ড. আ. স. ম. মঞ্জুর আল হোসেন
ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশের সাফল্য আকাশচুম্বী। সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমের তথ্যমতে,গত অর্থবছরে দেশে ২৭ হাজার কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়েছে। দেশের মানুষের ওষুধের এই বিশাল চাহিদা দেশীয় কোম্পানিগুলো অত্যন্ত সফলতার সাথে মিটিয়ে যাচ্ছে,এটি যেমন নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী ঘটনা, তেমনি একটি আশঙ্কাজনক বিষয় হচ্ছে, মানুষের রোগ আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া।
ওষুধের বাজার যে তিনটি থেরাপিউটিক ক্লাসের উপর ভর করে বড় হচ্ছে, তা হলো অ্যাসিডিটি, অ্যান্টিবায়োটিক ও ডায়াবেটিস, যা মোট ওষুধ বাজারের এক চতুর্থাংশ (২৫%)।
ওষুধ শিল্পের বাজার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, অ্যাসিডিটির ওষুধ মোট বিক্রিত ওষুধের ১৩.১৫ শতাংশ,অ্যান্টিবায়োটিকের অংশ ৬.৬৬ শতাংশ এবং ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে এ হার ৬.৫৩ শতাংশ। এ তথ্য থেকে সহজে বোঝা যায় যে, আমাদের দেশে গ্যাস্ট্রিক ও ডায়াবেটিসের রোগী আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এছাড়াও রোগীরা বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত, যার ফলে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অত্যন্ত বেশি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশে কেন গ্যাস্ট্রিক ও ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এবং অ্যান্টিবায়োটিকের উচ্চ ব্যবহার পরিলক্ষিত হচ্ছে?স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত ও সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণার তথ্যমতে, মানুষের খাদ্যাভ্যাস (প্রক্রিয়াজাত ও জাঙ্ক খাবারের প্রতি অতি নির্ভরশীলতা এবং ভেজাল খাবার),অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং ওষুধের অপ্রয়োজনীয় প্রয়োগ এ ধরনের সমস্যা বৃদ্ধির অন্যমত কারণ।
ওষুধের বাজার যে তিনটি থেরাপিউটিক ক্লাসের উপর ভর করে বড় হচ্ছে, তা হলো অ্যাসিডিটি, অ্যান্টিবায়োটিক ও ডায়াবেটিস, যা মোট ওষুধ বাজারের এক চতুর্থাংশ (২৫%)।
ভোজনরসিক বাঙালিরা দৈনন্দিন জীবনে তিন বেলা বড় খাবার গ্রহণ করে থাকে—সকাল,দুপুর ও রাত। এ খাবারগুলো মুখরোচক করার জন্য অত্যন্ত তেল ও মসলা দিয়ে প্রস্তুত করা হয়ে থাকে, যেটি সাধারণ মানুষের অ্যাসিডিটির অন্যতম কারণ। এছাড়া খাদ্য তালিকায় সবুজ শাক সবজির পরিবর্তে আমরা অ্যানিম্যাল ফ্যাট ও প্রক্রিয়াজাত খাবার (বার্গার,পিৎজা,চিকেন ফ্রাই ইত্যাদি) বেশি গ্রহণ করছি,যেটি আমাদের ওজন বাড়াতে সহায়তা করছে।
স্থূলতা ডায়াবেটিস রোগের আক্রান্ত হওয়ার একটি কারণ। শারীরিক পরিশ্রম না করা এবং রাতে খাওয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ার মতো বদভ্যাস আমাদেরকে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার দিকে ধাবিত করছে।
সম্প্রতি অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ও অপব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির ক্ষেত্রে বাজার নিয়ন্ত্রণ তদারকি সংস্থার দুর্বলতা,এ সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করেছে।
অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার একদিকে যেমন মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে,অন্যদিকে নানা রকম রোগের ঝুঁকি ও তৈরি করছে।
বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেশে অনিয়ন্ত্রিত ওষুধের প্রয়োগ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এ দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। তাদের ডাক্তারের কাছে ফি দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে দেখানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা নেই। তাই তারা ওষুধের দোকানদারদের কাছে গিয়ে তাদের সমস্যার কথা বলে ওষুধ ক্রয় করছে।
