হার্টবিট ডেস্ক
গতকাল ১০ অক্টোবর ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ উপলক্ষে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস (বিএপি) কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা জানান দেশে মোট জনসংখ্যার প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ মানসিক রোগে ভুগছে। তবে এ বিশালসংখ্যক মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় সাইকিয়াট্রিস্ট (মনোব্যাধির চিকিৎসক), সাইকোলজিস্টসহ (মনোবিজ্ঞানী) কর্মরত জনশক্তি অপ্রতুল।
এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএপির ট্রেজারার ডা. মেখলা সরকার।
২০২১ সালের মানসিক স্বাস্থ্য তথ্যচিত্র অনুযায়ী, দেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের মধ্যে মানসিক রোগের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। তার মধ্যে অতি উদ্বেগ (জেনারেলাইজড অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার) ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, বিষণ্নতা (ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার) ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, সোমাটিক সিম্পটম ডিজঅর্ডার ২ দশমিক ৩ শতাংশ, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, বাইপোলার ডিজঅর্ডার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ এবং সিজোফ্রেনিয়া রোগের হার শূন্য দশমিক ১ শতাংশ।
প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও এ রোগের হার অনেকটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রবন্ধে বলা হয়, শিশু-কিশোরদের মাঝে মানসিক রোগের হার ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার ৫ দশমিক ১ শতাংশ, কনডাক্ট ডিজঅর্ডার ১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং শিশু-কিশোরদের মধ্যে অতি উদ্বেগ ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
প্রবন্ধে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে মাদককে। দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মাদক গ্রহণের বিষয়ে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের মধ্যে মাদক গ্রহণের হার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। তাদের মধ্যে পুরুষের মাদক গ্রহণের হার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। নারীদের মধ্যে মাদক গ্রহণের হার শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। ১২-১৭ বছরের মধ্যে শিশু-কিশোরদের মাঝে মাদক গ্রহণের হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ, ৭-১১ বছরের মধ্যে শিশু-কিশোরদের মাঝে মাদক গ্রহণের হার শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।
বিশালসংখ্যক মানসিক রোগীর চিকিৎসায় দেশে জনবল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দেশে প্রতি ১ লাখ নাগরিকের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কর্মরত জনশক্তি মাত্র শূন্য দশমিক ৫০ জন। এর মধ্যে সাইকিয়াট্রিস্ট প্রায় ৩০০ জন (প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার জন্য শূন্য দশমিক ১৭ জন) ও সাইকোলজিস্ট ৫৬৫ জন (প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার জন্য শূন্য দশমিক ৩৪ জন)। দেশে সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার রয়েছেন ৭ জন (প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার জন্য শূন্য দশমিক ০০৪ জন), অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ৩২৪ জন (প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার জন্য শূন্য দশমিক ১৮ জন)।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাধারণ চিকিৎসক রয়েছেন ২০ হাজার ৯১৪ জন। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৯ হাজার ৪০০ স্বাস্থ্যকর্মী, মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক হাসপাতালে কর্মরত ৭০০ সেবিকা এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ২৭ হাজার ৪৩২ জন নার্স রয়েছেন।
এছাড়া, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৭২ জন ইমাম, দুর্যোগ পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ৬০ জন সাধারণ চিকিৎসক, ১৬৮ জন সরকারী স্বাস্থ্যকর্মী, ৭২ জন এনজিওকর্মী রয়েছেন। মেন্টাল হেলথ গ্যাপ অ্যাকশন প্রোগ্রামের (এমএইচজিএপি) প্ৰশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী আছেন ৪০০ জন, স্পিচ ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট রয়েছেন ১৭২ জন।
প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাও পর্যাপ্ত নয়। দেশে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় ইনস্টিটিউট আছে একটি (২০০ শয্যাবিশিষ্ট)। দেশে একটি মানসিক হাসপাতাল (পাবনায় ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট, প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার জন্য শূন্য দশমিক ৪টি), ৪০টি মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অন্তঃবিভাগ (৮১৩ শয্যা, প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার জন্য শূন্য দশমিক ৫৮ শয্যা), একটি শিশু কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অন্তঃবিভাগ (২০ শয্যা) রয়েছে।
এছাড়া, ২টি সাইকিয়াট্রিক চাইল্ড গাইডেন্স ক্লিনিক, ১০টি ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিক বিষয়ক শয্যা, ৪টি সরকারি ও ১৬৪টি বেসরকারি মাদকাসক্তি বিষয়ক চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারি খরচ স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ।
২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট কর্তৃক পরিচালিত মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মানসিক রোগের হার প্রায় ১৮ শতাংশ, শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে প্রায় ১৩ শতাংশ। এদের মধ্যে যথাক্রমে ৯২ শতাংশ ও ৯৪ শতাংশ চিকিৎসা নেয় না। বিপুল এ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা না নেওয়ার ক্ষেত্রে কারণসমূহ হলো সামাজিক মর্যাদাহানির ভয় (স্টিগমা), কুসংস্কার, অসচেতনতা, দারিদ্র্য ইত্যাদি। নানা ক্ষেত্রে অসমতা চিকিৎসা গ্রহণের অনিচ্ছা বা চিকিৎসাবঞ্চিত হওয়ার এ প্রবণতাকে আরও বেগবান করছে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ৭৫ থেকে ৯৫ শতাংশ মানুষ এখনো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে অক্ষম। কিন্তু এ অবস্থা উচ্চ আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে যে খুব ভালো, তা নয়। এ অবস্থার জন্য দায়ী মানসিক স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের অভাব এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের বাজেটের তুলনায় মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা বাজেটের ব্যবধান। বৈশ্বিক এ বৈষম্যের চিত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও অনেকাংশে বাস্তব।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, বাংলাদেশ প্রত্যেক নাগরিকের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণীত গ্লোবাল মেন্টাল হেলথ ইনিশিয়েটিভের অন্যতম অংশীদার হিসেবে এটিকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কাভারেজের একটি অংশে পরিণত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি বলেন, শতাব্দীপ্রাচীন ইন্ডিয়ান লুন্যাসি অ্যাক্ট বাতিল করে মানসিক স্বাস্থ্য আইন-২০১৮ প্রণয়ন করা বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এছাড়া মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিবন্ধী আইন ২০১৩ এবং স্নায়ুবিকাশজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩ এর মাধ্যমে একটি ট্রাস্ট স্থাপন করা হয়েছে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরকারের আন্তরিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
রোবেদ আমিন বলেন, জনগণের দোরগোড়ায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে নতুন পদ সৃষ্টির মাধ্যমে মানসিক রোগ বিভাগগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। জেলা হাসপাতালে পৃথক মানসিক স্বাস্থ্য ইউনিট স্থাপন সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে। আপামর জনগণের মাঝে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে প্রতি বছর ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হচ্ছে এবং পাবনা মানসিক হাসপাতালকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রাধিকারভুক্ত প্রকল্প, যার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস (বিএপি) জন্মলগ্ন থেকেই দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি, যোগ্য জনবল তৈরি, তৃণমূল পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং সরকারি মেডিকেল কলেজে নতুন নতুন পদ সৃজন করতে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস (বিএপি) করোনা মহামারির সময়ে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ পরামর্শের জন্য ফ্রি মোবাইল এবং অনলাইন চিকিৎসা সুবিধা চালু করেছে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) অধ্যাপক ডা. এম. ইকবাল আর্সলান, মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ, নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটি প্রোটেকশন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম রব্বানীসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
Discussion about this post