হার্টবিট ডেস্ক
বিশ্বে গড়ে প্রতি ৭০০ জনের মধ্যে অন্তত একজন শিশু ঠোঁট-তালু কাটার সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সে হিসেবে প্রতিদিন ৫৪০ জন ও বছরে প্রায় এক লাখ ৯৭ হাজার ১০০ জনেরও বেশি ঠোঁট কাটা ও তালু ফাটা শিশু জন্মায়। ঠোঁট কাটা ও তালু ফাটা এক ধরনের জন্মগত ত্রুটি। যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ওরোফেসিয়াল ক্লেফটস।
এমন শিশুদের জন্য দেবদূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন একজন ভারতীয় প্লাস্টিক সার্জন। যিনি এ পর্যন্ত ৩৭ হাজার ঠোঁট-তালু কাটা শিশুদেরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনেছেন সার্জারির মাধ্যমে। বর্তমানে একজন জনপ্রিয় প্লাস্টিক সার্জন হিসেবে নাম গড়েছেন তিনি।
সিডিসি’র তথ্য মতে, ঠোঁট-তালু কাটা হলো এক ধরনের জন্মগত ত্রুটি। যা গর্ভাবস্থায় শিশুর ঠোঁট বা মুখ সঠিকভাবে তৈরি না হলে ঘটে। এই ত্রুটির কারণে শিশুর স্বাভাবিক জীবনে প্রভাব পড়ে। এমনকি শিশু বড় হয়েও বৈষম্যের শিকার হতে পারে।
তবে উন্নত বিশ্বে এখন প্লাস্টিক সার্জারির সাহায্যে এই জন্মগত ত্রুটির সংশোধন করা সম্ভব। তবে ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক পরিবারই সার্জারি করাতে পারেন না। এমন পরিবারের জন্য দেবদূত হয়ে বর্তমানে অনেক চিকিৎসকরাই বিনামূল্যে দরিদ্র শিশুদের সার্জারি করছেন।
তাদের মধ্যে ডা. সুবোধ কুমার সিং একজন। ভারতের উত্তর প্রদেশের বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন এই চিকিৎসক। শৈশবে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েও এগিয়ে গিয়েছেন সুবোধ। এ কারণে বরাবরই তার ইচ্ছে ছিলো আর্থিকভাবে লাভবান না হয়ে বরং তিনি অভাবী লোকদের সাহায্য করবেন।
তার বাবা ছিলেন একজন রেলওয়ে ক্লার্ক। তিনি মারা যাওয়ার পর সুবোধ মাত্র ১৩ বছর বয়সে কাজ করা শুরু করেন। সুবোধ ও তার বড় ৩ ভাই রাস্তায় ও স্থানীয় দোকানে ঘরে তৈরি মোমবাতি, সাবান ও গগলস বিক্রি করে উপার্জন করতেন। এতেই চলতো তাদের সংসার।
সুবোধের ভাইয়েরা অর্থ উপার্জনের চাপে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে সুবোধের পড়ালেখা বন্ধ করেননি তারা। স্বপ্ন দেখতেন তাদের ছোট ভাই একদিন বড় ডাক্তার হবেন।
পড়ালেখার ফাঁকে বেশ কয়েকটি চাকরিও করেন সুবোধ। তিনি ভারতের ‘ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস’ থেকে সাধারণ অস্ত্রোপচার বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন ও প্লাস্টিক সার্জারিতে বিশেষীকরণ করেন।
ডা. সুবোধ সিং বেটার ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ছোট থেকেই অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছি আমি। দরিদ্রদের দুঃখ-কষ্টগুলো বুঝতে পারি। কারণ আমিও তাদের মতোই। যেহেতু চিকিৎসক হিসেবে আমার সুযোগ আছে দরিদ্রদের সাহায্য করার, তাই আমি এ সুযোগ কখনো হাতছাড়া করিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এমন অনেক দরিদ্র পরিবারে ঠোঁট ও তালু কাটা শিশুর জন্ম হয়, যারা সার্জারি করাতে পারেন না শিশুকে। একজন প্লাস্টিক সার্জন হিসেবে আমার দায়িত্ব বিনামূল্যে এসব শিশুর সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।’
‘এই শিশুরা প্রয়োজন অনুযায়ী দুধ খেতে পারে না। অনেকে অপুষ্টির কারণে মারা যায়। অনেকের বিকাশ ঘটে না সঠিকভাবে। এমন শিশুদের কথা বলার জন্য জিহ্বা ব্যবহার করতে অসুবিধা হয়, ফলে কথা বলতে সমস্যা হয়।’
‘বৈষম্যের কারণে অনেক শিশুরা স্কুল ছেড়ে দেয়। চাকরিতেও তারা থাকে পিছিয়ে। অনেক পরিবার এমন শিশু জন্মানোর পেছনে নারীকে দোষারোপ করে। এমন পিতামাতাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এসব সমস্যার সমাধান দিতে পারে সার্জারি।’ বলে জানান ডা. সুবোধ।
২০০৪ সালে এই চিকিৎসক তার স্বনামধন্য যাত্রা শুরু করার পর থেকে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ৩৭ হাজার ঠোঁট ও তালু কাটা রোগীকে বিনামূল্যে সার্জারি করেছেন। এই জন্মগত ত্রুটি সংশোধন করতে ভারতজুড়ে আরও কয়েক ডজন ডাক্তারকে প্রশিক্ষণও দিয়েছেন এই চিকিৎসক।
তিনি আশা করছেন, একদিন ঠোঁট ও তালু কাটা সার্জারি সংশোধনের জন্য একটি জাতীয় কেন্দ্র স্থাপন করতে সক্ষম হবেন। ‘আমি অনেকের জীবন পরিবর্তন করার ক্ষমতা পেয়ে গর্বিত বোধ করছি। একটি অস্ত্রোপচার একাধিক পরিবার ও একজন ব্যক্তির জীবনকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।’
ডা. সুবোধের এই মহৎ কর্মকাণ্ড স্মরণ করিয়ে দেয় নেপালি চোখের ডাক্তার সান্দুক রুইতের কথা। যাকে দৃষ্টির ঈশ্বর বলা হয়। তিনি নিজ হাতে দুই মহাদেশেরএক লাখেরও বেশি মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন।
Discussion about this post