ডা. মো. তৌহিদ হোসাইন
করোনাভাইরাস হলো এনভেলপড সিঙ্গেল স্ট্রেন্ডেড জুনোটিক আরএনএ ভাইরাস। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদেরও আক্রান্ত করে এমন আরএনএ ভাইরাস প্রথম আবিষ্কার হয় ১৯৩০ সালে। তবে মানুষকে আক্রান্ত করে এমন করোনাভাইরাস আবিষ্কার হয় ১৯৬০ সালে। এখন পর্যন্ত মোট সাতটি করোনাভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র চারটি করোনাভাইরাস মানুষকে আক্রমণ করে- এইচসিওভি২-২২৯, এইচকেইউ-১, এনএল৬৩ এবং সি৪৩।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর আবিষ্কৃত হয় বর্তমান বিশ্বে দাপিয়ে বেড়ানো সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস-২ অথবা সারসকভ-২। এটি বড়দের আক্রান্ত করে বেশি। আক্রান্ত বেশির ভাগ শিশুই উপসর্গহীন বা কম উপসর্গযুক্ত। করোনাভাইরাসে শিশুরা সাধারণত মৌসুমি ফ্লুতে আক্রান্ত হয়। দুই থেকে ১৯ শতাংশ শিশু আক্রান্ত হয় একিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশনে। ১৩ শতাংশ থাকে উপসর্গহীন। ১১ থেকে ৪৬ শতাংশ শিশু উপসর্গযুক্ত থাকার পাশাপাশি অন্যান্য রেসপিরেটরি ভাইরাস দ্বারাও কো-ইনফেকটেড থাকে।
সারস-কভ-কভ: এ ভাইরাসের যাত্রা শুরু হয় চীন থেকে। ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ শিশুই আক্রান্ত হয় ঘরের মধ্যে আক্রান্ত বড়দের থেকে। দুই শতাংশ থাকে উপসর্গহীন। ৯১ থেকে শতভাগ শিশুরই জ্বর থাকে। বয়স্কদের মধ্যে শতকরা ছয় থেকে ১৭ জন মারা গেলেও শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর হার প্রায় শূন্য।
মারস-কভ: এ ভাইরাসের শুরু সৌদি আরব থেকে। ৩২ শতাংশ শিশুই বড়দের থেকে আক্রান্ত হয়। ৪২ শতাংশ থাকে উপসর্গহীন। ৯১ থেকে শতভাগ শিশুরই জ্বর থাকে। ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বড়রা মারা গেলেও শিশুদের মধ্যে এর কারণে মৃত্যুর হার মাত্র ছয় শতাংশ।
সারস-কভ-২: ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরের হর্সশু বাদুর থেকে এর যাত্রা শুরু। ৮২ শতাংশ শিশুই আক্রান্ত হয় পরিবারে আক্রান্ত বড়দের কাছ থেকে। ১০ শতাংশ থাকে উপসর্গহীন। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ শিশুরই জ্বর থাকে। শূন্য দশমিক থেকে তিন শতাংশ বড়রা মারা গেলেও শিশুদের মধ্যে এর কারণে মৃত্যুর হার মাত্র শূন্য দশমিক দুই শতাংশ। তিন বছরের নিচের শিশুরা এবং হার্টের রোগে অসুস্থ শিশুরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্ত হয়।
শিশুদের আক্রান্ত করা অন্যান্য ভাইরাস যেমন রেসপিরেটরি সিন্সিটিয়াল ভাইরাস (আরএসভি), ছোট থেকে বড় বয়সে যেতে যেতে আক্রান্তের হার কমতে থাকে, কিন্তু সারস-২ ভাইরাসের ক্ষেত্রে হয় তার উল্টো। ১১ থেকে ৪৬ শতাংশের ক্ষেত্রে মানুষকে আক্রান্ত করা করোনাভাইরাসের সাথে অন্যান্য ভাইরাস যেমন- ইনফ্লুয়েঞ্জা, প্যারা-ইনফ্লুয়েঞ্জা, এডেনো ভাইরাস, রাইনোভাইরাস, রেসপিরেটরি সিন্সিয়াল ভাইরাস প্রভৃতি দ্বারাও কো-ইনফেকটেড হয়। উপসর্গযুক্ত হিউমান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শিশু ক্রনিক অন্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার অন্য রেসপিরেটরি ভাইরাসের চেয়ে বেশি।
মনুষ্য করোনাভাইরাসগুলো সহজেই মিউটেট করতে পারে এবং অন্য স্ট্রেইন দ্বারা আক্রান্ত ভাইরাসের সাথে একীভূত হয়ে নতুন করোনাভাইরাসের জন্ম দিতে পার। সারস-কভ-২ করোনাভাইরাসই একমাত্র ব্যতিক্রম যা বড়দেরকে বেশি আক্রান্ত করে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন-ইউসিএল ও লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন শিশুদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা এবং তাদের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়া নিয়ে পরিচালিত পুরো বিশ্বের ছয় হাজার ৩৩২টি গবেষণাপত্র মূল্যায়ন করে বলেছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে প্রাপ্তবয়স্ক কোনো ব্যক্তির চেয়ে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৫৬ শতাংশ কম। শিশুদের থেকে বড়দের মধ্যে সংক্রমণের হার মাত্র ১০ শতাংশ। শিশুদের সংক্রমণের হার বড়দের চেয়ে অনেক কম (১-২ শতাংশ)।
বয়স্করা যে কারণে করোনাভাইরাসে সহজেই আক্রান্ত হচ্ছে:
এন্ডোথেলিয়াল সেল ইঞ্জুরি এবং মাইক্রোথ্রম্বাই:
