হার্টবিট ডেস্ক
দেশে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। তবেএরই মধ্যে সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হলো হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে কম বয়সী তরুণ-তরুণীরাও। গবেষণা বলছে- বাংলাদেশে প্রতি ৫ জন তরুণের মধ্যে ১ জন হৃদরোগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ক্ষতিকর চর্বিজাতীয় খাবার, কোল্ড ড্রিংকস, তামাক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনকেই কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞজনেরা। পাশাপাশি বিষয়টিকে খুবই উদ্বেগজনকও বলে মনে করছেন তারা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এনসিডি কান্ট্রি প্রোফাইল ২০১৮ অনুসারে, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৩০ শতাংশের পেছনে দায়ী হৃদরোগ। সংখ্যার হিসেবে যা প্রায় পৌনে ২ লাখ। অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের হিসাবে, প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে হৃদরোগে ১ কোটি ৮৬ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার এ বিষয়ে বলেন, আমরা অল্প বয়সেরও অনেক রোগী পাচ্ছি যাদের বয়স ৩০ বছরের নিচে। সাধারণত এ ধরনের রোগী আমরা আগে পেতাম না। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পাচ্ছি। আমাদের কাছে হৃদরোগ নিয়ে যে রোগী আসে, সেগুলোর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশের বেশিই তরুণ-যুবকদের পাচ্ছি। যা গত ৩/৪ বছর আগেও ছিল ৫ শতাংশের কম। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেটি ৫ থেকে ২০ শতাংশের ওপরে চলে এসেছে।
তরুণরা হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে- এটি আমাদের জন্য একটি ভাবনার বিষয়। তরুণ সমাজ যদি এভাবে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে তাহলে আজ থেকে ৫০ বছর বা ১০০ বছর পর আমরা সুস্থ তরুণ সমাজ পাব না। এটি কিন্তু পুরো জাতির জন্য বা জাতি গঠনের জন্য এই জায়গায় গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি, যোগ করেন ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার।
সচেতনতার তাগিদ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, তরুণদের হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরালোভাবে করা দরকার। আপনাদের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে আমি অনুরোধ করছি, সবাই যেন এই হার্ট অ্যাটাকের বিষয়টি তুলে ধরে। আর যদি আমরা সঠিকভাবে তুলে ধরতে না পারি, যুব সমাজকে সচেতন করতে না পারি, তাহলে একসময় যুবসমাজ আমাদের থেকে হারিয়ে যাবে। তখন জাতি হিসেবে দেশের অনেক বড় ক্ষতি হবে।
এসব প্রসঙ্গে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে রোগীদের যে বয়সে হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে- এটা অপেক্ষাকৃত কম বয়সে হচ্ছে। আমরা যদি ওয়েস্টার্ন পপুলেশনের দিকে তাকাই, ওখানে সাধারণত দেখি ৬০ বছর বয়স থেকে প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ৫০ বছরের কম বয়সী অসংখ্য ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। এটা হচ্ছে এভারেজ, কিন্তু এর নিচে ৩০-৪০ বছর বয়সেও অনেক বেশি হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে। এজন্যই আমরা দেখছি যে বাংলাদেশে অপরিণত বয়সে মৃত্যু হচ্ছে ২২ শতাংশ। অথচ এই অপরিণত বয়সে অসংক্রামক রোগ কিন্তু হওয়ারই কথা ছিল না।
আমরা যদি জাপানের সঙ্গে তুলনা করি, জাপানের মানুষ অনেক বেশি বয়স পর্যন্ত বাঁচে। ওখানে মাত্র ৪ শতাংশ মানুষের অপরিণত বয়সে মৃত্যু হয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আমাদের দেশে অনেক কম বয়সী লোকজন হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে, যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে রোগীদের যে বয়সে হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে- এটা অপেক্ষাকৃত কম বয়সে হচ্ছে। আমরা যদি ওয়েস্টার্ন পপুলেশনের দিকে তাকাই, ওখানে সাধারণত দেখি ৬০ বছর বয়স থেকে প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়। কিন্তু আমাদের দেশে ৫০ বছরের কম বয়সী অসংখ্য ব্যক্তির হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। এটা হচ্ছে এভারেজ, কিন্তু এর নিচে ৩০-৪০ বছর বয়সেও অনেক বেশি হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে।ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী
