জাকির তালুকদার
কিশোর বয়স থেকে রাজনীতি করেছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৮৭-এর পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক-শোষকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে সকল ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত রেখেছে, তা তিনি নিজের জীবনেই অনুভব করেছেন। ক্ষমতায় যাবেন কি না তা নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা না থাকলেও দেশের মানুষের জন্য কোন কোন কাজ করা দরকার সেই ভাবনা সব দক্ষ রাজনীতিবিদেরই থাকে। বঙ্গবন্ধুর আরো বেশি ছিল। কারণ তিনি নিজে ছিলেন স্বাপ্নিক এবং স্বপ্নদ্রষ্টা। বিরোধী রাজনীতি করার সময় দেশের অর্থনীতি কীভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত তা যেমন ভাবতেন, তেমনই ভাবতেন জনগণের স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য কোন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থান—সবকিছু নিয়েই গভীরভাবে ভাবতেন। জানতেন ঔপনিবেশিক আমলের নীতি এবং অবকাঠামো দিয়ে জনগণের জীবনের মূল চাহিদাগুলো পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই ক্ষমতায় গেলে কী করবেন, সে বিষয়ে প্রায় পূর্ণাঙ্গ ধারণা ছিল তাঁর। ছিল হয়তো লিখিত পরিকল্পনার ছকও। তাই তো দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের শেষে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ দেশের মাটিতে পা দিয়েই তিনি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এবং প্রথমেই হাত দিয়েছেন দেশের মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার ক্ষেত্রেগুলিতে। স্বাস্থ্য তেমনই একটি মৌলিক প্রয়োজন এবং অধিকার। সীমিত সংখ্যক সুবিধাভোগী মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবাকে বন্দি না রেখে দেশের সাত কোটি জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নির্মিত হয়েছে তাঁর হাত ধরে।
এই বইয়ের লেখক অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক পাঠকদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দেশে ফেরার ২১ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু গঠন করলেন পরিকল্পনা কমিশন। হাত দিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে।
কেমন ছিল সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য-অবকাঠামো? লেখক হারিসুল হকের বই থেকে জানা যাচ্ছে, সারা দেশে সাত কোটি মানুষের জন্য হাসপাতালে শয্যা ছিল মাত্র ১২৩১১টি। দেশে ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র ৭০০ জন। তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছেন ৭০ জন। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ২৫৯ জন। তাদের সবার অবস্থান ছিল রাজধানী ঢাকাতে এবং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে। তার মানে, ঢাকার বাইরে কোনো রোগীর বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সেবা পাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না।
চিকিৎসাব্যবস্থা মানে কেবল ডাক্তার নয়। নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, ওয়ার্ড বয়, প্যারামেডিক, অ্যাম্বুলেন্সচালক, হেলথ ভিজিটর, সেনিটারি ইন্সপেক্টর, ফার্মাসিস্টসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের নিয়ে গড়ে ওঠে একটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। সেইসব টেকনিক্যাল মানুষের সংখ্যাও ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। সারা দেশে নার্স ছিলেন ৭০০ জন, মিডওয়াইভস ছিলেন ২৫০ জন, স্বাস্থ্য পরিদর্শিকা ২৫০ জন। কমপাউন্ডার ছিলেন ১০০০ জনেরও কম। সারাদেশে নামমাত্র রুরাল হেলথ সেন্টার ছিল ১৫০টি। নামমাত্র বলা হচ্ছে এইজন্য যে সেগুলোতে কোনো ডাক্তার তো দূরের কথা, প্যারামেডিকেরও পদায়ন ছিল না। এই সংখ্যাগুলোই বলে দেয় এই দেশের মানুষের জন্য কার্যত কোনো স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার ইচ্ছাই ছিল না পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। তাদের জীবন পুরোটাই ছিল নিয়তির ওপর নির্ভরশীল। স্থানীয় হাতুড়ে, কবিরাজ, হেকিমদের ওপর নির্ভর করতে হতো সর্বাংশে।
এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা করলেন বঙ্গবন্ধু। রাতারাতি তো একটা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত করা সম্ভব নয়। তাই কিছু ছিল আশু লক্ষ্য, কিছু মধ্যম মেয়াদী, এবং কিছু সুদূরপ্রসারী। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কিউরেটিভ এবং প্রিভেনটিভ চিকিৎসাকে সমন্বিত করা হয়েছিল। বিশুদ্ধ পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, এনভায়রনমেন্টাল হেলথ, গর্ভবতী মা ও প্রসূতি পরিচর্যা, জনগণকে স্বাস্থ্যশিক্ষা দেওয়া, বিভিন্ন রোগের টিকা ছিল প্রিভেনটিভ চিকিৎসার অন্তর্গত। এছাড়া যেহেতু স্বাস্থ্যখাত অনেককিছুর সাথে সমন্বিত একটি বিষয়, তাই স্বাস্থ্যের সাথে পরিবার পরিকল্পনা এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে একীভূত করা হয়েছিল।
স্বাস্থ্যখাতে জরুরি ভিত্তিতে কিছু ক্রাশ প্রোগ্রাম নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালে ৪৫০ জন ছাত্রীকে রির্বাচন করে দ্রুত নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হলো। একটিমাত্র নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিউট ছিল ঢাকাতে। জরুরি ভিত্তিতে রাজশাহীতে খোলা হলো আরেকটি ট্রেনিং সেন্টার। ডাক্তার-সংখ্যা তো রাতারাতি বাড়ানো সম্ভব নয়। একজন ছাত্রের এমবিবিএস কোর্স সম্পন্ন করার জন্য ছয় বৎসর সময় লাগে। তাই অন্তত জনগণের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য কিউবার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে একবছর মেয়াদি কোর্সের মাধ্যমে প্যারামেডিক তৈরির ব্যবস্থা নেওয়া হলো।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিকল্পনা কমিশন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এমনভাবে পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছিল, যাতে করে দেশের যেকোনো অঞ্চলের প্রতিটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্কের আওতায় আসতে পারে। বেসিক হেলথ ওয়ার্কার বা মৌলিক স্বাস্থ্যকর্মী নামে একটি পদ সৃষ্টি করা হয়। এরাই জনগণের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত স্বাস্থ্যসেবক। লেখক তার বইতে তুলে ধরেছেন মৌলিক স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের বিবরণ—‘৪০০ মানুষের স্বাস্থ্যের দেখভালের দায়িত্বে থাকবেন একজন মৌলিক স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁরা সিডিউল অনুযায়ী মাসে অন্তত একবার প্রতিটি বাড়ি পরিদর্শন করবেন। পরিদর্শনকালে তাঁরা টিকাদান কর্মসূচি (গুটি বসন্ত, কলেরা, টাইফয়েড এবং যক্ষ্মা)-তে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করবেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যশিক্ষা (সঠিক পয়ঃনিষ্কাশন, পানীয় জল বিশুদ্ধকরণ, পরিবার পরিকল্পনা) সম্বন্ধে জনগণকে অবহিত করবেন, তাঁরা ম্যালেরিয়া শনাক্ত করার জন্য রোগীদের রক্ত ও সম্ভাব্য যক্ষ্মা আক্রান্তদের কফের নমুনা সংগ্রহ করে রুরাল হেলথ সেন্টারের ল্যাবরেটরিতে জমা দেবেন। তাঁরা ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগীদের ঔষধ রোগীদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবেন। তাঁরা ম্যালেরিয়া নির্মূল অভিযানে সম্পৃক্ত থাকবেন এবং মহামারিকালে সরকার গৃহীত বিবিধ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হবেন। তাঁরা পারিবারিক স্বাস্থ্যকার্ড ও পরিবার পরিকল্পনা গ্রহীতাদের কার্ড যথাযথভাবে পূরণ এবং সংরক্ষণ করবেন—পরবর্তীকালে সেখান থেকে পরিসংখ্যানের জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা যাবে।’ [পৃষ্ঠা ৩৬]