বয়স যত বাড়তে থাকে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতাও বাড়তে থাকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এন্ডোথেলিয়াল সেলসের ডেমেজের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং সাথে ক্লটিং ফ্যাক্টরের কার্যকারিতাও বেড়ে যায়। এন্ডোথালিয়াল ইঞ্জুরি এবং মাইক্রোথ্রোম্বাই কোভিড-১৯ রোগ মারাত্মক হওয়ার ব্যাপারে ভূমিকা রাখে। ফলে বড়দের যেসব রোগের কারণে এন্ডোথেলিয়াল সেল ইঞ্জুরি হয়, কোভিড-১৯ রোগে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে।
এসিই-২ ও সেরিন প্রোটিয়েজ এঞ্জাইম: যে এসিই-২ ও সেরিন প্রটিয়েজ-২ নামক এঞ্জাইম প্রোটিন দ্বারা করোনাভাইরাস যথাক্রমে মানব কোষে লাগে এবং ঢুকে তাদের পরিমাণ ও আসক্তি বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেড়ে যায়। যাই হোক, এসিই-২ এর সংখ্যা এবং এর প্রতি করোনাভাইরাসের আসক্তি নির্ভর করে ধূমপানের অভ্যাস, খাদ্যাভ্যাস, ডায়াবেটিস ও জেনেটিক্সের ওপর।
অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহেন্সমেন্ট অ্যান্টিবডি (এডিই): সারস-কভ-২ ছাড়াও অন্য করোনাভাইরাস দ্বারাও মানুষ একিউট রেসপিরেটরি ট্রাক্ট ইনফেকশনে আক্রান্ত হয় ৬-৮ শতাংশ ক্ষেত্রে। ফলে ছোটবেলা থেকেই ওই সব করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি থাকে। আবার শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি থাকলেও এর স্থায়িত্ব শেষ হয়ে গেলে বিভিন্ন পর্যায়ে একই ভাইরাসে বারবার আক্রান্তের ফলে বড়দের ক্ষেত্রে সাধারণত নিউট্রালাইজিং এবং নন-নিউট্রালাইজিং ক্রস রিয়েকটিভ অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এর মধ্যে নন-নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডিগুলো সময় সময় আবার নতুন ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত ভাইরাসের সাথে মিশে মানব কোষে ঢুকতে ও বংশবিস্তার করতে সাহায্য করে। এককথায়, আগের তৈরি নন-নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডিগুলো বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। একে অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহেন্সমেন্ট অ্যান্টিবডি (এডিই) বলে।
ছোটদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা খুব কমই ঘটে। আবার বড়দের ক্ষেত্রে ক্রস রিয়েক্টিভ টি-সেলও অধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। এমন ঘটনা ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে ঘটে। ডেঙ্গু রোগের চারটি সেরোটাইপ থাকে। একবার যেকোনো একটি সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হলে তা প্রথমে মৃদু উপসর্গ হয় এবং তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে রোগী ভালো হয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে ওই রোগী ডেঙ্গুর অন্য একটি সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হলে এই তৈরি অ্যান্টিবডি শরীরকে প্রটেকশন না দিয়ে নতুন সেরোটাইপের ভাইরাসের সাথে মিশে সেলের ভেতরে ঢুকে বংশবিস্তার করতে থাকে।
ইমিউনো সেনেসেন্স: বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শরীরের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এবং এডাপ্টিভ ইমিউনিটি কমে যায়, যাকে বলা হয় ইমিউনো সেনেসেন্স।
ইনফ্লামেজিং: বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে আরো একটি সমস্যা হয়; তা হলো- অল্পমাত্রার অবস্থায় বড়দের সাইটোকাইন স্টোরমের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বিশেষ করে কার্ডিওভাস্কুলার, ডায়াবেটিস ও ওবেসিটির উপস্থিতি এ ধরনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
কো-মর্বিডিটি: যেমন- ডায়াবেটিস, হার্ট, কিডনি ও ক্রনিক লাং ডিজিজ, ধূমপান ইত্যাদিতে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ছোটদের কো-মর্বিডিটির সুযোগ খুব কম, ফলে অসুখ মারাত্মক হয় না।
ভিটামিন-ডি: বড়দের ভিটামিন-ডি-এর পরিমাণ বড়দের ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে কমে যায়। সেই সাথে যদি ক্রনিক কিডনি ডিজিজ ও ওবেসিটির মতো সমস্যা থাকে; ফলে কোভিড-১৯ মারাত্মক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ইদানীং সারা বিশ্বে শিশুদের ভিটামিন-ডি খাওয়ানোয় বড়দের চেয়ে সমস্যা কম হয়। জলবসন্তে শিশুদের চেয়ে বয়স্করা ২৫ গুণ বেশি মারা যান। এ ছাড়াও ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ভাইরাসজনিত একধরনের সর্দিজ্বরে ছোট শিশুদের চেয়ে একটু বেশি বয়সী শিশুরাই সহজে আক্রান্ত হয়। আবার মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জাতে শিশুদের চেয়ে বয়স্করা ১০ গুণ বেশি মারা যায়।
