অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান
১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন আইপিজিএমআর (সংক্ষেপে পিজি) হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) কেন্দ্রীয় রক্ত সংরক্ষণাগার উদ্বোধন করতে আসেন। এটা ছিল পিজিতে বঙ্গবন্ধুর প্রথম সরকারি সফর। সেদিন পিজিতে একটি অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সেদিনের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আব্দুল মালেক উকিল আর পিজির তখনকার পরিচালক প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলাম। সেই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন প্রতিটি থানায় একটি করে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, দেশের ৪ শত ১৩টি থানায় ২৫ শয্যাবিশিষ্ট ৩ শত ৫৬টি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দেশের ৮টি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রসংখ্যা ৭ শত থেকে ১৩ শতে উন্নীত করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
আজ যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দেখি, সেটার মূল উদ্যোক্তা কিন্তু বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তিনি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার্থীর আসন সংখ্যা দ্বিগুণ করেছিলেন। অর্থাৎ প্রতিবছর দ্বিগুণ সংখ্যক চিকিৎসক তৈরি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া সে বছরই তিনি পিজি হাসপাতালের পাশের মুসলিম লীগের পরিত্যক্ত ভবনটি (ব্লক-বি) আইপিজিএমআরকে দেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পিজি হাসপাতালকে ৩০০ শয্যা থেকে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করেন।
কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন কেবল ভৌত অবকাঠামোর উন্নতি করেই একটি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করা সম্ভব নয়। সেদিনের অনুষ্ঠানে তিনি চিকিৎসক ও হাসপাতালের কর্মচারীদের প্রতি মানসিকতার পরিবর্তনের আহ্বান জানান। তিনি চিকিৎসকদের উদ্দেশে বলেন, চিকিৎসকগণ সমাজে বিশেষভাবে সম্মানিত। কিন্তু এই সম্মানের মর্যাদা রক্ষা করা চিকিৎসকদেরই কর্তব্য। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন যে, কোনও কোনও চিকিৎসক ব্যক্তিগত ক্লিনিকে যাইয়া রুগীরা ‘ফিস’ প্রদান না করিলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় না বলিয়া তিনি অভিযোগ শুনিয়াছেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামে চিকিৎসক সমাজের মহান অবদানের কথা উল্লেখ করিয়া বঙ্গবন্ধু রুগ্ন মানবতার কল্যাণে গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়াইয়া পড়ার জন্য চিকিৎসক সমাজের প্রতি আহ্বান জানান। যে সকল চিকিৎসক গ্রামে গমন করিতে অনীহা প্রদর্শন করিতেছেন তাঁহাদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, যাঁহারা কেবল নিজেদের স্বার্থ ও সম্মানের জন্য লালায়িত তিনি সেইসব উন্নাসিকের সহিত নহেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, যে লক্ষ কোটি মানুষের দুর্দশা ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করিয়াছি, আজ যদি আমরা তাহাদের দুঃখ-দুর্দশা মোচনে আগাইয়া না যাই, তাহা হইলে তাহারা আমাদের অভিসম্পাৎ দিবে। (৯ অক্টোবর ১৯৭২, দৈনিক ইত্তেফাক)
পরের দিন দৈনিক ইত্তেফাকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের চুম্বকাংশ বক্স আকারে প্রকাশ করা হয় প্রথম পৃষ্ঠায়। তাতে লেখা হয়,
বঙ্গবন্ধু বলেন
* চিকিৎসকদিগকে অবশ্যই মানবতার প্রতি সেবার আদর্শ মনে রাখিয়া কাজ করিতে হইবে;
* চিকিৎসা ক্ষেত্রে যাহারা নিয়োজিত রহিয়াছেন, তাহারা ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড বয় অথবা ঝাড়ুদারই হউক না কেন, তাহাদের প্রধান দায়িত্ব হইল রুগ্ন ব্যক্তির চিকিৎসা ও তাহার কষ্ট মোচন করা;
* হাসপাতালে কার্যরত প্রত্যেককেই যথার্থ সম্মান ও মর্যাদা দিতে হইবে;
* যে সমস্ত বাঙ্গালী চিকিৎসক আজ অর্থোপার্জনের আশায় বিদেশে রহিয়াছেন, তাঁহাদের উচিত স্বদেশে ফিরিয়া আসা। কারণ এই মনোভাব গুরুতর পাপ;
* দেশ গঠনের জন্য প্রত্যেককে সচেষ্ট হইতে হবে;
* উন্নত চরিত্র ছাড়া কোন জাতি বড় হইতে পারে না। সমাজকে দুর্নীতির রাহুগ্রাস হইতে মুক্ত করার জন্য চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে বাধ্য হইতে পারি;
* জনগণের প্রতি আমার ভালোবাসাকে দুর্বলতা মনে করিলে ভুল করা হইবে;
* যদি প্রত্যেকেই নিজেদের মানসিকতা পরিবর্তনে যত্নবান হন এবং মানুষকে মানুষ হিসাবে গণ্য করিতে পারেন, তবে দেশের উন্নতি অবশ্যম্ভাবী;
* হাসপাতালের উন্নতির জন্য ধনিক শ্রেণীকে মুক্তহস্তে দান করার জন্য অগ্রণী হইতে হবে।
বঙ্গবন্ধুর এই নয়টি উপদেশ আজও প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের প্রতিটি হাসপাতালের প্রবেশদ্বারে এই কথাগুলো বাঁধিয়ে রাখা উচিত। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাত ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। রাজকোষ উজাড় করে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন প্রতিটি হাসপাতালকে। থানায় থানায় (যা আজ উপজেলা) স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সময় পেয়েছিলেন বড় অল্প। তাঁর সুযোগ্য কন্যা তাঁর আরাধ্য কাজ সম্পাদন করছেন সফলভাবে। তিনি ইউনিয়নে ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিক করেছেন। দেশের বড় বড় সরকারি হাসপাতালে সর্বাধুনিক চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নত বিশ্বের সমমানের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে বিদেশে যাচ্ছেন। এদের অধিকাংশেরই দেশে চিকিৎসা করা সম্ভব। শুধু রোগীদের আস্থার অভাবের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে।
প্রায় অর্ধশতক পরে এসে আমাদের বঙ্গবন্ধুর কথায় ফিরে যেতে হচ্ছে। গুটিকয়েক চিকিৎসকের নেতিবাচক মানসিকতার জন্য পুরো স্বাস্থ্যখাত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাই তাঁদের মানসিকতা পরিবর্তনে জোর দিতে হবে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে মানুষের। তবে গত দুবছরে বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা বেশ সফলভাবে সেটা করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয়। অতিমারির কারণে রোগীরা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বিদেশ যেতে পারেননি। তাঁরা দেশে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসা নিয়েছেন। এতে সাফল্যের হার বেশি বলে কোথাও কোনও অভিযোগের খবর চোখে পড়েনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি অনেক বিত্তশালী রোগী দেশে চিকিৎসা নিয়ে বিস্মিত হয়েছেন। তাঁরা ভাবতেও পারেননি বাংলাদেশে এই মানের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এখন সময় সেই আস্থা ধরে রাখার। এটা সম্ভব হলে কেবল চিকিৎসা খাত সমৃদ্ধ হবে না, সবল হবে দেশের অর্থনীতি।
৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ওই ঐতিহাসিক বক্তব্যকে স্মরণীয় করে রাখতে দিনটিকে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি উপদেশ হোক এ দেশের চিকিৎসক সমাজের পাথেয়।
লেখক : অধ্যাপক, হৃদরোগ বিভাগ এবং হল প্রোভোস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
Discussion about this post