আজ ১ ডিসেম্বর, বিশ্ব এইডস দিবস। এ নিয়ে কথা বলেছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. রিদওয়ানুর রহমান।
প্রশ্ন : এইডস কী এবং এইচআইভি কী?
উত্তর : এইচআইভি একটি ভাইরাসের ছোট নাম। হিউমেন ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস থেকে নাম হয়েছে এইচআইভি। এই ভাইরাসটা মানুষের শরীরে সংক্রমণ হলেই রোগ হয়ে যায় না। সংক্রমণ হয়ে রোগ হতে অনেক বছর লাগে। ১০ থেকে ১৫ বছর বা ২০ বছর পর এই রোগ হয়। এজন্য যাদের এইচআইভি আছে, তাদের অনেকের ক্ষেত্রে কোনো রোগ নেই। এই এইচআইভি ইনফেকশনের কারণে যখন কতগুলো লক্ষণ শরীরের মধ্যে দেখা দিতে শুরু করে- সেটা জ্বর, ওজন কমে যাওয়া, ডায়রিয়া হওয়া, টিবি রোগ হওয়া। এইচআইভির কারণে যখন মানুষের মধ্যে এই রোগগুলো দেখা দেয়, তখন একে এইডস বলে।
প্রশ্ন : এর মানে এইচআইভি পজিটিভ কেউ হলেও তার মধ্যে এটি কেরিয়ার (বহনকারী) হিসেবে থাকছে, তখনই এটি রোগ নয়। যখন এটা রোগে পরিণত হচ্ছে, তখন একে আমরা এইডস বলি। বাংলাদেশে এইচআইভি রোগীর সংখ্যা কেমন? এর বহনকারীর সংখ্যা কেমন? আমরা কতখানি ঝুঁকির মধ্যে আছি?
উত্তর : এইডস রোগীর সংখ্যা কম, আক্রান্তের হার কম। তবে ২০১৪ সালের শেষে বাংলাদেশে প্রায় নয় হাজার এইচআইভি পজিটিভ লোক পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এইডস রোগী রয়েছে ৩০০ এর কিছু বেশি যারা চিকিৎসা পাচ্ছে। এইডস হওয়ার জন্য অনেক বছর সময় লাগে। এই জন্য বাংলাদেশে ঝুঁকি বেশি। কারণ বাংলাদেশে এত বছর এইডসের প্রোগ্রাম জানানোর পরও সচেতনতার অভাব রয়ে গেছে।
বাংলাদেশে রিকশাচালকদের মধ্যে একটি গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে যে তাদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ লোক এইডস কীভাবে ছড়ায় তা জানে না। এখন এটা আমাদের দেশে শুধু নয়, সারাদেশে যাদের তথ্য জানার অভাব রয়েছে তাদের মধ্যে আমরা পৌঁছাতে পারছি না। যাদের ক্ষেত্রে শিক্ষিতের হার কম, তথ্য প্রবাহের হার কম- তাদের এই সমস্যাটি থেকে যাচ্ছে।urgentPhoto
প্রশ্ন : একজন মানুষের থেকে অন্য মানুষের শরীরে এইচআইভি কীভাবে ছড়ায়?
উত্তর : এর তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। এই তিনটির বাইরে কোনো পদ্ধতি নেই। একটি হলো, দুজন মানুষের শারীরিক মিলনের মাধ্যমে হচ্ছে। দ্বিতীয়, ইনজেকশনের মাধ্যমে হতে পারে, ইনজেকশন যদি শেয়ার করে বা রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে হতে পারে। তিন নম্বর হচ্ছে, মায়ের থেকে সন্তানের হতে পারে। মা যদি এইচআইভি পজিটিভ হয়, তখন এটি হতে পারে, তাও এর সম্ভাবনা খুব কম। ১০০ ভাগের এক ভাগও নয়, দশমিক পাঁচ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে। এই দশমিক পাঁচ শতাংশের মধ্যে পড়ে গেলে সন্তানও এইচআইভি পজিটিভ হতে পারে।
যৌন কার্যক্রমের মধ্যে নারী, পুরুষ, সমকামীদের মধ্যে ছড়িয়ে এইচআইভি ছড়িয়ে পড়ার হার বেশি। হেটারোসেক্সুয়াল যখন হচ্ছে, পুরুষ এবং মহিলা, তাদের মধ্যে কম, তবে সিগনিফিকেন্ট। সারা দেশে যত রোগীর আছে তাদের মধ্যে ৯০ ভাগের রোগই ছড়িয়েছে যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে।
প্রশ্ন : এই তিনটি বিষয়ের কথা আপনি বলছেন। এর বাইরে যদি এইডস রোগীর সাথে হাতমেলায়. কোলকুলি করে, কিংবা একই সঙ্গে খাবার-দাবার গ্রহণ করে-এই ধরনের মেলামেশায় কি এইডস ছড়াতে পারে?
