ডা. ইকবাল মাহমুদ
গত সপ্তাহে আমার কাছে একজন গাইনি রোগী আসেন। যার বয়স ২৬ বছর এবং প্রেগন্যান্সি শেষের দিকে। আমার কাছে আসার কারণ রোগী ছোটবেলা থেকে টিওএফ (TOF) নামের একটি জন্মগত জটিল হৃদরোগে ভুগ ছিল। এই রোগীদের জন্মগতভাবে হার্টে ছিদ্র থাকে। ছিদ্রের সাথে মরার উপর খড়ার ঘার মতো ডান পাশের একটা বাল্ব ও ছোট বা চাপা থাকে।
এই দুই ভয়াবহ ব্যাপারকে ব্যালেন্স করতে গিয়ে হার্টের চেম্বারেও কিছু পরিবর্তন হয়। আমাদের ফুসফুস হার্টের ডান পাশের বেশি কার্বন ডাই অক্সাইডযুক্ত রক্তকে বাতাস থেকে নেওয়া অক্সিজেনের সাথে এক্সচেঞ্জ করে বামপাশে বেশি অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত পাঠায়। সেই অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে সরবরাহ করে অঙ্গগুলো কর্মক্ষম থাকে। এ রোগীদের বাল্বের সমস্যা আর ছিদ্র থাকায় ডান পাশের বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড যুক্ত রক্ত বাম পাশের রক্তের মিশে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এসব রোগীরা অল্প পরিশ্রমে হাঁপিয়ে যায়, শ্বাসকষ্ট হয়, হাত এবং পায়ের আঙ্গুল নীল হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসা না পেলে আমাদের দেশে এসব রোগীরা বেশিদিন বাঁচে না। বিভিন্ন জটিলতায় মারা যায়।
এই মেয়েটির ২২ বছর বয়সে হার্টের সার্জারি হয়। ছিদ্র বন্ধ করা হয়, বাল্বের চাপানো মুখ খুলে দেওয়া হয়। সার্জারির পর সে ভালই থাকে। যাদের ফ্যামিলিতে কিংবা যাদের পরিচিত কারও জন্মগত হৃদরোগ আছে। তারা জানেন যে, একটা জন্মগত হৃদরোগ বিশেষ করে জটিল জন্মগত হৃদরোগের রোগীদের সঠিক চিকিৎসার ভোগান্তি আর ব্যয় কতটুকু। আমি যখন দেখলাম ২২ বছর বয়সেও এই রোগীকে তার মা-বাবা ইন্ডিয়া নিয়ে গিয়ে সার্জারি করে এনেছে। আমি উনাদের ২২ বছরের কষ্ট,ভোগান্তি, উৎকন্ঠা নিয়ে ভাবছিলাম। মন থেকে শ্রদ্ধাও কাজ করছিল। যাই হোক, মেয়ে সুস্থ্য ছিল, বিয়ে হয়। এই মাসে তার ডেলিভারির ডেইট। এতদিন সবকিছু ঠিক ছিল,যেহেতু ডেলিভারির সময় এবং তার একটা হার্টের জটিল অপারেশন হয়েছে। এই রোগী একজন স্পেশাল কেস। আমরা সাধারণত এমন রোগী খুব একটা পাই না।
আমার কাছে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল, ডেলিভারির সময় কি কি সতর্কতা নিতে হবে এবং ডেলিভারি পদ্ধতি কি হবে। এর সাথে কি কি জটিলতা হতে পারে। তার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখার বিষয়ে ডিসিশনের জন্য। যেহেতু রোগী রেয়ার কেস। আমি ইকো করে তার হার্টের অবস্থা দেখি। একদিন সময় নিয়ে এ রকম কেস রিপোর্ট দেখি, আমার কয়েকজন কলিগের সাথে আলাপ করি। সারা পৃথিবীতে এমন কেসের বেলায় কি হয়, তাদের জটিলতা আর অপারেশনের আউটকাম কেমন, এসব বিস্তর ঘাটাঘাটি করে গাইকোলজিস্টদের দুই পাতা চিঠি লিখি।
রোগী আর তার এটেনডেন্টদের কাউন্সেলিং করি। ডেলিভারিটা যেন এমন হাসপাতালে হয় যেখানে সিসিইউ, আইসিইউ ফ্যাসিলিটিজ আছে। ডেলিভারি সময় যেন একজন কার্ডিওলজিষ্ট, নিউনেটোলজিস্ট থাকেন। এই ব্যাপারে তারা আগে থেকেও জানতো। ইন্ডিয়ায় তাদেরকে বলা হয়েছিল। মেয়েটি ছলছল চোখে আমাকে রিকোয়েস্ট করে, আমি যেন তার ওটিতে থাকি। আগে একজন কার্ডিওলজিষ্ট দেখিয়েছিল। তিনি থাকতে রাজি হন নাই।
