হার্টবিট ডেস্ক
নয়টা-পাঁচটা হিসাব কষে নয়, এখানে সেবা দেওয়া হয় রোগীকে ভালোবেসে। ঘড়ির কাঁটা দেখে থেমে যায় না সেবা।সকাল ৮টা থেকে কখনো সন্ধ্যা ৭টা আবার কখনো ৮টা। যতক্ষণ রোগী থাকে ততক্ষণই সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন মাকসুদুর রহমান।
বলছিলাম ফেনী শহরতলীর ধর্মপুর কমিউনিটি ক্লিনিক-০১ (আশ্রয়ণ প্রকল্প) এর কমিউিনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) মাকসুদুর রহমানের কথা।
ব্যতিক্রম শুধু মাকসুদ নয়, তার কমিউনিটি ক্লিনিকটিও অন্যরকম। প্রচলিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো দেখতে যেমন হয় এ কমিউিনিটি ক্লিনিকটি ঠিক তেমন নয়। পুরো আঙ্গিনাজুড়ে বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ। সুসজ্জিত রোগীদের বসার স্থান, নারীদের স্বাভাবিক প্রসবের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অপারেশনরুম, জরুরি চিকিৎসার জন্য টেবিল সবই সাজানো এবং গোছানো। দৃষ্টি কাড়বে মাকসুদুর রহমান যেখানটায় বসে মানুষদের সেবা দেন সেখানকার বসার টেবিলের পাশের বইয়ের তাকে বইয়ের সংগ্রহ দেখেও। দিনে দিনে আশ্রয়ণ প্রকল্পের গরিব অসহায় মানুষগুলোর খুব আপন হয়ে উঠেছেন মানুষটি। সকাল থেকে বিকেল অব্দি ক্লিনিকটিতে থেকে দেখা গেছে কতটা আন্তরিকতা দিয়ে মানুষকে সেবা দিচ্ছেন।
আরমান হোসেন নামে ৮ বছরের এক শিশুকে নিয়ে ক্লিনিকে এসেছেন তার মা বিউটি আক্তার। ছেলেটির আজ ৭ সপ্তাহ জ্বর। বিউটি বলছিলেন ‘যত ওষুধ খাওয়াই ডাক্তার ইয়ার কাছে আনন ছাড়া পোলা ভালা অয় ই না’।
রমজান শেখ নামে তিন মাস বয়সী এক শিশুকে নিয়ে এসছেন মা বিবি হাজেরা বেগম। তিনি জানান, তার ছেলের আজ তিন-চারদিন ধরে কাশি। সব সময় তিনি এখানেই আসেন। স্বামী রিকশা চালান, গরিব মানুষ। চিকিৎসার জন্য এ ক্লিনিকটাই একমাত্র ভরসা। এখানের ওষুধ খেয়েই ভালো আছেন তারা।
তাসমির নামে এক শিশু এসেছেন চুলকানির সমস্যা নিয়ে। তার সমস্যার কথা শুনে দেওয়া হয়েছে ওষুধ। এভাবে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন নানা রোগী আসেন ক্লিনিকটিতে। স্থানীয়রা বলছেন তাদেরকে আর সদরের হাসপাতালে যেতে হচ্ছে না এখানেই তারা চিকিৎসা পাচ্ছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী নিমাইচন্দ্র ও দফাদার মো. বাবুল বলেন, ক্লিনিকের দায়িত্বে থাকা মাকসুদুর রহমান খুব দরদের সঙ্গে রোগীদের কথা শোনেন এবং সরকারি ওষুধ দেন। ক্লিনিকটিতে সব সময় রোগীর দীর্ঘলাইন থাকে।
মাকসুদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় কোনোদিন ৭০ জন, কোনোদিন ৮০ জন রোগী হয়। গড়ে ৪৫ জনের ওপরে রোগী থাকেই। সে হিসাবে প্রতি মাসে ১ হাজার ২শ মত রোগী আসে তার ক্লিনিকটিতে।
তিনি জানান, নিতান্ত চাকরি মনে করে তিনি কাজটা করেন না। সেবার মানসিকতা থেকে ভালো লাগার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
ক্লিনিক থেকে মা, নবজাতক ও অসুস্থ শিশুর সমন্বিত সেবা (আইএমসিআই), প্রজননস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা এবং সাধারণ আঘাতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। শিশু ও মায়েদের টিকাদানের ব্যবস্থা আছে। ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগ শনাক্ত করা হয়। স্বাস্থ্যশিক্ষার পাশাপাশি দেওয়া হয় পুষ্টিশিক্ষা। বয়স্ক, কিশোর–কিশোরী ও প্রতিবন্ধীদের লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দেওয়া হয়। ক্লিনিক থেকে ২৭ ধরনের ওষুধ ছাড়াও শিশুদের অণুপুষ্টিকণার প্যাকেট দেওয়া হয়।