উত্তর : না, এই ধরনের মেলামেশায় কখনো এইডস ছড়াবে না। এইডস রোগীদের আমরা নিজেরা হাতে ধরে দেখি। তাদের পরীক্ষা করি। বিভিন্ন রকম ইনজেকশন তাদের দেই- এতে ছড়ায় না। স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও হয় না।
একই গ্লাসে পানি খেলে বা একই থালায় ভাত খেলে কখনোই এইডস হবে না। এমনকি চুমু দিলেও এইডস হবে না, জড়িয়ে ধরলেই এইডস হয় না। এ রকম কিছুই করলে রোগটি হবে না।
তাহলে কীভাবে হবে? হবে শুধু অজ্ঞতা থাকলে। আমরা অনেক লোককে জানানোর পরও অনেক লোক থেকে যাচ্ছে, যারা বিষয়টি জানতে পারছে না। ওদের মাধ্যমে আমাদের মহামারির মুখোমুখি হতে পারে। এজন্য এটি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া এবং সবাইকে পুনরায় সচেতন হওয়া। এই জন্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি বছর এই রোগ পালন করে, বিশ্ব এইডস দিবস উপলক্ষে। আমাদের দেশেও জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য ব্যাপক অনুষ্ঠান থাকে। টিভি চ্যানেল, পত্রিকাগুলো আলাদা সংবাদ প্রচার করে।
প্রশ্ন : এইচআইভির লক্ষণ প্রকাশ পেতে পাঁচ থেকে ১০ বছর লেগে যেতে পারে। তাহলে আগে কেউ কীভাবে বুঝবে যে সে এইচআইভি ক্যারিয়ার কি না?
উত্তর : যাদের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ আছে, যেগুলো আমি বললাম। ঝুকিঁপূর্ণ আচরণের মধ্যে বাংলাদেশের বাইরে যাদের এইচআইভি পজিটিভ আছে, তাদের শতকরা ৬৭ ভাগ, মানে তিন জনের দুজনের ইতিহাস রয়েছে। তারা দেশের বাইরে চাকরি করেছে বা তাদের পরিবারের লোক চাকরি করেছে। এজন্য আমাদের দেশে এক নম্বর ঝুঁকি হচ্ছে, বাইরে ভ্রমণ। তারা বাইরে যাচ্ছে, ওখানে বিভিন্ন যৌনগত আচরণ পরিবর্তন হচ্ছে, এ জন্য ওরা ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। ওরা ক্যারিয়ার হয়ে দেশে ফিরে আসছে।
আর যারা বিদেশে যায়নি, যাদের বাংলাদেশের মধ্যে এইচআইভি হয়েছে, এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় দল হচ্ছে, যারা ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক ব্যবহার করছে। ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করে ওরা। ঢাকা শহরেই এর অনেক দল রয়েছে, সারা দেশব্যাপীও রয়েছে। বিশেষ করে যারা সীমান্তের কাছাকাছি। ওই সব এলাকায় ব্রোথেল রয়েছে বেশি। ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক যেভাবে হচ্ছে, সেখানে বলছে ডুপলিকেশন টাইম, মানে আজ যদি কেস ১০টি থাকে, এটি ২০টি হতে সময় খুব ছোট। মাত্র দুই বছর।
