ডা. মাহবুবর রহমান
হৃদরোগের সঙ্গে ডায়াবেটিসের দারুণ মৈত্রী! ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁঁকি ডায়াবেটিস নেই এমন ব্যক্তির চেয়ে তিন গুণ বেশি। এজন্য ডায়াবেটিসকে বলা হয় কার্ডিওভাসকুলার মেটাবলিক ডিজিজ। অর্থাৎ এটি এমন একটি রোগ যা হার্টসহ শরীরের সব রক্তনালিকে আক্রান্ত করে।
রক্তনালি আক্রান্ত হলে সমস্যা কী?
শরীরের যে কোনো কোষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন অক্সিজেন ও খাবার। অক্সিজেনের উপস্থিতিতে খাদ্য পুড়ে শক্তি উৎপন্ন হয়, যা দিয়ে আমরা চলাফেরা করি, বিশেষ বিশেষ প্রোটিন তৈরি হয় যা দিয়ে মাংসপেশি, বিভিন্ন হরমোন ও হজমরস সৃষ্টি হয়, এমনকি চিন্তা করার জন্য যে নিউরোট্রান্সমিটার লাগে তাও এভাবে তৈরি হয়।
এ অক্সিজেন ও খাবার প্রতিটি কোষে পৌঁছে যায় রক্তনালির মাধ্যমে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রক্তনালির দেয়াল ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যায়, স্বাভাবিক প্রসারণ-সংকোচন ক্ষমতা হ্রাস পায়। তবে রক্তের ভিতরে যদি অতিরিক্ত গ্লুকোজ, চর্বি ভেসে বেড়ায় তাহলে এক ধরনের প্রদাহ শুরু হয়। এ প্রদাহের ফলে রক্তনালির দেয়ালে চর্বির দলা জমতে থাকে। ডায়াবেটিস এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। খারাপ ব্যাপার হলো যে, এ প্রক্রিয়া দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন- হার্ট, ব্রেন, কিডনি, চোখ ইত্যাদিকে বেশি আক্রান্ত করে। চর্বির দলা ক্রমে বড় হতে থাকে এবং প্রদাহ চলতে থাকে। ফলে চর্বির দলার আবরণ ধীরে ধীরে পাতলা হতে থাকে এবং তা যে কোনো সময় ফেটে যেতে পারে।
চর্বির দলা ফেটে গেলে কী হয়?
কোনো কারণে শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এটি সামান্য হলে কিছুক্ষণ পর শরীর নিজেই রক্ত জমাট বাঁধিয়ে ক্ষরণ বন্ধ করে দেয়। রক্ত জমাট বাঁধতে অণুচক্রিকা বা প্লেটলেট এবং সুতার মতো ফিব্রিন মূল ভূমিকা পালন করে। রক্ত জমাট বাঁধার এটি হলো ভালো দিক। কিন্তু বিষয়টি যদি শরীরের অভ্যন্তরে কোনো অঙ্গ যেমন হার্টের ক্ষেত্রে ঘটে? তাহলে একটি রক্তনালির ভিতরে রক্তের দলা জমাট বেঁধে নালিটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে। তাহলে হার্টের যে অংশটুকু ওই নালির মাধ্যমে অক্সিজেন ও খাবার পেত তা বন্ধ হয়ে যাবে। এবং বন্ধ রক্তনালির ব্লকটি যদি ১২ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ করা না হয় তাহলে ওই অংশটুকু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
চর্বির দলা কি হঠাৎ ফেটে যায়?
