শরীরে পানি জমলে বা শরীর ফুলে গেলে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। শরীর ফোলা বা পায়ে পানি আসার নানা কারণ আছে। অনেক সময় এটা জটিল কোনো সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। আবার সুস্পষ্ট কোনো কারণ ছাড়াও এ রকম হতে পারে।
পায়ে পানি জমলে প্রাথমিকভাবে যেসব কারণ মনে করা হয় সেগুলো হলো—হৃদ্যন্ত্রের কার্যকারিতা কমে যাওয়া, লিভার অথবা কিডনির সমস্যা, থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা, অপুষ্টি, নানা রকম ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। পানি জমলে রোগ শনাক্তের জন্য চিকিৎসক উপসর্গ বুঝে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন।
তবে কিছুসংখ্যক রোগী, বিশেষত নারীরা, দীর্ঘদিন শরীরে পানি জমার সমস্যায় ভোগেন, কিন্তু নানারকম পরীক্ষার পরও কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা রোগ ধরা পড়ে না। তখন চিকিৎসকেরা একে ফ্লুইড রিটেনশন সিনড্রোম অথবা ইডিওপ্যাথিক ইডিমা বলে থাকেন।
ফ্লুইড রিটেনশন সিনড্রোম
হৃদ্রোগ, যকৃৎ বা কিডনি রোগের অনুপস্থিতিতে পানি জমে মুখ, হাত, পা ও শরীর ফুলে যাওয়ার সমস্যা হয় এই সিনড্রোমে। এটি সাধারণত প্রি–মেনোপজাল নারী বা যাঁদের এখনও মাসিক চলছে, এমন নারীর মধ্যে দেখা যায়। বেশির ভাগ রোগীর বয়স ২০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। এই সমস্যাটি শিশু ও পুরুষের মধ্যে বিরল। অনেক সময় একই পরিবারের অনেককে এই সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়। ডায়াবেটিস, স্থূলতা, মানসিক সমস্যা (বিষণ্নতা ও নিউরোটিক সমস্যা), ওজন কমানোর জন্য মূত্রবর্ধক বা ল্যাক্সেটিভস ব্যবহারের সঙ্গে এই সিনড্রোমের সম্পর্ক রয়েছে।
লক্ষণ
রোগী সাধারণত মুখ, হাত, স্তন, পেট এবং পা ফুলে যাওয়ার অভিযোগ করে থাকেন, যা দিন গড়ানোর সঙ্গে আরও বাড়ে। সঙ্গে মাথাব্যথা, দৃষ্টি ঝাপসা, খিটখিটে মেজাজ, উদ্বেগ, ক্ষুধামান্দ্য, বিষণ্নতা, অনিদ্রা, পেশির ব্যথা থেকে পেটে ব্যথা ও ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন উপসর্গ থাকতে পারে। এ ছাড়া ক্লান্তি এবং দুর্বলতার লক্ষণগুলোও থাকে। বেশির ভাগ নারীর মাসিকের ঠিক পূর্ববর্তী সময়ে উপসর্গগুলো দেখা দেয়। সাধারণত দৈনিক ১ দশমিক ৪ থেকে ৬ কেজি পর্যন্ত ওজনে পরিবর্তন দেখা যেতে পারে এই পানি জমার কারণে। এমন হতে পারে, বিকেলের দিকে স্যান্ডেল বা জুতা পরতে অসুবিধা হয়।
যেভাবে শনাক্ত হবে
ইডিওপ্যাথিক এডিমা বা ফ্লুইড রিটেনশন সিনড্রোম রোগ নির্ণয় করার জন্য আগে প্রমাণ করতে হবে যে পানি জমার অন্য কোনো গুরুতর কারণ নেই। যখন সিবিসি, ইউরিন টেস্ট, বুকের এক্স-রে, ইসিজি, হরমোন, পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম, হার্টের ইকো-কার্ডিওগ্রাম, অ্যালবুমিন স্বাভাবিক থাকে এবং কার্ডিয়াক, হেপাটিক বা রেনাল রোগের কোনো প্রমাণ মেলে না, শুধু তখনই এই সমস্যা হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।
কী করবেন
১. লবণ কম খাওয়া
প্রতিদিনের খাবারে সোডিয়ামের পরিমাণ কমিয়ে দিন। পাতে আলাদা লবণ খাবেন না; অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার, যেমন প্রক্রিয়াজাত খাবার, সসেজ, তৈরি (রেডিমেড) নুডলস, চিপস, ফাস্ট ফুড পরিহার করুন। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন দৈনিক ২ হাজার ৩০০ মিলিগ্রামের বেশি লবণ খেতে নিরুৎসাহিত করেছে। আরও ভালো হয় যদি ১ হাজার ৫০০ মিলিগ্রামে সীমাবদ্ধ থাকতে পারেন।
২. পা উঁচু করে রাখা
ঘুমানোর সময় পা বালিশের ওপর রাখতে হবে। বসা বা শোয়া অবস্থায় পা হার্ট লেভেলের ওপরে রাখলে ফোলা কমে যাবে।
৩. ব্যায়াম
পায়ের মাংসপেশি ব্যবহার করলে তরল সরে গিয়ে ফোলা কমে যায়। তাই নিয়মিত ব্যায়াম করলে পায়ের ফোলা প্রতিরোধ হতে পারে। ব্যায়াম করতে কষ্ট হলে বা ব্যথা লাগলে সাঁতার কাটার মতো নন-ওয়েট-বিয়ারিং এক্সারসাইজ করতে পারেন।
৪. মূত্রবর্ধক ওষুধ ব্যবহারে সতর্কতা
অনেক সময় মূত্রবর্ধক অথবা ডায়উরেটিক ওষুধের প্রয়োজন হয়। সর্বনিম্ন কার্যকর ডোজ ব্যবহার করা উচিত এবং সকালে দেওয়া উচিত, যেহেতু এডিমা প্রাথমিকভাবে দিনের বেলায় জমা হয়।
৫. শর্করা
শর্করাজাতীয় খাবার কম খেলে অনেক সময় উপকার পাওয়া যায়।
৬. কিছু ওষুধ
জীবনযাত্রায় এসব পরিবর্তনে উন্নতি না হলে, অন্য কিছু ওষুধের প্রয়োজন হতে পরে। যেমন: ব্রমোক্রিপটিন, কারভিডোপা ও এসিআই গ্রুপের ওষুধ। তবে ওষুধ সেবন করতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে।
লেখক: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, পপুলার মেডিকেল কলেজ, ঢাকা
Discussion about this post