হার্টবিট ডেস্ক
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণহীন। এ মশা দমন না করলে অক্টোবর মাসজুড়ে ডেঙ্গুজ্বর আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা ।ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির (ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট-আইভিএম) কথা বলা হলেও বাস্তবে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন তার প্রয়োগ করছে না।
ফলে ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশাও নিয়ন্ত্রণে আসছে না। রাজধানীতে প্রতিদিনই প্রায় দুইশর বেশি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। সরকারি হিসাবেই এরই মধ্যে সারাদেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে। ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর গবেষকরা বলছেন, সরকারি হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা যা দেখানো হচ্ছে, বাস্তবে সেই সংখ্যা অন্তত ২০ গুণ বেশি। এই হিসাবে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত তিন লাখ মানুষ।
মশক ও কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এডিস মশা ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। রাজধানীর উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) কিছুটা সক্রিয় হলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ততটা সক্রিয় নয়। আর ঢাকার বাইরের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো এ ক্ষেত্রে একেবারেই উদাসীন। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে এডিস মশার দৌরাত্ম্য। বিভিন্ন শহরে ডেঙ্গু রোগীর অস্তিত্বও পাওয়া যাচ্ছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে জীবজ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মশার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিছু পোকামাকড় মশার লার্ভা ও উড়ন্ত মশা খেয়ে ফেলে। কিন্তু রাসায়নিকের অত্যধিক ব্যবহারের কারণে জীবজ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মাধ্যমে মশার দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম খুব কাজে আসছে না। আর তৃতীয় ধাপে ব্যবহার করতে হয় কীটনাশক। উড়ন্ত মশা মারার জন্য অ্যাডাল্টিসাইডিং ও লার্ভা মারার জন্য লার্ভিসাইডিং করা হয়। কিন্তু কীটনাশক ব্যবহারে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক ঝুঁকি থাকে বলে কীটনাশক ব্যবহারকে সবসময় অনুৎসাহিত করেন মশক বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য সীমিত পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেন তারা।
মশক নিয়ন্ত্রণ কাজ আরও সহজ করতে চতুর্থ ধাপে করা হয় জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও জনগণকে সম্পৃক্ত করার কাজ। এ কাজগুলো সর্বত্র একসঙ্গে করাই হলো আইভিএম। বছরব্যাপী এ চারটি কাজ একই সঙ্গে সর্বত্র সক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করা গেলে মশা নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোনো কাজই সফলতার সঙ্গে করতে পারেনি রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন।
এ প্রসঙ্গে মশক বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, কীটনাশক ব্যবহারের কথা মশক নিয়ন্ত্রণের তৃতীয় ধাপে বলা হলেও আমাদের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো কেবলই মশার ওষুধ কেনার ব্যাপারে আগ্রহী থাকে। কারণ ওষুধ কেনা গেলে হয়তো তাদের কোনো বাণিজ্য থাকে। যে কারণে আইভিএমের কাজ এগোয় না।
গত শনিবার রাজধানীতে ডেঙ্গুবিষয়ক একটি সেমিনারে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এডিস মশার একটি লার্ভা তিন থেকে চার সপ্তাহে পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হওয়ার পর মানুষকে কামড়াবে এবং রোগ ছড়াতে থাকবে। এরই মধ্যে যেসব মশা রোগ ছড়াচ্ছে তাদের মেরেই ডেঙ্গু কমাতে হবে। যে পদ্ধতিতে অ্যাডাল্ট মশা মারা যায়, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সেই পদ্ধতিতে জোর দেওয়া হয়নি। লার্ভা মারার জন্য সিটি করপোরেশন পথেঘাটে প্রচার চালাচ্ছে। বাসাবাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হচ্ছে। তারা লার্ভা মারার জন্যই প্রচার করে যাচ্ছে; কিন্তু মারতে হবে অ্যাডাল্ট মশা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, একটি স্থানে ৫০০ মশার লার্ভা থাকলে সেটাকে এক মিনিট স্প্রে করেই মেরে ফেলা সম্ভব। তাহলে আর প্রাপ্তবয়স্ক ৫০০ মশা তৈরি হবে না। কিন্তু কোনো এলাকায় ৫০০ প্রাপ্তবয়স্ক মশা থাকলে ওষুধ ছিটিয়ে বড় জোর ১৫০টি মারা সম্ভব। কারণ ওষুধ ছিটিয়ে উড়ন্ত মশা ও অ্যাডাল্ট মশা মারার সর্বোচ্চ হার ৩০ শতাংশ। বাকি সাড়ে তিনশ মশাকে একসঙ্গে যতই ওষুধ ছিটানো হোক না কেন মারা যাবে না। সেগুলো অন্যত্র উড়ে যাবেই। এ জন্যই লার্ভা ধ্বংস করা প্রথম জরুরি বিষয়।
এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ল্যাবে যে ওষুধের মশা মারার হার ৯০ শতাংশ, সেই অ্যাডাল্টিসাইটিংয়ের মাধ্যমে ২৫ শতাংশ উড়ন্ত মশাকে মারা সম্ভব। কাজেই একতরফাভাবে উড়ন্ত মশা মেরেই যে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তা বলা যাবে না। এখানে ইন্টিগ্রেটেড ভেক্টর ম্যানেজমেন্টই মশা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়। এটাই এখন পর্যন্ত সারাবিশ্বে স্বীকৃত পদ্ধতি।
অবশ্য এ প্রসঙ্গে আইইডিসিআরের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে জানান,লার্ভা ও অ্যাডাল্ট মশা দুটোই মারা দরকার। এটা মশক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু যখন মহামারি পর্যায়ে চলে যায়, তখন অ্যাডাল্ট মশাকেই আগে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। কারণ এডিস মশা এক মাস বেঁচে থাকাকালে যতজনকে কামড়াবে, ততজনই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে। আর লার্ভা থেকে অ্যাডাল্ট মশা হতে সপ্তাহখানেক সময় লাগে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের কর্মীদের দেখা যায়, ড্রেনের ভেতরে ওষুধ ছিটায়। কিন্তু এডিস মশা তো ড্রেনে থাকে না। বর্তমানে ডেঙ্গু যে পর্যায়ে গেছে, সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অ্যাডাল্ট মশা মারাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
সরকারি হিসাবের চেয়ে ডেঙ্গু রোগী ২০ গুণ বেশি :
প্রতিদিনই আইইডিসিআর থেকে সারাদেশে নতুন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর তথ্যসহ একটি সংক্ষিপ্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। গত ১৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা পর্যন্ত সরকারি হিসাবে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ হাজার ৭০১ জন। এ সময় সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১৪ হাজার ৫৩৫ জন। এর বাইরে অসংখ্য ডেঙ্গু রোগী বাড়িতে অবস্থান করে চিকিৎসা নিলেও তাদের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত একজন হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর বিপরীতে বাসাবাড়িতে অন্তত ২০ জন আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন। সেই হিসাবে চলতি বছর তিন লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। সেন্টার ফর গভর্নমেন্ট স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ারম্যান এবং কীটতত্ত্ববিদ মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সরকারি পরিসংখ্যান খুবই সীমিত। রাজধানীর মাত্র ৪১টি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য দিয়ে ডেঙ্গু সংক্রমণের পুরো চিত্র পাওয়া যায় না।
নিয়ন্ত্রণে আসছে না ডেঙ্গু :
চলতি মাসের প্রথম ১৯ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৩৪৫ জন। গত মাসে মোট আক্রান্ত হয়েছিলেন সাত হাজার ৬৯৮ জন। গত জুলাই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ২৮৬ জন। গত জুন মাসে আক্রান্ত হন ২৭২ জন। এ ছাড়া চলতি বছরের প্রতি মাসেই কম-বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। আর আক্রান্তদের প্রায় ৯০ শতাংশই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরের চেয়ে দক্ষিণে আক্রান্তের হার বেশি।
অবশ্য এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রতিদিন তাদের কাছে যে তালিকা পাঠানো হয়, প্রত্যেক রোগীর বিষয়ে তারা খোঁজ নেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তালিকার বেশিরভাগ রোগীই ঢাকার বাইরে থেকে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় আসা। আর অনেক রোগীর সন্ধানও তারা পান না। কাজেই ঢালাওভাবে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর হার বেশি- এটা বলা যাবে না।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের হার ডিএনসিসি এলাকায় কম হলেও আমরা সন্তুষ্ট হতে পারছি না। সন্তুষ্ট তখনই হতাম যদি কোনো ডেঙ্গু রোগীই না থাকত। ২০১৯ সালে লক্ষাধিক রোগী হয়েছিল। এবার হয়েছে ১৫ হাজার। সেটার কারণ জনসচেতনতা বেড়েছে, তৎপরতাও বেড়েছে। এ কাজগুলো না করলে পরিস্থিতি আগের চেয়ে আরও বেশি খারাপ হতো বলে তিনি মন্তব্য করেন।
Discussion about this post