না, সব দলা হঠাৎ ফেটে যায় না। যেসব দলার আবরণ প্রদাহের ফলে পাতলা হয়ে পড়ে সেগুলোই হঠাৎ ফেটে যায়। এবং হঠাৎ প্রকট হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেন স্ট্রোক হয়। আর যেসব দলার আবরণ পুরু সেগুলো অপেক্ষাকৃত স্থির ব্লক। এগুলো সহজে ফেটে না। তবে ধীরে ধীরে দলার আকার-আকৃতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। বাড়তে বাড়তে যখন রক্তনালির ৭০% সরু হয়ে পড়ে তখন বুকে ব্যথা, জ্বালাপোড়া বা শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ধীরে ধীরে আক্রান্ত অঙ্গটির কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। হার্টের ক্ষেত্রে পাম্পিং ক্ষমতা কমতে থাকে, ব্রেনের ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়, কিডনির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি রেনাল ফেইলুর এবং চোখের ক্ষেত্রে রেটিনা নষ্ট হয়ে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে থাকে।
ডায়াবেটিসের মুখ্য ভূমিকা
এই যে, চর্বির দলা জন্ম নেওয়া, বড় হওয়া এবং ফেটে পড়া- এগুলোর পেছনে ডায়াবেটিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অতিরিক্ত সুগার পর্যাপ্ত ইনসুলিনের অভাবে ব্যবহৃত হতে পারে না। ফলে শরীর বিকল্প জ্বালানি হিসেবে শরীরের চর্বি ব্যবহার করে। চর্বির চালান অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায় এবং অক্সিডাইজড চর্বি রক্তনালির গায়ে জমে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এভাবে পুরো শরীরে রক্তনালির দেয়ালে বিন্দু বিন্দু চর্বির দলা জমতে থাকে। এজন্য ডায়াবেটিসকে কার্ডিওভাসকুলার মেটাবলিক ডিজিজ বলা হয়।
ডায়াবেটিসের লক্ষণ
রক্তে প্রচুর পরিমাণে সুগার ভাসতে থাকায় তা প্রস্রাব দিয়ে বের হয়ে আসে। ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। ফলে শরীরে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হয়। যে কারণে রোগী তৃষ্ণা বোধ করে। ঘন ঘন পানি খায়। শরীর তার বিকল্প জ্বালানি হিসেবে শরীরে জমে থাকা ফ্যাট ভেঙে ফেলে। ফলে দ্রুত ওজন কমে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে ত্বকে, গলায়, ফুসফুসে এবং প্রস্রাবে জীবাণুর আক্রমণ ঘটে। ইনফেকশন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সময়মতো চিকিৎসা না করলে জীবন বিপন্ন হতে পারে।
ডায়াবেটিস কীভাবে নির্ণয় করবেন?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী নিচের যে কোনো একটি উপাদান পেলে তাকে ডায়াবেটিস হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে :
১। খালি পেটে (৮-১০ ঘণ্টা অভুক্ত থেকে) রক্তের গ্লুুকোজ যদি ৭ মিলিমোল/লিটার বা তার বেশি হয়।
২। নাস্তা খাওয়ার বা ৭৫ গ্রাম গ্লুুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর রক্তের গ্লুুকোজ যদি ১১.১ মিলিমোল বা তার বেশি হয়।
৩। ওপরে উল্লিখিত লক্ষণের উপস্থিতিতে দিনের যে কোনো সময় রক্তের গ্লুকোজ যদি ১১.১ মিলিমোল বা তার বেশি পাওয়া যায়।
৪। রক্তে তিন মাসের গ্লাইকেটেট হিমোগ্লোবিন যদি ৬.৫% বা তার বেশি পাওয়া যায়।
তবে বাস্তবিক কারণে যে কোনো দুটি পয়েন্ট পেলে আমরা তাকে ডায়াবেটিস হিসেবে চিহ্নিত করব। সন্দেহ হলে একই পরীক্ষা পুনরায় করে নিশ্চিত করে নিতে হবে।
চিকিৎসা কখন শুরু করবেন?
শুরুতেই চিকিৎসা শুরু করতে হবে। প্রায়ই দেখা যায় যে, অনেক দেরিতে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। অর্থাৎ রোগটি গোপনে আগে থেকেই ছিল কিন্তু নিয়মিত চেকআপের অভাবে সময়মতো ধরা পড়েনি। তার মানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগটি বেশ আগে থেকেই চলছিল।
ডায়াবেটিস চিকিৎসায় তিন ধাপ
১। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়াম।
২। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম এবং মুখের ওষুধ।
৩। দ্বিতীয় ধাপের সবকিছু এবং ইনসুলিন।
লেখক- কার্ডিওলজিস্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ, ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা।
Discussion about this post