এই ধরনের পরিকল্পনাকে বলা যায় গণমুখী স্বাস্থ্য পরিকল্পনা। শিক্ষার মতো স্বাস্থ্যও কারো সুযোগ নয়, বরং অধিকার। এই ধারণাতেই বিশ্বাসী এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেজন্য স্বাস্থ্যখাতে যেসব পরিকল্পনা তিনি গ্রহণ করেছিলেন সেগুলির বর্ণনা পাওয়া যাবে ডা. হারিসুল হকের লেখা এই গ্রন্থে।
বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। কারণ, তাঁর বিশ্বাস ছিল একমাত্র সমাজতন্ত্রেই সকল মানুষের মুক্তি সম্ভব। দারিদ্র্য থেকে মুক্তি, অশিক্ষা থেকে মুক্তি, স্বাস্থ্যহীনতা থেকে মুক্তি। সেই লক্ষ্যেই এই ধরনের স্বাস্থ্য পরিকল্পনা। সমাজতন্ত্র গড়ে না উঠলেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অন্তত একটি কল্যাণরাষ্ট্র পেতে যাচ্ছিল বাংলাদেশের মানুষ।
এখন পৃথিবীতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য ভাবনায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। ঔষধ, রোগনির্ণয়, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, জটিল স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত হয়েছে অনেক নতুন নতুন আবিষ্কার। সেগুলি বয়ে এনেছে মানুষের রোগমুক্তি এবং দীর্ঘ জীবনের আশ্বাস। কিন্তু মুক্তবাজার পুঁজিবাদ এখন কেবল ধনীদের জন্যই নিশ্চিত করেছে উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী এখন আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। বিশাল বিশাল সরকারি স্বাস্থ্য অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। তবু সেখানে চিকিৎসা পায় দেশের মাত্র শতকরা ৩০ ভাগ মানুষ। বাকি ৭০ ভাগ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা কিনতে হয় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোম থেকে।
মুক্তবাজার পুঁজিবাদের নিয়ম অনুসারে স্বাস্থ্যখাতে গড়ে উঠেছে প্রতিযোগিতা। তবে সেই প্রতিযোগিতা রোগীদের জন্য সহায়ক হয়নি। হয়েছে উদ্যোক্তা এবং দালাল শ্রেণির জন্য। টাকার অঙ্কে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি বরাদ্দ বেড়েছে। তবে অন্যখাতের তুলনায় বেদনাদায়করূপে কম। বঙ্গবন্ধুর সময়ে যেখানে বাজেটের প্রায় ৫% বরাদ্দ ছিল স্বাস্থ্যখাতে, এখন সেখানে বরাদ্দ ২%-এরও কম। বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনায় সরকারকে জনগণের স্বাস্থ্য প্রতিদিন বেশি বেশি করে ছেড়ে দিতে হচ্ছে বেসরকারি খাতে। এই প্রবণতা বঙ্গবন্ধুর চিন্তা এবং আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক।
আমরা কৃতজ্ঞ ডা. হারিসুল হকের কাছে এমন একটি গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য। তার এই গ্রন্থের মাধ্যমে আমরা অন্তত এটুকু বুঝতে পারছি যে স্বাস্থ্যখাতে আমাদের কোনদিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, আর এখন আমরা হাঁটছি তাঁর নির্দেশিত পথের বিপরীত দিকে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের একমাত্র উপায় হচ্ছে বর্তমানের ভুলযাত্রা থেকে বিরত হয়ে তাঁর আদর্শের পথকে অনুসরণ করা।
বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য ভাবনা। অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক। প্রকাশক : কবিতাসংক্রান্তি, ঢাকা। প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ।
Discussion about this post