দুই বছরের মধ্যে যারা ইনজেকশন নিচ্ছে, তাদের এই বছর পাওয়া গেছে এক দশমিক সাত ভাগ, এরপর পাঁচ বছর পর দেখা গেল তারা চার দশমিক চার ভাগ হয়ে গেছে। তিনগুণ বেড়ে গেছে। ওই দলটি এখন এপিডেমিকের মধ্যে আছে বাংলাদেশে। কারণ ওদের ছাড়ানো যাচ্ছে না, জোর করে ইনজেকশন ছাড়ানো যায় না। থেরাপি দিয়ে, আচরণ দিয়ে করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার তাদের নিরাপদ সিরিঞ্জ দিয়ে করার একটি পরিকল্পনা আছে। যেন একই সিরিঞ্জ পুনরায় ব্যবহার না হয়। যেন একই সিরিঞ্জ একাধিক জন ব্যবহার না করে। ওই লোকগুলোরই হয়তো বহুগামী যৌন আচরণ রয়েছে। দে আর সেক্স ইন দ্য মার্কেট। সেখানেও কনডম ব্যবহারের হার অনেক কম। বাংলাদেশে ব্রোথেলগুলোতে যে গবেষণা হয়েছে, সবশেষ সেক্সের সময় কনডম ব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে মাত্র ৩৮ শতাংশ। মানে অর্ধেকেরও কম যৌনকর্মীর সাথে সবশেষ যৌন মিলনের সময়ে কনডম ব্যবহৃত হয়েছে। এই জন্য আমাদের ঝুঁকি কিন্তু বেশি।
আবার পাশাপাশি আমাদের দেশটি মুসলিম জনগোষ্ঠী হওয়াতে ধর্মের কারণে মানুষ যে অবৈধ যৌনাচার থেকে বিরত আছে, এজন্য আমাদের দেশে এখনো এইচআইভি কম আছে।
প্রশ্ন : আরেকটি জিনিস জানতে চাইব। যারা দেশের বাইরে যাতায়াত করে, তাদের এই ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকার উপায় কী?
উত্তর : অবশ্যই। বিদেশ যাত্রা মানেই একটি ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি একদম আমাদের সীমান্তে এসে গেছে। ভারতে আমাদের দেশ থেকে অনেক বেশি এইচআইভি আক্রান্ত রয়েছে। আমাদের দশমিক শতাংশ। ওরা প্রায় ১০ শতাংশ। ওখানে যে জনগোষ্ঠী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তারা হলো সেক্স ওয়ার্কার। ওদের দেশেও অনেক বেশি লোক রয়েছে যারা বাইরে কাজ করে। ওরা ফিরে আসার সময় এই ব্যাধি বয়ে নিয়ে আসে। ভারতের চেয়ে আমাদের দেশের ভিন্নতা হলো, আমাদের বেশির ভাগ রোগী বাইরে ভ্রমণ করে আসে। তবে ওদের ওখানে স্থানীয়ভাবেই একটি দল এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
প্রশ্ন : এইডস রোগী যখন শনাক্ত হয়, তাদের মনে হয় আমি শেষ হয়ে গেলাম। সামাজিকভাবেও তারা হেয় হয়, তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
উত্তর : পশ্চিমা দেশগুলোতে এটি ইতিমধ্যে চলে গেছে। তবে আমাদের মতো লো-প্রিভেলেন্ট (নিম্ন প্রচলিত) দেশগুলোতে এখনো রয়ে গেছে। মানুষ এটা ভয় থেকে করে। তবে অবৈধ যৌনাচারের বাইরেও হতে পারে। এইচআইভি রোগীরাও মানুষ। তাদের মানবাধিকার রয়েছে। অন্য দশটি রোগের মতো এটি একটি রোগ। বর্তমানে এরও চিকিৎসা রয়েছে। এমন চিকিৎসা রয়েছে যে ওরা এইডসে মারা যাবে না। এদের চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। একে হয়তো একেবারে নিরাময় করে ফেলা সম্ভব নয়। তবে অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত লক্ষণহীন রাখা সম্ভব এবং আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে রাখা সম্ভব।
Discussion about this post