হার্টবিট ডেস্ক
সাম্প্রতিক সময়ে শিশুদের মধ্যে হঠাৎ জ্বর, পেট ব্যথা, বমি ও ডায়রিয়ার লক্ষণ অনেকটা বেড়েছে। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের কাছে আসা শিশুদের বড় একটি অংশই এ ধরনের সমস্যা নিয়ে আসছে। জ্বরের সঙ্গে পেট ব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা নিয়ে আসা শিশুর সংখ্যা বেড়েছে শিশু হাসপাতালেও। কোভিড-১৯ কিংবা ডেঙ্গু সংক্রমণে শিশুরা যে পরিমাণে আক্রান্ত হয়নি, তার চেয়ে যেন বেশি শিশুর মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে এই সমস্যাগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছুটা ভিন্ন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা দেখা দিচ্ছে এবার। সাধারণত মৌসুম পরিবর্তনের কারণে শিশুরা বিভিন্ন ধরণের জ্বর আক্রান্ত হয়ে থাকে। ডেঙ্গু ও কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার পরে সংক্রমণ শনাক্ত না হলেও শিশুদের মধ্যে এবারের লক্ষণগুলোতে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। তবে এবার একবার জ্বর কমে যাওয়ার পরেও আবার জ্বর ফিরে আসছে। এটি কোনো ভাইরাসের কারণে হতে পারে। আসলে ঠিক কোন কারণে এমনটা হচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
এছাড়া রাজধানীর শিশু হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, বহির্বিভাগে অভিভাবকরা শিশুদের নিয়ে আসছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশুদের উপসর্গ প্রায় একই রকম। জ্বর দিয়ে শুরু। এরপর পেট ব্যথা, পাতলা পায়খানাসহ বমি করতে থাকে শিশু। জ্বর একবার কমে এলেও সেটি ফের ফিরে আসছে।
রাজধানীর শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. রিজওয়ানুল আহসান বলেন, আমাদের দেশ বা বিশ্ব পরিস্থিতিও যদি বিবেচনা করা হয়, তবে মৌসুম পরিবর্তনের সঙ্গে জ্বর আসাটা স্বাভাবিক। আমাদের হাসপাতালে এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে শিশুরা তুলনামূলকভাবে কম ভর্তি হচ্ছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে জ্বর, পেট ব্যথা নিয়ে শিশুদের ভর্তি হতে হচ্ছে। একবার জ্বর সেরে যাওয়ার পরে আবার জ্বর ফিরে আসতে দেখা যাচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে।
প্রায় একই দৃশ্য দেখা গেছে মাতুয়াইল শিশু মাতৃসদন হাসপাতালেও। নিয়মিতভাবে অন্যান্য রোগীর পাশাপাশি এখানে বর্তমানে জ্বর, সর্দি, পেট ব্যথা ও পাতলা পায়খানার উপসর্গযুক্ত শিশুদের নিয়ে হাসপাতালে আসছেন অভিভাবকরা। রাজধানীর একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও দেখা যায় প্রায় একই অবস্থা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা ডেঙ্গু ও কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের পরীক্ষা করাচ্ছেন। এগুলো ফলাফল নেগেটিভ পেলে শরণাপন্ন হচ্ছেন চিকিৎসকের।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
এ বিষয়ে শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর বলেন, আমি উত্তরায় যত রোগী দেখি তার ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে আমি শিশুদের মাঝে ডেঙ্গুর লক্ষণ পাচ্ছি, নমুনা পরীক্ষার পর তাদের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণ শনাক্তও হচ্ছে। পাশাপাশি ভাইরাল ফিভার ও কিছু ক্ষেত্রে আনক্লাসিফায়েড ফিভার দেখতে পাচ্ছি। শিশুদের দেখা যাচ্ছে, এবারের ভাইরাল ফিভার একবার জ্বর কমে এলে পরে সেটি আবার ফিরে আসছে তিন থেকে চার দিন পর। বিভিন্ন প্যাটার্নের রোগী দেখা যাচ্ছে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের মাত্রা কমে আসলেও আমাদের দেশে এখন ভিন্ন মাত্রার কিছু জ্বর দেখা যাচ্ছে।
ডা. জাহাঙ্গীর আরও বলেন, টাইফয়েডের কিছু কেস পাচ্ছি। এটা কিন্তু বাংলাদেশে সবসময়ই থাকে। তবে এবার কিছু নতুন ভাইরাস সম্ভবত আছে, গবেষণা ছাড়া যা নিয়ে কিছু বলাটা কঠিন।
