ডা. মশিউর রহমান খসরু
আর্থ্রাইটিস তথা বাতরোগ হলো এক বা একাধিক জয়েন্টের ফোলা ও ব্যথা। এর প্রধান লক্ষণ হল জয়েন্টে ব্যথা এবং তা শক্ত হওয়া। সাধারণত বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রকোপ বাড়ে। আর্থ্রাইটিসের সবচেয়ে সাধারণ ধরন হলো অস্টিওআর্থ্রাইটিস এবং রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস। এ ছাড়াও গাউট, সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস, এনকাইলোজিং স্পন্ডাইলাইটিস, রি-একটিভ-আর্থ্রাটিস, এন্টারোপ্যাথিক-আর্থ্রাইটিসসহ শতাধিক বাতরোগ আছে।
আজ ১২ অক্টোবর ‘বিশ্ব আর্থ্রাটিস দিবস’। বাতরোগের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সাল হতে প্রতি বছর দিনটি পালিত হচ্ছে। এই বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আর নয় দেরি, সম্পৃক্ত হই আজই: এখন সময় কাজের’।
অস্টিওআর্থ্রাইটিস একটি জয়েন্টের কার্টিলেজের ক্ষয়জনিত রোগ। কার্টিলেজ হাড়ের প্রান্তসমূহে অস্থিসন্ধির অভ্যন্তরে থাকে। এটি সন্ধির হাড়সমূহের ঘর্ষণ রোধ করে। কিন্তু জয়েন্ট কার্টিলেজের পর্যাপ্ত ক্ষতির ফলে হাড় সরাসরি হাড়ের ওপর পিষে যেতে পারে, যা ব্যথা তৈরি করে ও রোগীর চলাচলকে সীমাবদ্ধ করে।
এই প্রক্রিয়া অনেক বছর ধরে ঘটতে পারে। অথবা কোনও আঘাত বা সংক্রমণের দ্বারা ত্বরান্বিত হতে পারে। অস্টিওআর্থ্রাইটিস হাড়ের পরিবর্তন এবং সংযোগকারী টিস্যুর অবনতি ঘটায়। এটি হাড়ের সঙ্গে পেশী সংযুক্ত করে এবং জয়েন্টকে একসঙ্গে ধরে রাখে। যদি জয়েন্টে কার্টিলেজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে জয়েন্টের আস্তরণ ফুলে যেতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, পূর্ণবয়স্ক বাংলাদেশিদের মধ্যে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের প্রাদুর্ভাব ১০ শতাংশ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি বাড়ে। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসে, শরীরের ইমিউন সিস্টেম যৌথ ক্যাপসুলের আস্তরণ আক্রমণ করে, এটি হলো একটি শক্ত ঝিল্লি যা সমস্ত যৌথ অংশকে ঘিরে রাখে। এই আস্তরণ (সিনোভিয়াল মেমব্রেন) ফুলে যায়। এ রোগ শেষ পর্যন্ত জয়েন্টের মধ্যে কার্টিলেজ ও হাড় ধ্বংস করতে পারে।
আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকির কারণ
পারিবারিক ইতিহাস: কিছু আর্থ্রাইটিস বংশানুক্রমিক। বাবা-মা বা ভাইবোনদের হলে আপনারও বাতের আশঙ্কা থাকবে।
বয়স: অস্টিওআর্থ্রাইটিস, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং গাউটসহ অনেক ধরনের বাতের ঝুঁকি বয়সের সঙ্গে বাড়ে।
লিঙ্গ: নারীদের রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস হওয়ার আশঙ্কা পুরুষদের তুলনায় বেশি। আবার গাউট ও অন্য ধরনের আর্থ্রাইটিস আছে যেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের হয়।
আঘাত: যেসব ব্যক্তি জয়েন্টে আঘাত পেলে সেখানেও আর্থ্রাইটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন বহন করলে জয়েন্টগুলোতে, বিশেষ করে হাঁটু, নিতম্ব এবং মেরুদণ্ডে চাপ পড়ে। এ কারণে তাদের আর্থ্রাইটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। ওজন বহনকারী জয়েন্টের আর্থ্রাইটিস আপনাকে আরামে হাঁটতে দেবে না, ঠিকমতো সোজা হয়ে বসতেও দেবে না। কিছু ক্ষেত্রে, জয়েন্টগুলো ধীরে ধীরে স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারাতে পারে। অস্থিসন্ধির আকৃতি হারাতে পারে। এমনকি যথাযথ চিকিৎসা না করালে আক্রান্ত ব্যক্তিকে পঙ্গুও হয়ে যেতে পারে।
সাধারণত ১০০-এর বেশি অস্থিসন্ধির প্রদাহজনিত রোগের সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের কারণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন। প্রচলিত রোগগুলো হচ্ছে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস ও অস্টিও আর্থ্রাইটিস।
লক্ষণগুলো হচ্ছে— ব্যথা,অস্থিসন্ধির জড়তা এবং প্রদাহ। সময়মত পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার অভাবে অস্থিসন্ধি বাঁকা হতে পারে। এতে রোগীর কাজ-কর্ম ও স্বাভাবিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতি দারুণ সুফল বয়ে আনতে পারে।
একজন বাতরোগ বিশেষজ্ঞ ফিজিয়াট্রিস্ট এই সমন্বিত চিকিৎসা কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারেন। এ ছাড়া ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, রিহ্যাবিলিটেশান নার্স, প্রসথেটিস্ট ও অর্থোটিস্ট, নিউট্রিশনিস্ট, সমাজকর্মী, মেডিক্যাল সাংবাদিক ও কেয়ার গিভার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন।
সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থা আর্থ্রাটিস রোগীদের ব্যথামুক্ত সময় পার করতে, স্বাভাবিক কর্মক্ষম জীবনে ফিরে আসতে এবং বিকলাঙ্গতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
বাতরোগের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও গবেষণার লক্ষ্যে ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়-এর ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহাবিলিটেশন বিভাগে রিউম্যাটোলজি রিহ্যাবিলিটেশন ক্লিনিকের যাত্রা শুরু। প্রতি মঙ্গলবার সকাল ৯টা হতে দুপুর ১২:৩০টা পর্যন্ত বিনামূল্যে বাতরোগীদের সামগ্রিক চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সেবা প্রদান করা হয়।
এই বিশেষায়িত ক্লিনিকে ইতোমধ্যে তিন হাজারের বেশি বাতরোগীর চিকিৎসা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬টি গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। আরও ৬টি গবেষণা চলমান। এই ক্লিনিকের গবেষণা প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নালেও প্রকাশিত হয়েছে।
মানুষকে বাতরোগ ও অস্থিসন্ধির প্রদাহজনিত রোগের ব্যাপারে সচেতন করতে আজকের দিনটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। রোগী, চিকিৎসক, সংবাদকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, রোগীর স্বজন, ও নীতিনির্ধারক—সকলের সম্মিলিত প্রয়াস বাতরোগের জটিলতা মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও সমন্বয়ক, রিউম্যাটোলজি রিহ্যাবিলিটেশন ক্লিনিক, ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহাবিলিটেশন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post