হার্টবিট ডেস্ক
পেটে ব্যথা খুবই সাধারণ একটা বিষয় হলেও, তাকে পাত্তা না দিলে সে ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। গ্যাসের ব্যথা বলে অনেক সময় ব্যথা এড়িয়ে যাই আমরা। মূলত, অন্যান্য সমস্যার কারণে অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা আলাদা করে চেনা সম্ভব হয় না। হঠাৎ একদিন অ্যাপেন্ডিক্সের মারাত্মক ব্যথা অসহায় করে দেয়। আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়ে যায় রোগীর।
শরীরের অবাঞ্চিত অঙ্গ অ্যাপেন্ডিক্সকে পাত্তা না দিলে প্রাণ সংশয় হতে পারে। তাই ব্যথা সম্পর্কে অবগত হন।
আমাদের শরীরের একটি অপ্রয়োজনীয় অঙ্গের নাম হল অ্যাপেন্ডিক্স। অ্যাপেন্ডিক্স(Appendix) থেকে কখনোও কোনও কারনে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তার নাম হলো অ্যাপেন্ডিসাইটিস। প্রত্যেকের শরীরেই(Health) এই অ্যাপেন্ডিক্স আছে। কারোর ক্ষেত্রে সেটি ভয়াবহ আকার ধারণ করে আবার কারো ক্ষেত্রে সেটি কোনও বাড়াবাড়ির কারণ হয় না। বিশ্বে প্রায় ৫ শতাংশ মানুষের প্রাণ সংশয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে অ্যাপেন্ডিসাইটিস(Appendicitis)।
কোথায় থাকে অ্যাপেন্ডিক্স?
আমাদের বৃহদান্ত্র এবং ক্ষুদ্রান্তের সংযোগস্থলে বৃহদান্ত্রে সঙ্গে যুক্ত একটি ছোট্ট,ক্ষুদ্র থলির মত একটি অংশ থাকে, সেটিই হল অ্যাপেন্ডিক্স। কোনও ভাবে ঐ অঙ্গের মধ্যে যদি খাদ্যের টুকরো বা ময়লা ঢুকে গিয়ে সংক্রমণ ছড়ায় সে ক্ষেত্রে প্রচন্ড যন্ত্রণা সৃষ্টি হয়। তখন একমাত্র অস্ত্রপ্রচারই হল একমাত্র উপায়। তা না হলে যদি একবার অ্যাপেন্ডিক্স ফেটে যায় তাহলে তার থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
কেন হয় ?
অ্যাপেন্ডিসাইটিসে আক্রান্তের কোন নির্দিষ্ট বয়স নেই। যেকোনও বয়সেই অ্যাপেন্ডিসাইটিস হতে পারে। তবে ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে যাদের বয়স, তাদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অনেক ক্ষেত্রে অ্যাপেন্ডিসাইটিস জন্ম বা বংশগত কারণেও হয়ে থাকে। পরিবারে পূর্বে কারো এই রোগটি হয়ে থাকলে তবে শিশুদের এই রোগটি হতে পারে।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস সারা বছরই হতে পারে তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শীতকালে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে মে মাসের মধ্যেই হয়ে থাকে। পুরুষদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা মহিলাদের তূলনায় কিছুটা বেশি।
ফাইবার জাতীয় খাবার কম খেলে এবং রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ বেশি খেলে অ্যাপেন্ডিসাইটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
ছেলে শিশুর ক্ষেত্রে, সিস্টিক ফাইব্রোসিসে ভুগছে এরকম শিশুদের অ্যাপেন্ডিসাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে অ্যাপেন্ডিক্সকে সার্জিক্যাল ইমার্জেন্সি’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। তাই অ্যাপেনডিসাইটিসের সমস্যা কখনও অবহেলা করা উচিত নয়। কোনও কারণে অ্যাপেন্ডিক্সে খাদ্যকণা বা ময়লা ঢুকে গেলে সেখানে রক্ত আর পুষ্টির অভাব দেখা দেয়। শুধু তাই নয় সেখানে নানা রকম জীবাণুর আক্রমণে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অ্যাপেনডিক্সে ব্যথা হতে শুরু করে।
মনে রাখতে হবে অ্যাপেন্ডিক্স কোনও কারণে ফেটে গেলে রোগীকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই অ্যাপেনডিসাইটিসের উপসর্গগুলো চিনে আগে থেকেই সতর্ক হওয়া জরুরি।
উপসর্গ বা লক্ষণ :
অ্যাপেন্ডিক্সের কারণে ব্যথা(Appendix pain) হয় আমরা সকলেই জানি। তবে ঠিক কোন ধরনের ব্যথা বা কি কি উপসর্গ(Symtoms) দেখে বোঝা যাবে ব্যথার কারণ অ্যাপেন্ডিসাইটিস তা জেনে নেওয়া যাক…
১) পেটের যন্ত্রণা যদি নাভির কাছ থেকে শুরু হয় পেটের ডান দিকে নিচে পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে একটি অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা।
