ড. অরূপ রতন চৌধুরী
আমাদের সৌভাগ্য যে করোনার বিপর্যস্ত দিনগুলো অতিক্রম করেছি এবং একটি নিউ নরমাল লাইফে ফিরে যেতে চাইছি। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক সহযোগিতায় এবং প্রশাসনসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সেই সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সমবেত প্রচেষ্টায় আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে একটি গ্রহণযোগ্য স্থানে আমরা পৌঁছে গেছি। তাই বলে কি আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব? আমরা কি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলব না? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে করোনা যায়নি, বরং আরো অধিকতর সতর্ক থাকতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাইরে বেরোলে মাস্ক অবশ্যই আমাদের পরতে হবে, বাইরে থেকে ঘরে এসে হাত সাবান দিয়ে অবশ্যই ধুতে হবে, ভিড়ের মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব অবশ্যই বজায় রাখতে হবে এবং সাবান-পানি না থাকলে সেনিটাইজার ব্যবহার অব্যাহত রাখতে হবে।
এখন সবার মনে একই প্রশ্ন, তাহলে কীভাবে করোনা গেল? অনেকে ভাবেন, ভ্যাকসিন তো দুই ডোজই নিলাম এবং করোনার কারণে সব নিষেধাজ্ঞাও উঠিয়ে নেওয়া হলো। এখন আর ঘরে থাকা লাগে না। তবে কেন এত সব বিধিনিষেধ আর স্বাস্থ্যবিধি? এরকমটি ভেবে অনেকেই অবজ্ঞা আর বাহাদুরিতে বেশ খোলামেলা বাইরে হেঁটেচলে কাজ করে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু তারা এগুলো কি ঠিক করছেন? না, কখনোই না। আমাদের একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, করোনার জন্য নেওয়া টিকা হয়তো করোনায় আক্রান্ত হলে নানা জটিলতা থেকে আমাদের মুক্ত রাখবে, হাসপাতাল আর নিবিড় পরিচর্যায় যেতে হবে না; কিন্তু তাই বলে আক্রান্ত হব না—এটা কিন্তু ঠিক নয় বা এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এখনো সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে সংবাদ বুলেটিন শুনলে জানা যাবে, মৃত্যুসংবাদ কমলেও একেবারে শূন্যের কোঠায় যায়নি।
তাই সচেতন থাকা জরুরি নয় কি? আমাদের অবশ্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশিকাগুলো এখনো মেনে চলতে হবে। সবচেয়ে আতঙ্কের খবর হলো, ইতিমধ্যে ভারত এবং অন্য এক-দুটি দেশে করোনার ভিন্ন ভ্যারিয়েন্টও ধরা পড়েছে। সুতরাং, করোনা নতুনভাবেও আসছে। তাই সতর্কতার বিকল্প নেই। যারা মনে করছেন নিষেধাজ্ঞা ওঠে গেছে, জনসমাবেশ চলছে, বাজারহাট, অফিস-আদালত, স্কুলে-কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে গেছে, তাই আবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেন চলব—তারা আসলে ঠিক করছেন না। ইতিমধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে, অনেকেই বিয়ের অনুষ্ঠানে বা সভা-সমিতিতে সুন্দর করে সাজসজ্জা করে আসছেন, তাদের চেহারা না দেখা গেলে সাজার কষ্টটাই যেন মাটি! তাই তারা মাস্ক খুলেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা হলো, মাস্ক না পরার জন্য এখনো কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি, বরং বারবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জনসমাগম স্থান এড়িয়ে যাওয়া এবং সেই সঙ্গে মাস্ক ব্যবহারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করছে। জরুরি বার্তাটি হলো, যারা এখনো টিকা (ভ্যাকসিন) নেননি, তারা অবশ্যই টিকা নিয়ে নেওয়ার জন্য নিকটস্থ টিকা কেন্দ্রে যোগাযোগ করে টিকা নিয়ে নেবেন। কারণ, টিকা আপনাকে করোনার ভয়ংকর পরিণতি থেকে রক্ষা করবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী শনাক্তের হার টানা দুই সপ্তাহে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। বর্তমানে সংক্রমণের হার ২-৩ শতাংশের নিচে রয়েছে। এটা আপাতত স্বস্তির। তবে এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে আমাদের স্বাস্থ্যসচেতনভাবে চলতেই হবে। ভারতে নতুন যে ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিয়েছে, তার নাম ডেলটা প্লাস। এ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে নানা কারণে। বাংলাদেশে সম্প্রতি করোনা যে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তার ৯১ শতাংশ ছিল ডেলটা প্রকৃতির। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেলটা প্লাসের সংক্রমণের তীব্রতা ডেলটা থেকে ১০-১৫ শতাংশ বেশি। এই অবস্থায় গণসচেতনতা, টিকা গ্রহণ, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমে আমরা নতুন ভ্যারিয়েন্টের মোকাবিলা করতে পারি। আমরা কি নতুন ভ্যারিয়েন্ট মোকাবিলায় প্রস্তুত? প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। সেই প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণে পূর্বের মতো ভুল করা যাবে না।
করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্ব এতটাই নাজেহাল হয়েছে যে, এর উত্স সন্ধানে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু এখন তারাই বলছে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, করোনার উত্পত্তি সম্ভবত কখনোই জানা যাবে না। তবে ভাইরাসটি জৈব অস্ত্র হিসেবে তৈরি করা হয়নি। গতকাল শনিবার (৩০ অক্টোবর) এসব জানিয়েছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি। সেই প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে যে, করোনা ছড়ানোর ক্ষেত্রে একটি প্রাণী থেকে মানুষে সংক্রমণ এবং ল্যাব লিক দুটোই যুক্তিযুক্ত অনুমান। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য পর্যাপ্ত তথ্য নেই।
এদিকে গত সপ্তাহে রাশিয়ায় রেকর্ড পরিমাণ কোভিড-১৯ শনাক্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাজধানী মস্কোয় জারি হয়েছে আংশিক লকডাউন। মস্কোয় শুধু ওষুধ ও অন্যান্য অতিপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানগুলো খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ৩০ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ১১ দিন এই কড়াকড়ি বহাল থাকার কথা আমরা জানতে পেরেছি। সরকারি হিসাবমতে, একই সময়ে রাশিয়ার ৮৫টি অঞ্চলে নতুন করে কোভিড শনাক্ত হয়েছে রেকর্ড ৪০ হাজার ৯৬ জনের। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য আগামী ১২ মাসে ২ হাজার ৩৪০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন। সংস্থাটির প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসিস বলেন, আরো ৫০ লাখ লোকের মৃত্যুর আশঙ্কা ঠেকাতে কোভিড-১৯ টিকা, টেস্ট ও চিকিত্সাসুবিধা নিশ্চিত করার জন্য এই অর্থের প্রয়োজন। তিনি মনে করেন, আমরা চূড়ান্ত মুহূর্তে আছি, বিশ্বকে নিরাপদ রাখার জন্য বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রয়োজন।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ সাপ্তাহিক বুলেটিনে বলা হয়েছে, ইউরোপিয়ান অঞ্চল বাদে পরপর তিন সপ্তাহে বিশ্বে নতুন কোভিড-১৯ সংক্রমণ পূর্ববর্তী সপ্তাহের চেয়ে ৭ শতাংশ বেড়েছে। সাপ্তাহিক নতুন সংক্রমিতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে ৫ লাখ ৮২ হাজার ৭০৭, যুক্তরাজ্যে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৭৫৬, রাশিয়ায় ২ লাখ ১৭ হাজার ৩২২, তুরস্কে ২ লাখ ১৩ হাজার ৯৮১ এবং ভারতে ১ লাখ ১৪ হাজার ২৪৪। গত সপ্তাহ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯-এ মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ কোটি ৯ লাখ ৪০ হাজার ৯৩৭ এবং মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৪৯ লাখ ৩ হাজার ৯১১।
এদিকে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোতে শীত শুরু হয়েছে। আর শীতে করোনার বিপদ অনেক বেশি বেড়ে যায়। আসন্ন শীতকালে বাংলাদেশে আবারও করোনা ভাইরাস মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। সেজন্য সম্প্রতি দেশের সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার এবং মাস্ক ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শীতকাল এলেই একটু ঠান্ডা লাগে, সর্দি-কাশি হয়। আর এটা হলেই এই করোনা ভাইরাসটা আমাদের সাইনাসে গিয়ে বাসা বানাতে পারে। কাজেই, সেদিকে সবাইকে একটু সতর্ক থাকতে হবে। সবাইকে মাস্ক পরতে হবে এবং খাদ্যতালিকায় ‘ভিটামিন সি’ যাতে একটু বেশি থাকে এবং যাতে ঠান্ডা না লাগে সেদিকে নজর দিতে হবে।’ তিনি এ সময় মৌসুমি ফলমূল, শাকসবজি ও তরিতরকারি বেশি করে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
করোনাকালে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এলেও বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশে কোনো কিছু যাতে স্থবির না হয় এবং সচল থাকে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে নিঃসন্দেহে।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত, শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং অনারারি সিনিয়র
Discussion about this post