হার্টবিট ডেস্ক
প্রাণঘাতী করোনা মহামারী শিশুদের শারীরিকভাবে কম ঘায়েল করলেও তছনছ করে দিয়েছে তাদের মনোজগৎ। করোনার জাঁতাকলে পড়ে শিশুরা ঘরবন্দি ও বন্ধুহীন হয়ে পড়ায় তাদের আচরণগত বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এমন প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু দিবস। প্রতিবছর অক্টোবরের প্রথম সোমবার বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় শিশু দিবস। সেই সঙ্গে একই দিন থেকে শুরু হয় শিশু অধিকার সপ্তাহ। এই দিবস ও সপ্তাহ উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে আজ থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ি’।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত মারা যাওয়া রোগীর মধ্যে ২০ বছরের নিচে মারা গেছে ২৫২ জন, যা মৃত্যুহারের ০.৯৫ শতাংশ। আক্রান্তও হয়েছে তুলনামূলক কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহামুদুর রহমান বলেন, করোনার প্রভাবে শিশুদের আচরণগত বড় পরিবর্তন ঘটেছে। শিশুদের সঙ্গে মা-বাবা কিংবা পরিবারের অন্যদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। শিশুদের ঘুমের সময়, রুটিন সব কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। ডিভাইস অ্যাডিকশনে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে বেশির ভাগ শিশু। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বেড়ে গেছে বিষণ্নতার মাত্রা। ওই বিশেষজ্ঞ উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আমি দেখেছি, অনলাইন ক্লাস করতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী নিজের বাসার পরিবেশ নিয়েও উৎকণ্ঠা ও হীনম্মন্যতায় ভুগছে। অনেকে ল্যাপটপ ব্যবহারের সক্ষমতা না থাকা কিংবা দামি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না পারায় নেটওয়ার্ক কিংবা ছবি ভালো না আসা নিয়েও মানসিক সমস্যায় ভুগছে।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু শিশুদের মনোজগতে বড় ধরনের আঘাত লেগেছে, সেটা সহজে স্বাভাবিক হবে না। এমনকি করোনা চলে গেলেও এই ক্ষত সারতে অনেক সময় লাগবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ধরে শিশুদের মানসিক বিকাশ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে কাজ করতে হবে। এখনকার আচরণের জন্য কোনোভাবেই তাদের দোষারোপ করা যাবে না বা তাদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করা যাবে না।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ খান বলেন, কভিডে শিশু ও বয়ঃসন্ধিকালীনদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে দেশ-বিদেশে অনেক গবেষণা হয়েছে। বাংলাদেশে কভিডের আগে ও মহামারির সময় শিশুদের ওপর প্রভাব নিয়ে এক সমীক্ষার তুলনামূলক ফলে দেখা যায়, চার থেকে ১০ বছর বয়সীদের মধ্যে হাইপার রি-অ্যাক্টিভিটি প্রায় দ্বিগুণ বা ৪.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪.৭ শতাংশে, কন্ডাক্ট ডিস-অর্ডার ১৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশে, ইমোশনাল ডিস-অর্ডার ৪.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৮.১ শতাংশে, অন্যান্য মানসিক সমস্যা ১৮.১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫.৫ শতাংশে উঠেছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের আরেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহম্মেদ বলেন, ‘আমরা কয়েকজন মিলে কভিডের প্রভাবে শিশুদের আবেগ ও আচরণজনিত পরিস্থিতি দেখতে আরেকটি সমীক্ষা করেছি। এতে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ২১.৫ শতাংশ শিশুর মধ্যে ক্ষতিকর মাত্রায় আবেগ ও আচরণগত পরিবর্তন হয়েছে।’
এদিকে করোনা শুরুর পর ইউনিসেফের উদ্যোগে শিশুদের নিয়ে গবেষণার ফলে বলা হয়, বিশ্বের ১৮৮টি দেশে লকডাউন বা অন্যান্য কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের কারণে ১০৬ কোটির বেশি শিশু ও তরুণ শিক্ষাক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীর তিনজনে একজন অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৪৬ কোটি শিশু অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। করোনার কারণে শিশুর অপুষ্টির হারও বাড়ছে। পাশাপাশি এই মহামারিতে শিশুদের ওপর নির্যাতন, সহিংসতা দুর্ব্যবহারও বেড়েছে।
Discussion about this post