজেই রেডিও থেরাপি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সার্জারি করার অনেক আগেই রেডিওথেরাপি দিয়ে এর সাইজ কমিয়ে আনা হয়। কেমোথেরাপি ডাক্তার প্রয়োজন বুঝে দিয়ে থাকেন। অপারেশনের পরে নিয়মিত ফলো আপ জরুরী। ৩ মাস অন্তর প্রথম ১ বছর, ছয় মাস অন্তর পরের ১ বছর ও এরপর এক বছর অন্তর অন্তর ফলো আপ করাতে হবে।
জরায়ু একজন নারীর শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা তাকে মা হতে সহায়তা করে। আর তাই একজন মায়ের জরায়ু স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জরায়ু ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা গ্রহণের সক্ষমতা সবার মাঝে নেই। আর তাই প্রচেষ্টা রাখতে হবে যেনো জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হয়।
Discussion about this post