২) পেটে যন্ত্রণার কারণ থেকে বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া যদি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় ,তাহলে অবশ্যই পরামর্শ করুন চিকিৎসকের সঙ্গে।
৩) সারাদিন কাজ করার পরেও যদি খিদে ভাব না হয় । এবং অল্প খেলেই তা সঙ্গে সঙ্গে বমি উঠে যায়,তাহলে সাবধান হোন। যদিও এর অন্য কারণও হতে পারে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৪) পেটের যন্ত্রণা হলেই যদি তার থেকে জ্বর আসে , তবে সেটি অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর পূর্ব লক্ষণ। সেক্ষেত্রে তাপমাত্রা খুব বেশি হয় না।
অ্যাপেন্ডিসাইটিস নির্ণয়ে পরীক্ষা
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগী দেখে এবং তার অভিজ্ঞতা থেকে অনেক সময় কোন পরীক্ষা না করিয়েও রোগীর অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছে কিনা তা কিছুটা নিশ্চিত করতে পারেন। যেমন- যদি রোগীর কাশতে গেলে পেটে তীব্র ব্যথা অনুভুত হয়। আবার যদি তলপেটের বামদিকে চাপ দিলে ডানদিকের তলপেটে তীব্র ব্যথা অনুভুত হয় অথবা তলপেটের ডানদিকে চাপ দিলে বামদিকের তলপেটে তীব্র ব্যথা অনুভুত হয়, তাহলে সেটা অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা হতে পারে। আবার পেটের ডান দিকের নিচের অংশে নানান কারনে ব্যথা হতে পারে, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে। তাই, অপারেশনের পূর্বে চিকিৎসককে নানান বিষয় যাচাই করে নিশ্চিত হতে হবে যে এটা এ্যাপেন্ডিক্সের ব্যথা কিনা। আলট্রাসনোগ্রাম বা রক্ত পরীক্ষা অ্যাপেনডিসাইটিস নির্ণয়ে সহায়ক হতে পারে।
অ্যাপেন্ডিসাইটিসের চিকিৎসা
অ্যাপেন্ডিসাইটিসের চিকিৎসা হলো আক্রান্ত অংশ বা অ্যাপেন্ডিক্স যত দ্রুত সম্ভব অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে ফেলে দেওয়া। অস্ত্রোপচারের ভয়ে অনেকে হাসপাতালে যেতে চান না। অনেক সময় শিশু বা বেশি বয়স্করা ব্যথার সঠিক বর্ণনাও দিতে পারে না। কিন্তু জটিলতা এড়াতে পেটে ব্যথা তীব্র ও স্থায়ী অথবা থেকে থেকে হলে রোগীকে শক্ত খাবার দেওয়া থেকে বিরত থাকুন বা মুখে খাবার দেওয়া বন্ধ রাখুন এবং দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান।
বর্তমানে ল্যাপারোস্কোপি করে অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন করা হয়। আধুনিক পদ্ধতিতে পেট না কেটেই বাদ দেওয়া হয় অ্যাপেন্ডিক্স।
অপারেশন পরবর্তী সতর্কতা
ল্যাপ্রোস্কোপির মাধ্যমে অপারেশন করা হলে, কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ দিন সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। অপরদিকে যদি ওপেন অ্যাপেনডেকটোমি করা হয়, তাহলে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৪ দিন সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। অপারেশন পরবর্তী সম্পূর্ণ সুস্থ্য হতে কয়েক সপ্তাহ লাগতে পারে।
ঘুম বোধ হলে বা ক্লান্ত লাগলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে। কাশি, হাসি অথবা নড়াচড়া করার পূর্বে তলপেটের উপর একটি বালিশ রেখে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এটি ব্যথা কমাতে সাহায্য করবে। পেইনকিলার খাওয়া সত্ত্বেও ব্যাথা না কমলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
অপারেশন পরবর্তী ঝুকি কমাতে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিশ্রাম করতে হবে। শিশুরা অপারেশনের এক সপ্তাহ পরে স্কুলে যাওয়া শুরু করতে পারবে তবে শ্রমসাধ্য কাজ যেমন জিম বা খেলাধুলা পুনরায় শুরু করার পূর্বে কমপক্ষে ২ থেকে ৪ সপ্তাহ সময় নেয়া উচিত। নিজেকে সম্পূর্ণ সুস্থ মনে হলে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যেতে হবে।
সাধারণত ফাইবার জাতীয় খাবার কম খেলে অ্যাপেন্ডিসাইটিস হবার সম্ভাবনা বেশি। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন পেতে সব সময় প্রাকৃতিক ভেষজ যেমন মেথি, বাদাম তেল, জিনসেং,, সবজির জুস, পুদিনা পাতার জুস খাওয়া দরকার। প্রাকৃতিকভাবে এসব খাবার অ্যাপেন্ডিসাইটিস প্রতিরোধে সহযোগিতা করে।
Discussion about this post