হার্টবিট ডেস্ক
দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফ্রন্ট লাইনার এবং বয়স্কদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ মাসের মধ্যে বুস্টার ডোজ দেওয়া হবে। বুস্টার ডোজ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটিও। কমিটির এক সভায় নেওয়া সুপারিশে বলা হয়েছে, ষাটোর্ধ্ব ও ফ্রন্টলাইনারদের যারা অন্তত ছয় মাস আগে টিকার দুই ডোজ নিয়েছেন তাদের বুস্টার ডোজ দেওয়া যেতে পারে।
এদিকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এখনও বুস্টার ডোজের পর্যায়ে আসেনি। দেশের মাত্র কয়েক শতাংশ রোগী টিকার আওতায় এসেছেন। বুস্টার ডোজের চিন্তা এখন পুরোপুরি অযৌক্তিক। এটি দেওয়া হলে টিকাদান কর্মসূচিতে অসমতা আসবে। সেইসঙ্গে বুস্টার ডোজে এখনই না যাওয়ার পরামর্শ ছিল টিকা বিষয়ক ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপ নাইট্যাগ-এর। যদিও টিকা নিয়ে যতো পরামর্শ, সেগুলো সবই আসার কথা নাইট্যাগ থেকে। কমিটি বলছে, ‘দেশের মাত্র ২৪ শতাংশ মানুষকে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে, সেখানে বুস্টার ডোজ দেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায়?’
দেশে এখনও টিকার দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় রয়েছেন অনেক মানুষ। তাদেরই একজন জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘প্রথম ডোজ নিয়েছিলাম চার মাস আগে, মডার্নার টিকা পেয়েছিলাম। আমার মতো যারা প্রথম ডোজ নিয়ে অপেক্ষা করছেন, তাদের দ্বিতীয় ডোজ না দিয়ে এখনই বুস্টার ডোজ দেওয়া হচ্ছে, এটা ঠিক হচ্ছে না।’
দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় (১৩ ডিসেম্বর সকাল ৮টা পর্যন্ত) করোনাভাইরাসে নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৩৮৫ জন। এ নিয়ে টানা পরপর দুইদিন ৩শ’র উপরে রোগী শনাক্ত হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে নতুন করে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যু তার আগের সপ্তাহের তুলনায় বেড়েছে। অধিদফতর জানিয়েছে, গত সপ্তাহে (৬ ডিসেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর) করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৮৮২ জন। তার আগের সপ্তাহে (২৯ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর) শনাক্ত হয়েছিলেন ১ হাজার ৬৫৯ জন। অর্থাৎ, গত সপ্তাহে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন তার আগের সপ্তাহের তুলনায় ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।
অধিদফতর জানায়, গত সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৭ জন, তার আগের সপ্তাহে মারা গিয়েছিল ২৩ জন। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত্যু বেড়েছে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আর মারা যাওয়া ২৭ জনের মধ্যে ২২ জনই করোনা ভাইরাসের টিকা নেননি বলেও জানাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের বুস্টার ডোজ দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশে এটা বের করা মুশকিল। কতজন ডায়াবেটিস, ক্যন্সারে আক্রান্ত কতজন এই সংখ্যা বাংলাদেশে রেজিস্ট্রার্ড নয়। যখন চলতি বছরের শুরুতে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় তখনও এটার প্রায়োরিটি করা যায়নি।
তিনি বলেন, ‘যারা এসব রোগে ভুগছেন, তাদের প্রথমবার টিকা দেওয়ার সময়ও শনাক্ত করা যায়নি। এ কারণেই তখন বয়সভিত্তিক ভাগ করে টিকা দেওয়া হয়। অর্থাৎ ৫৫ ঊর্ধ্ব মানুষদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশে এসব রোগীদের লিস্ট নেই, তাই এটা (রোগ হিসাবে টিকা দেওয়া) ওয়াইজ ডিজিশন না।’
কী যুক্তিতে এখন বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা জানেন না বলেও জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগেও আমরা বলেছিলাম, বয়সভিত্তিতে দেওয়ার আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতানুসারে কোমরবিডিটিতে যারা আক্রান্ত তাদের আগে টিকা দিতে হবে। কিন্তু এই রোগীদের বের করতে গেলে ঝামেলা হতো। কিন্তু যারা প্রকৃতপক্ষেই ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত সেটা ভেরিফাই কে করবে, আর এটা না করা গেলে আবারও অনিয়ম হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘বুস্টার ডোজ শুরু হলে দেশে টিকার বৈষম্য বাড়বে, যেটা বিশ্ব স্বাস্থ্য বারবার করে বলে এসেছে। সংস্থাটি বলছে, যারা টিকা পাচ্ছে না এখনও, প্রথম ডোজও পায়নি, তাদের আগে টিকার আওতায় আনতে হবে। আর ইকুইয়িটি (সমতা) যদি আমরা না করি, তাহলে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হবে। সেটা বিশ্ব জুড়ে এবং বাংলাদেশের ভেতরেও এটা প্রযোজ্য।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যারা টিকা এখনও পায়নি তাদের আগে টিকা দিতে হবে। তবে যারা ফ্রন্টলাইনার এবং যারা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত থাকার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের বুস্টার ডোজ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই ‘ইমিউন কম্প্রোমাইজড’ মানুষগুলোকে কীভাবে শনাক্ত করা যাবে সেই পদ্ধতি ভাবা উচিত। কিন্তু আমরা যেন বয়স্কদের টিকা দিতে গিয়ে এই কথা না শুনি যে, টিকা শেষ হয়ে গেছে বা টিকার শর্ট পরে গেছে।
‘টিকা দেওয়া যাচ্ছে না প্রান্তিক মানুষদের, এ কথা শুনতে চাই না’, বলেন মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।
নাইট্যাগের সদস্য অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দেশের মাত্র ২৪ শতাংশের কিছু মানুষকে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে, সেখানে বুস্টার ডোজ দেওয়ার যৌক্তিকতা কোথায় এটা নাইট্যাগ বুঝতে পারছে না। জাতীয় কারিগরি পরমর্শক কমিটি এ নিয়ে নাইট্যাগের সঙ্গেও কোনও আলোচনা করেনি।
বুস্টার ডোজ দেওয়ার জন্য কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরার্মশক কমিটি সুপারিশ করেছে কোন যুক্তিতে জানতে চাইলে কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বুস্টার ডোজ দেওয়ার বিষয়ে মত দিয়েছি। কিন্তু আমরা সঙ্গে এটাও বলেছি যে স্বাভাবিক টিকাদান কর্মসূচি যেন ব্যাহত না করে এবং যদি কেনা যে পরিমাণ টিকা মওজুদ রয়েছে তার ‘এক্সপায়ারি ডেট’ চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেক্ষেত্রে, সেক্ষেত্রে যারা ঝুঁকিপূর্ণ এবং ষাটোর্ধ্ব তাদের দেওয়া যেতে পারে।
‘এখানে কোনও ফ্ল্যাট সুপারিশ করা হয়নি’ জানিয়ে অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান বলেন, টিকার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার বিষয়টি এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ সবকিছুরই মেয়াদকাল রয়েছে।
এই মেয়াদকাল যদি শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বিবেচেনায় বুস্টার ডোজের সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে টিকাগুলো নষ্ট না হয়। সঙ্গে স্বাভাবিক টিকাদান কর্মসূচিও যেন ব্যাহত না হয়, বলেন অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান। সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post