জানতে চাইলে শিশু বিশেষজ্ঞ ও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. সহিদুল্লাহ বলেন, একজন শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে এখন আমি নিজেও অনেক রোগী পাচ্ছি যাদের জ্বর, সর্দি, কাঁশি, পেট ব্যথা বা অন্যান্য উপসর্গ নিয়ে আসছে। তাদের মাঝে আবার অনেকে কোভিড-১৯ সংক্রমিত ছিল আগে, কিন্তু এখনো জ্বরে ভুগছে। অনেকে আবার ডেঙ্গু টেস্টও করিয়ে আনছে। আর আমরাও প্রয়োজন মনে করলে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে আনতে বলি সন্দেহমুক্ত থাকার জন্য।
তিনি বলেন, এবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ঠিক তিন থেকে চার দিনের পরে জ্বর কমে যাচ্ছে। কিন্তু ঠান্ডা-কাশি থেকে যাচ্ছে কিছুদিন। এটি এক ধরনের টিপিক্যাল ভাইরাল ফিভার। গত দুই থেকে তিন সপ্তাহে এই ভাইরাল ফিভারে আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটা বেড়েছে। আসলে শিশুদের কিছু অসুখ-বিসুখ হবেই। সবকিছু তো আর ঠেকানো যাবে না। তবে কোভিড বা ডেঙ্গুর চেয়ে অন্য সাধারণ জ্বরে আক্রান্ত হলে শিশুদের জন্য তেমন আতঙ্কের কিছু নেই। তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
এ পরিস্থিতিতে শিশুদের সাবধানে রাখতে কী করণীয়— জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর বলেন, শিশুদের জ্বর হলে কিছু স্বাভাবিক করণীয় থাকে, যেগুলো প্রাথমিক ধাপেই অনুসরণ করা প্রয়োজন। যেকোনো জ্বরের প্রাথমিক ধাপই হচ্ছে সেটাকে কমানো। এক্ষেত্রে বেশি পানি পান করানোর পাশাপাশি তরল খাবার বাড়াতে হবে। কারও ডেঙ্গু হয়ে থাকলেও ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট জরুরি। মোট কতা, পানি ও তরল খাওয়ানোটাই শুরু করে দিতে হবে। প্রথম ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া না হলে খুব ভালো। এই সময়টায় দেখতে হবে জ্বর কমে কি না। বাচ্চাদের গা ভেজা কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দেওয়াটাও জরুরি। মায়েরা প্রাথমিকভাবে এগুলো করে নিতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু সংক্রমণও কিন্তু এখন স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে কিছু পরীক্ষা করানো যেতে পারে। তবে তা সময়ের ওপরে নির্ভর করবে। ডেঙ্গু এনএস১ আমরা প্রাথমিকভাবে করিয়ে থাকি। এটি তিন দিনের মধ্যে করানো হয়। এরপর কোনো টেস্ট না করালে ছয় দিনের পরে আমরা আইজিএম (IgM) করাই। এছাড়াও আইজিজি (IgG) টেস্টও করানো হয়। তবে সবগুলোই চিকিৎসকের পরামর্শে করানো ভালো। কারণ সময় এক্ষেত্রে একটা বিবেচনা করার মতন বিষয়। উল্টোপাল্টা হলে সঠিক ফলাফল জানা যাবে না।
জানতে চাইলে শিশু বিশেষজ্ঞ ও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. সহিদুল্লাহ বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে অবশ্যই। তবে এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রথম ৪৮ ঘন্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষা করে যদি জ্বর না কমে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার জন্য কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতালে গেলে সেখানে বাচ্চাসহ অভিভাবকদের কোভিড-১৯ সংক্রমণমুক্ত থাকার জন্য মাস্ক পরে স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মানতে হবে।
শিশুদের মধ্যেকার এই জ্বর নিয়ে আতঙ্কিত না হলেও এই জ্বরের প্রকৃত প্রকৃতি জানতে গবেষণার তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ডা. জাহাঙ্গীর বলেন, অবশ্যই এটি নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। ডেঙ্গু বা করোনার বাইরেও শিশুরা কোনো ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে কি না, গবেষণা না হলে সেটি সঠিকভাবে জানা যাবে না।
Discussion about this post