হয়েছে ২৭ টি স্বাভাবিক প্রসব:
খালেদা আক্তার নামে এক মা এসেছেন তার মেয়েকে নিয়ে। মেয়ের মাথা ফেটে গিয়েছিলো, ক্লিনিকে আনলে সেলাই করে দেওয়া হয়। আজ সেই সেলাই কাটার দিন।
খালেদা আক্তার জানান, তার তিন সন্তান। তিন জনের প্রসবই এ ক্লিনিকে হয়েছে।
ক্লিনিকটির সিএইচসিপি মাকসুদুর রহমান জানান, কোনো ধরনের সিজারিয়ান অপারেশন ছাড়াই প্রশিক্ষিত কমিউনিটি বার্থ অ্যাটেনডেন্টের মাধ্যমে এখানে নিরাপদে ২৭ টি স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে।
ফেনী সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাসুদ রানা বলেন, এ ক্লিনিকটি স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে পুরো জেলায় মডেল। ক্লিনিকটির সিএইচসিপির আন্তরিকতার কারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।
অবকাঠামো উন্নয়ন হলে সেবা বাড়বে বহুগুণ:
কমিউনিটি ক্লিনিকটিতে যে পরিমাণের রোগী আসে তাদের সেবা দেওয়ার জন্য অবকাঠামো যা আছে তা যথেষ্ঠ নয়। ক্লিনিকটির সিএইচসিপি মাকসুদুর রহমান বলেন, একজন মায়ের প্রসব হওয়ার পরে তাকে রাখার জন্য একটা পোস্ট অপারেশন কক্ষ থাকার দরকার কিন্তু সেটি নেই। ক্লিনিকের জায়গা আছে এখানে যদি দোতলা বিশিষ্ট একটি ভবন করা যায় তাহলে আবাসিকে থেকে রোগীদের সেবা দেওয়া যেতো।
মাকসুদ বলেন, স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয়রা চাইলে সহযোগিতা করতে পারেন। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সব করা সম্ভব নয়। সীমাবদ্ধতা আছে। এ বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাখাওয়াত হোসেন শাকার সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি সেখানে একটি রুম করে দেব। এছাড়াও যে ভবনটা সেখানে বর্তমানে আছে তাও পুরনো, সেখানে একটি নতুন ভবনের দরকার। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে দেখব এ ক্লিনিকটির অবকাঠামো উন্নয়নে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
বাগানে রয়েছে ৫০ প্রজাতির ফুল-ফল গাছ:
ক্লিনিকটির কমিউিনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) মাকসুদুর রহমান পুরোপুরি নিজ খরচে ক্লিনিক আঙ্গিনায় তৈরি করছেন একটি বাগান। নানা ধরনের দেশি-বিদেশি ফুল ও ফলে সমৃদ্ধ তার বাগানটি। ইতোমধ্যেই সে বাগানটি নজর কেড়েছে স্থানীয়দের। প্রায় ৫০ প্রজাতির গাছ রয়েছে এ বাগানে। প্রতিদিন রোগী দেখা শেষ হলে তিনি বাগানের পরিচর্যা করেন।
বাগানটিতে রয়েছে ৫ প্রজাতির জবা ফুল। ২ প্রজাতির অলকানন্দা ফুল, ২ প্রজাতির মাধবীলতা ফুল, ২ প্রজাতির পত্র লেখা ফুল, ২ প্রজাতির কাটা মুকুট-২ প্রজাতির রুয়েলিয়া, বেলি, হাসনা হেনা রঙ্গন ফুলের ৪ প্রজাতি, গন্ধরাজের ২ প্রজাতি, কুঞ্জলতা শিউলী, ২ প্রজাতির অপরাজিতা, পুর্তুলিকা, ক্যালিয়াস গাঁদা, কসমস, চন্দ্রমল্লিকা, সন্ধ্যা মালতী, বাগান বিলাস, কাঠ গোলাপ। ফলের মধ্যে কাটিমন আম, ২ প্রজাতির পেয়ারা, লাল জামরুল, সবুজ জামরুল, লাল সফেদা, লেবু, ট্যাংক ফল। সৌজন্যে-বাংলা নিউজ
Discussion about this post