আমি বলেছি, যদি শহরে থাকি তাহলে আমি থাকার চেষ্টা করবো। সে কিছুটা লজ্জা নিয়ে সুপ্রতিভ একটা প্রশ্ন করে স্যার, আপনি ওটি থাকলে আপনাকে কত ফি দিতে হবে? এ রকম রোগী আমি আবার কখন পাবো কে জানে, এ রকম একজন রোগীর ভরসার স্থান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ইচ্ছা আমার টাকা আয়ের চিন্তাকে ছাড়িয়ে যায়। তাছাড়া আমি এমন আহামরি ব্যস্ত কেউ না। আমি দাবা খেলার মত নিমিষেই আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই। দাবার গুটি সামনে নিয়ে বসে থাকার ধৈর্য আমার কোনদিন ছিল না। হারি জিতি আমি ঝটফট চালাতাম। তাকে আশ্বস্ত করি,দেখও তোমার ওটিতে থাকলে আমি এমনিতেই থাকবো। টাকা দিয়ে তুমি আমাকে নিতে পারবা না।
তারা চলে গেল, দুইদিন আগে তারা জানায় ম্যাক্স হাসপাতালে গাইনোকলজিস্ট অধ্যাপক রিংকু দাশ ম্যাডাম সিজার করবেন। আরেকজন প্রথিতযশা অধ্যাপক ডা. কাজল স্যার, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট হিসেবে থাকবেন। আমি যেন তার ওটিতে অবশ্যই থাকি। পরেরদিন বিকাল তিনটায় সিজার হবে। গতকাল সিজার হয়েছিল। আমি আগেই পৌঁছায়। কাজল স্যারের সাথে কথা বলি, স্যারও বললেন এমন কেস পান না, এই কেসটা নিয়ে স্যারও নেট ঘেটে দেখেছেন। আসলে কাজল স্যার থাকলে ওটিতে আর কাউকে লাগে না। ওটিতে আমাকে দেখে রোগীর উৎকন্ঠা কিছুটা কম ছিল। কাজল স্যার অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়ার পর রোগীর হাত ধরে থাকলেন যেন কোন মতেই সে ভয় না পায়। আমি বারবার আস্বস্ত করছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে একটা ফুটফুটে গোলাপের জন্ম দেয়। দারুণ সুন্দর একটা কন্যা শিশু। আমার কন্যা নাই কিন্তু কন্যা শিশু আমার ভীষণ পছন্দ। এই মেয়েটা মায়াবতীর চেয়ে মায়াবতী।
আমাকে কেউ এর নাম রাখতে দিলে আমি তার নাম রাখতাম ‘রোজ’। মাকে তার বাচ্চা দেখানো হয় ওটিতেই। মায়ের চোখে পানি। এই পানি যতটুকু কষ্টের তার চেয়ে বেশি আনন্দের। অপারেশন সুন্দরভাবে শেষ হয়। টুকটাক কিছু জটিলতা ছাড়া মা মেয়ে সুস্থ্য আছে। আমি বিদায়ের সময়ে শিশুটির দাদা বাড়ির লোকজনকে বলেছি, এই বাচ্চাটা বড় হলে আপনারা এর কাছে কি চান? তাঁরা ঠিক বুঝলো না আমি কি জানতে চাইছিলাম।
তাদের নীরবতা ভেঙে আমি নিজেই বলি, এই কন্যাটির কাছে আমার চাওয়া, সে পৃথিবী পাল্টে দেওয়া কাজ করতে পারুক বা না পারুক। সে যেন বড় হয়ে তার মায়ের কষ্ট বুঝে।
আপনারা সবাই যেন তার মায়ের কষ্ট বুঝেন। একজন জন্মগত হৃদরোগীর একটা সুস্থ্য বাচ্চা জন্ম দেওয়ার তীব্র আকাঙ্খার কাছে এই পৃথিবীর আর কি বড় হতে পারে? আসার সময় রোগীর মা ভাইকে সালাম দিয়ে এসেছি। তাদের কন্যাকে নিয়ে এই অসম্ভব সংগ্রামটা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। সব মহিলারাই কারো না কারো কন্যা। সব কন্যারাই ভালো থাকুক। শুভকামনা, রোজ।
Discussion about this post