১৫ বছরে হার্ট অ্যাটাক হওয়া প্রসঙ্গে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, আমাদের দেশে সাধারণত সর্বনিম্ন ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে। তবে ১৫ বছরের মধ্যে যদি হার্ট অ্যাটাক হয়, তাহলে হয়তো বা অন্যকোনো কারণ থাকতে পারে। যেমন- এটি হতে পারে পারিবারিক জিনগত কারণ। সাধারণত কম বয়সে যাদের এই রোগ হয়, তাদের অনেকটাই জিনগত কারণ থাকে। সেক্ষেত্রে তারও হয়তো এমনটি হতে পারে।
হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগের কারণ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকেই ঝুঁকি উপাদানে এক্সপোজড (আচ্ছন্ন)। যেমন- তামাকের ব্যবহার। অনেকেই সিগারেট খায় আবার নয়তো অনেকেই অনিচ্ছাকৃতই অন্যের সিগারেটের ধোঁয়ায় এক্সপোজড হয়। ছোটবেলা থেকেই আমাদের খাবার-দাবার অনেকটাই বদলে গেছে। এখন তেল চর্বি জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া হচ্ছে। খাবারের পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু সে তুলনায় এক্সারসাইজ হয় না। আর যে কারণে ওজন বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও আমাদের লবণ জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া হয়। আর এসব কারণেই আমাদের ব্লাড প্রেসার বাড়ে, ডায়াবেটিস হয়। পরবর্তীতে ডায়াবেটিসের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে এবং সেখান থেকে হার্ট অ্যাটাক হয়।
এ অবস্থায় করণীয় প্রসঙ্গে সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, আমাদেরকে দুটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। একটি হলো প্রিভেনশনের কথা চিন্তা করতে হবে। উপরে যে কারণগুলোর কথা বললাম-এগুলোও কমিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমত হচ্ছে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। আর শুধু সচেতনতা দিয়েই হবে না, সরকারিভাবেও আরও দায়িত্ব নিতে হবে। সরকার তামাকের দাম বাড়িয়ে এটিকে রেসট্রিকশন করে দিতে পারে যে, যেখানে সেখানে এটি খাওয়া যাবে না। আর কঠোরভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এভাবেই ধীরে ধীরে ধূমপান কমে আসবে। স্কুল-কলেজে খেলার মাঠে আমরা বাধ্যতামূলক শারীর চর্চার বিষয়টা চালু করি, তাহলে ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকেই এক্সারসাইজ করার ক্যাপাসিটি ডেভলপ করবে। লবণ খাওয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রসেস ফুড এবং প্যাকেট ফুডে লবণের মাত্রা ঠিক করে দিতে হবে। আর এগুলো হলো পলিসি লেভেলেই কাজ। যা সরকার বা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
এদিকে, কারণ ও করণীয় প্রসঙ্গে ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা খেয়াল করেছি আমাদের দেশে তরুণ বয়সেই হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা অনেক বেশি বেড়েছে। কারণ হলো- আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি জাঙ্ক ফুড খায়। তারা খেলাধুলা, শরীরচর্চা করতে চায় না। এখানে আরেকটা জিনিস সবচেয়ে বেশি কাজ করে সেটি হলো মাদক নেওয়া। তরুণদের মধ্যে মাদক এখন ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এই কয়েকটি কারণে বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের পরিমাণ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। আমাদেরকে অবশ্যই এসব নিয়ে আর সচেতন হতে হবে এবং সবাইকে সচেতন করতে হবে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিটিউট হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, করোনার আগে স্বাভাবিক সময়ে যেখানে গড়ে দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ জন রোগী আসত, বর্তমানে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ জন রোগী আসছেন চিকিৎসা নিতে। মঙ্গলবার সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি ওয়ার্ডের বাইরে মেঝেতেও রোগী। সিসিইউতে প্রতিনিয়ত রোগী নিয়ে আসছেন স্বজনরা।
আমাদের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি জাঙ্ক ফুড খায়। তারা খেলাধুলা, শরীরচর্চা করতে চায় না। এখানে আরেকটা জিনিস সবচেয়ে বেশি কাজ করে সেটি হলো মাদক নেওয়া। তরুণদের মধ্যে মাদক এখন ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এই কয়েকটি কারণে বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের পরিমাণ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। আমাদেরকে অবশ্যই এসব নিয়ে আর সচেতন হতে হবে এবং সবাইকে সচেতন করতে হবে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের তথ্য বলছে, দেশে অসংক্রামক রোগে প্রাণ হারায় ৬৭ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে ৩০ শতাংশের মৃত্যু হয় হৃদরোগে। পশ্চিমের দেশগুলোতে এতে আক্রান্তের গড় আয়ু ষাট বছর হলেও বাংলাদেশে তা ৫০ বছর। ফলে ২২ শতাংশ মৃত্যুই হচ্ছে অকাল মৃত্যু।
Discussion about this post