হার্টবিট ডেস্ক
চট্টগ্রামে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া ৮৯.১ শতাংশ রোগী আগে থেকে এক বা একাধিক স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছিলেন।
চট্টগ্রাম ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউয়ে চিকিৎসাধীন ২৩৪ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর ওপর জরিপ চালিয়ে এমন চিত্র পেয়েছেন গবেষকরা। ‘মৃত্যুঝুঁকির সম্ভাব্যতা যাচাইকরণ’ শীর্ষক জরিপটি ২০২১ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে চালানো হয়।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু), চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের গবেষকরা যৌথভাবে জরিপটি চালিয়েছেন।
আজ (বুধবার) সিভাসুতে সংবাদ সম্মেলনে জরিপের তথ্য তুলে ধরেন গবেষক দলের নেতৃত্ব দেওয়া চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইসমাইল খান।
ইসমাইল খান বলেন, গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল, আইসিইউতে চিকিৎসাধীন কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত রক্তের বিভিন্ন উপাদান/ মার্কারের তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন বিশ্লেষণ করা।
সংবাদ সম্মেলনে সিভাসুর ড. গৌতম বুদ্ধ দাশ বলেন, আইসিইউয়ে মৃত্যুবরণকারী ৮৯.১ শতাংশ রোগী (১৩৯ জন) পূর্বে এক বা একাধিক স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছিলেন। যাদের মধ্যে ৯৩ জন ব্যক্তি একাধিক স্বাস্থ্য জটিলতা, যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, হাঁপানিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
তিনি বলেন, এটা একটা জরিপ গবেষণার মতো কাজ। আক্রান্ত রোগী, যারা আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন, তাদের বিভিন্ন প্যারামিটার তখন কেমন ছিল, তা নিয়ে পর্যালোচনা।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় আইসিইউয়ে ভর্তি করোনা আক্রান্ত রোগীর রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা, শ্বেত রক্ত কণিকা, সি-রিঅ্যাক্টিভ প্রোটিন, ফেরিটিন এবং ডি-ডাইমারের মাত্রা কোভিড-১৯ এর মৃত্যুঝুঁকি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব উপাদানের সংকটপূর্ণ মাত্রা করোনা আক্রান্ত রোগের স্বাস্থ্য এবং মৃত্যুঝুঁকির আশঙ্কা নির্দেশ করে। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল, তথ্য এবং উপাত্তসমূহ আইসিইউয়ে ভর্তি করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে গবেষকরা মনে করেন।
ভবিষ্যতে এমন গবেষণা বিশদ পরিসরে পরিচালনা করলে আইসিইউয়ে ভর্তি করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য উপযুক্ত ও কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে বলেও গবেষকরা মনে করেন।
সংবাদ সম্মেলন বলা হয়েছে, গবেষণায় দেখা যায় আইসিইউয়ে ভর্তি ২৩৪ জন রোগীর মধ্যে ১৫৬ জন (৬৬.৬৭%) মারা যান, আর সুস্থ হন ৭৮ জন (৩৩.৩৩%)। মারা যাওয়াদের মধ্যে ৭৩% রোগীর বয়স ছিল পঞ্চাশোর্ধ্ব।
গবেষণা দলের সদস্য চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. শেখ ফজলে রাব্বী বলেন, আইসিইউয়ে মারা যাওয়া রোগীদের রক্তের উপাদান পরীক্ষা করে দেখা যায়, ৭৫.৫ শতাংশ রোগীর শ্বেত রক্তকণিকার পরিমাণ ছিল স্বাভাবিক মাত্রার (৪০০০-১১০০০ ঘন মিলিমিটার) বেশি। এই রোগীদের ক্ষেত্রে শ্বেত রক্তকণিকার সংকটপূর্ণ মাত্রা ছিল ২৬১১০. ৬ ঘন মিলিমিটার। অর্থাৎ, করোনা আক্রান্ত রোগীদের শ্বেত রক্তকণিকার মান ২৬১১০.৬ ঘন মিলিমিটারের বেশি হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এছাড়া, মৃত্যুবরণকারী ৫১.৪ শতাংশ রোগীর রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ছিল স্বাভাবিক মাত্রার (১২-১৭ গ্রাম/ডেসিলিটার) চেয়ে কম, যার গড় পরিমাণ ছিল ১০.৬ গ্রাম/ডেসিলিটার। এছাড়াও মৃত্যুবরণকারী ৭২.৯ শতাংশ রোগীর রক্তে অক্সিজেনের চাপ ছিল স্বাভাবিক মাত্রার (৭০-৯০ মিলিমিটার) চাইতে তাৎপর্য পরিমাণে কম যার গড় পরিমান ছিল ৫০.৪ মিলিমিটার।
তিনি বলেন, মারা যাওয়া ৯৮.৪ শতাংশ রোগীর রক্তে সি-রিঅ্যাক্টিভ প্রোটিনের (সিসআরপি) পরিমাণ ছিল স্বাভাবিক মাত্রার (৫ মিলিগ্রাম/লিটারের কম) অনেক বেশি, প্রতি লিটারে ১০২.৪ মিলিগ্রাম পর্যন্তও পরিলক্ষিত হয়েছে। সেই সাথে মৃত্যুবরণ করা ৭৫ শতাংশ রোগীর রক্তে ফেরিটিনের স্বাভাবিকের (৯-৩৭০ ন্যানোগ্রাম/ মিলিমিটার) চেয়ে উচ্চ মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। যার পরিমাণ ছিল প্রতি মিলিলিটারে ৯০১.৫ ন্যানোগ্রাম। এছাড়াও আইসিইউয়ে মৃত্যুবরণ করা ৬৫.২ শতাংশ রোগীর রক্তে ডি-ডাইমারের পরিমাণ স্বাভাবিকের (০.৫ মাইক্রোগ্রাম/মিলিলিটারের কম) তুলনায় উচ্চ মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়; যা ছিল প্রতি মিলিলিটারে ২.০২ মাইক্রোগ্রাম।
তিনি আরও বলেন, একইভাবে মারা যাওয়া ৭৬.১ শতাংশ রোগীর রক্তে ট্রপোনিনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ছিল।
এ গবেষণার সঙ্গে আরও যুক্ত ছিলেন- চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরিচালক বিদ্যুৎ বড়ুয়া, সহকারী অধ্যাপক ইফতেখার আহমেদ, জেনারেল হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ কনসালট্যান্ট মো. আবদুর রব, জুনিয়র কনসালট্যান্ট রাজদ্বীপ বিশ্বাস, জুনিয়র কনসালট্যান্ট মৌমিতা দাশ, সিভাসুর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ত্রিদীপ দাশ, সিভাসুর মলিকিউলার বায়োলজিস্ট প্রণেশ দত্ত, সিরাজুল ইসলাম ও তানভির আহমেদ নিজামী।
Discussion about this post