ডা. মোহাম্মদ নেয়ামত হোসেন
সহকারী অধ্যাপক, নিওনেটোলজী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর।
নবজাতকের জন্ডিসে দেহে রোদ লাগানো নিষেধ। রোদ লাগানোর মতো ভুল অনেক চিকিৎসকরাই করে থাকেন। নবজাতকের জন্ডিস হলে রোদ দেওয়া কেন নিষেধ, জানার আগে আমাদের জানতে হবে নবজাতকের জন্ডিসের কারণ কি? প্রথমে এই জন্ডিসের কারণকে দুই ভাগে ভাগ করলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে।
১. ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস
২. প্যাথলজিক্যাল জন্ডিস
নবজাতকের যেকোন জন্ডিসের (Indirect) চিকিৎসা পদ্ধতি তিনটি:
১. বুকের দুধ
২. ফটোথেরাপি
৩. এক্সচেঞ্জ ট্রান্সফিউশন
প্যাথলজিক্যাল জন্ডিস নিয়ে এখানে আলোচনা করবো না। কারণ প্যাথলজিক্যাল জন্ডিস সবসবয়ই ভর্তি যোগ্য ঘটনা। আর যে বাচ্চাগুলোকে রোদে দেওয়া হয়, সেই নবজাতক সাধারণত ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে থাকে। নামেই বুঝা যায় ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস একটি সাধারণ ঘটনা। এই জন্ডিস সাধারণত জন্মের দুইদিন পরে শুরু হয়। এক্ষেত্রে স্বভাবতই সবসময় ফটোথেরাপি স্তরের নিচে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেড়ে যেতে পারে। এরমধ্যে প্রধান কারণ পানিশূন্যতা।
ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিসের চিকিৎসা
১. বুকের দুধ: ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়ানো, যেনো বাচ্চার পানিশূন্যতা না দেখা দেয়। পানিশূন্যতা না হলে এই জন্ডিস এমনিতে ঠিক হয়ে যাবে। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে, বুকের দুধ খাওয়ানো ফটোথেরাপি স্তরের নিচের জন্ডিসের একমাত্র চিকিৎসা। মানে সঠিক ভাবে বুকের দুধ খাওয়ালে পানিশূন্যতা হয় না, ফলে নবজাতকের জন্ডিস কমে যায়। কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন বুকের দুধ খাওয়াতে তো সবাইকেই বলি, তাহলে চিকিৎসা হলো কি ভাবে? প্রশ্নের উত্তর হলো পদ্ধতিতে।
বুকের দুধ ঘণ ঘণ খাওয়ানোয় পানিশূন্যতা রোধ করে > জন্ডিস কমে যায়। কে কে ফটোথেরাপি পাবে আর কে এক্সচেঞ্জ ট্রান্সফিউশন পাবে, তা নির্ণয় করা হয় তালিকা বা চার্ট দেখে। সেই তথ্য শিশু বিশেষজ্ঞ জানলেই হবে।
বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে এতো লিখছি কারণ এই গ্রুপের বাচ্চাকে সবাই, এমন কি, কিছু কিছু শিশু বিশেষজ্ঞও রোদে দেওয়ার উপদেশ দিয়ে থাকেন। যা অত্যন্ত বিপদজনক এবং অপ্রয়োজনীয়। আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই, নবজাতকের জন্ডিসের একমাত্র চিকিৎসা ঘণ ঘণ বুকের দুধ খাওয়ানো, যাতে পানিশূন্যতা না হয়। সাধারণত এই রোগীগুলোকেই রোদে দেওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়।
২. ফটোথেরাপি: এই গ্রুপে যেসব বাচ্চা পড়বে, তাদের কোনমতেই রোদে দেওয়া উচিৎ নয়। বরং এতে জন্ডিস বেড়ে এক্সচেঞ্জ স্তরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যা মেডিকেল ইমার্জেন্সি।
সবাইকে জানাতে চাই, বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে ফটোথেরাপি মেশিন আছে। অতএব ফটোথেরাপি দেওয়া দরকার, কিন্তু দুর্গম জায়গা বলে রোদে দিলাম, এমন উপকার করার আগে দুইবার ভাবুন। কারণ আপনার উপদেশের কারণে সেই বাচ্চা বিলিরুবিন অ্যানসেফালোপ্যাথির (Bilirubin encephalopathy) স্বীকার হতে পারে। সে দায় নিতে রাজি আছেন? এই উপদেশের জন্য বাচ্চার আজীবনের জন্য মস্তিষ্কের ক্ষতি হবে।
কেন রোদে দিবেন না
সকালের রোদ: সকালের রোদে দেওয়ার কারণে বাচ্চা হাইপোথার্মিয়াতে বা শরীরের তাপমাত্রা কমে যাবে। কারণ বাচ্চা উন্মুক্ত এবং প্রবাহমান বাতাসের মধ্যে থাকে। আর নবজাতকের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় হাইপোথার্মিয়াতে। কারণ নবজাতকের চিকিৎসায় প্রতিটি স্তরে বলা আছে- হাইপোথার্মিয়া প্রতিরোধ করুন।
দুপুরের রোদ: এই অত্যাধিক তাপমাত্রায় বাচ্চার হাইপারথার্মিয়া বা শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং পানিশূন্যতা তৈরি করে। ফলে ত্বক পুড়ে যাওয়া এবং জন্ডিস বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ দুপুরের রোদে দেওয়া মানে, জেনেশুনে বাচ্চার ক্ষতি করা।
ডিএনএ এর ক্ষতি: সূর্যের ক্ষতিকর আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি নবজাতকের ডিএনএ এর ক্ষতিসাধন করে। যার কারণে পরবর্তীতে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
যারা ভাইটামিন ডি নিয়ে চিন্তিত তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, তারা যেনো বাচ্চার নবজাতকের সময়কালের (২৮ দিন বয়স) পর এই বিষয় নিয়ে ভাবুন। হাইপোথার্মিয়া বা হাইপারথার্মিয়া ভাল, নাকি ভাইটামিন ডি? একমাস পর রোদ থেকে ভিটামিন ডি খাওয়ান, তখন এ বিষয়ে কথা বলবো না।
উপরের আলোচনার পরও কেউ যদি অপ্রয়োজনে রোদে দেওয়ার মত অদূরদর্শী উপদেশ দেন তাহলে বলার কিছু নেই। উপরোক্ত আলোচনা শেষে বলতে চাই নবজাতকের জন্ডিসে রোদে দেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোন যুক্তিই এই অনিয়মের পক্ষে আসতে পারে না।
Discussion about this post