ওষুধ বিক্রেতারাও অধিক মুনাফার লোভে অ্যান্টিবায়োটিকের মতো ওষুধও প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি করছে। শুধু তাই নয় অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ না করলে কী ভয়াবহতা হতে পারে, সেটি সম্পর্কেও তারা রোগীকে অবহিত করছে না। রোগীরা অ্যান্টিবায়োটিক দুই-এক দিন সেবন করে সুস্থতা অনুভব করলে পুরো কোর্সটি আর সম্পন্ন করছে না। ফলে দেশে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকির বিষয়ে আশঙ্কার কথা প্রকাশ করছেন।
অ্যাসিডিটি ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে স্বাস্থ্য খাতের সাথে জড়িত ডাক্তার,ফার্মাসিস্ট,
ভোজনরসিক বাঙালিরা দৈনন্দিন জীবনে তিন বেলা বড় খাবার গ্রহণ করে থাকে—সকাল, দুপুর ও রাত। এ খাবারগুলো মুখরোচক করার জন্য অত্যন্ত তেল ও মসলা দিয়ে প্রস্তুত করা হয়ে থাকে, যেটি সাধারণ মানুষের অ্যাসিডিটির অন্যতম কারণ।
নার্স,ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও ফার্মেসি টেকনিশিয়ানদের (ওষুধের দোকানদার) পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সচেতনতা এ সমস্যা সমাধানে কার্যকারী ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে কিছু সুপারিশ তুলে ধরছি—
১.সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। সময়মতো সুষম খাদ্য গ্রহণ ও শারীরিক ব্যায়াম অ্যাসিডিটি ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করে। এছাড়া যথাসম্ভব দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শহর অঞ্চলে পরিবারের স্বামী/স্ত্রী দুজনে চাকরি বা পেশার সাথে জড়িত থাকেন। সেক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রতি তাদের সন্তানরা নির্ভরশীল,যেটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। তাই এই বিষয়ে পারিবারের বাবা/মা’র মনযোগী হওয়ার প্রয়োজন।
২.ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ওষুধ বিক্রির জন্য নানা ধরনের কৌশল গ্রহণ করে থাকে। এক্ষেত্রে ডাক্তারদের ওষুধ লেখার সময় সততা বজায় রাখতে হবে অর্থাৎ ‘কোড অব ইথিকস’ মেনে চলতে হবে।
৩.ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি রোধে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে রেডিও টেলিভিশনে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে জনগণকে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণে নিরুৎসাহী করতে হবে। কেননা অপ্রয়োজনীয় গ্যাস্ট্রিক ওষুধ গ্রহণে ভবিষ্যতে তাদের শরীরে আয়রন,ভিটামিন ও ম্যাগনেসিয়াম এর অভাব দেখা দিতে পারে। যার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে ও কিডনিতে মারাত্মক সমস্যা পরিলক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৪.ওষুধ সম্পর্কে কার্যকরী জ্ঞান রাখেন ফার্মাসিস্টরা। তাই ওষুধের অপব্যবহার রোধে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর ন্যায় দেশের সকল সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদায় ‘এ’ গ্রেড ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিতে হবে। এটি কার্যকর হলে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার প্রতিরোধ সম্ভব।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল ও ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স ফর হেলথ এর উদ্যোগে সারাদেশে ফার্মেসি টেকনিশিয়ানদের (ওষুধের দোকানদার) ট্রেনিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এ ট্রেনিং কার্যক্রমের মাধ্যমে ফার্মেসি টেকনিশিয়ানদের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি (বিশেষত অ্যান্টিবায়োটিক) না করতে যে বিধিবিধান আছে তা মেনে চলার বিষয়ে তাদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ওষুধ গ্রহণে রোগীরা তাদের কাছে আসলে রোগীরা যাতে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করে সে বিষয়েও দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
দেশের জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে জনগণের স্বাস্থ্য সচেতনতার পাশাপাশি ওষুধের অপব্যবহার রোধ করতে হবে। তা না হলে শরীরে ওষুধের কার্যকারিতা কমে আসবে এবং দেশের জনগণ এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।
ড. আ. স. ম. মঞ্জুর আল হোসেন ।। সহকারী অধ্যাপক,ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post