যেসব কারণে শিশুরা বড়দের চেয়ে একটু সুরক্ষা পায়:
জন্মসূত্রে প্রাপ্ত শক্তিশালী ইন্ন্যাট ইমিউনিটি: শিশুদের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ইমিউনিটি (ইন্ন্যাট ইমিউনিটি) শক্তিশালী থাকে; ফলে ভাইরাল ক্লিয়ারেন্স দ্রুততর হয়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত দুর্বল এডাপ্টিভ ইমিউনিটি হওয়ায় হাইপার ইনফ্লামেশন হওয়ার সুযোগ খুব কম। ফলে সাইটোকাইন স্টোরমের সম্ভাবনা কম থাকে। আবার বয়স্কদের চেয়ে ছোটদের সাইটোকাইন রেসপন্স কম; ফলে এখানেও সাইটোকাইন স্টোরমের সম্ভাবনা কম থাকে। একই কারণে ডেঙ্গু, হেপাটাইটিস-এ, হাম, পোলিও প্রভৃতি রোগে শিশুদের সাধারণত মারাত্মক উপসর্গ থাকে না। একইভাবে ইন্ন্যাট ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হওয়ায় অন্য করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত একিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিন্ড্রোম বা এআরডিএস, রেসপিরেটরি সিন্সিটিয়াল ভাইরাস এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ইনফেকশনে সাইটোকাইন স্টোরম হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ছোটদের ইন্ন্যাট ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হওয়ায় করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে ভাইরাল ক্লিয়ারেন্স তাড়াতাড়ি হওয়ায় শিশুরা কম আক্রান্ত হচ্ছে এবং দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠছে; অথচ অন্যান্য ভাইরাসের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না।
ছোটদের ঘন ঘন ও বারবার অন্য ভাইরাস দ্বারা ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা থাকে। এর ফলে রোগ প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যা সারস-কভ-২ এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহায্য করে। শিশুরা সারস-কভ-২ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পাশাপাশি অন্য ভাইরাস দ্বারা কো-ইনফেকটেড হতে পারে। কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রে তা হয় না। শিশুদের মাত্র ১-২ শতাংশ ক্ষেত্রে আইসিইউ লাগে। বিশেষ করে যার ক্রোনা ছাড়াও অন্য কো-মর্বিডিটি থাকে।
ক্রস রিয়েক্টিভ নিউট্রালাইজং অ্যান্টিবডি ক্রস প্রটেকশন:
আগে থেকেই অন্য করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত শিশুদের রক্তে পর্যাপ্ত নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি ও টি-সেল ইমিউনিটি থাকলে এই অ্যান্টিবডি সারস-কভ-২ রোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। ইহাকে ট্রেইন্ড ইমিউন ক্রস রিয়েক্টিভ নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি ক্রস প্রটেকশন বলে।
ন্যাসোফেরিনক্স ও গলবিলে থাকা অন্য ধরনের ভাইরাসের প্রচুর উপস্থিতি:
ছোটদের ন্যাসোফেরিনক্স ও গলবিলে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার কলোনি থাকে, যাদের উপস্থিতির কারণে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। শিশুদের সাধারণত ফুসফুসের উপরের অংশে আক্রান্ত করে বেশি। তবে জন্মের এক মাসের মধ্যে শিশুরা করোনাভাইরাসের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে তাদের ইন্ন্যাট ও এডাপ্টিভ ইমিউনিটি অপরিপক্ব থাকার কারণে।
এআরডিএস ও এমআইএস-সি: সারস-কভ-১৯ ইনফেকশনের কারণে বড়দের এআর ডিএস হলে ফুসফুস আক্রান্ত হয় এবং আইজিএম-আইজিজি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়; কিন্তু ছোটদের মাল্টিঅর্গান ইনফ্লামেটরি সিন্ড্রম (এমআইএস-সি) হলে ফুসফুস আক্রান্তের চেয়ে হার্ট ও অন্যান্য অর্গান আক্রান্ত হয় বেশি এবং আইজিজি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লুামেটরি সিন্ড্রোম: ০-১৯ বছর বয়সী করোনা রোগী সাথে অন্তত তিন দিন জ্বর এবং নিচের যেকোনো দু’টি থাকলে- চামড়ায় প্রদাহ ও হাত-পায়ে র্যাশ কিংবা দুই চোখে কঞ্জাক্টিভাইটিস, হাইপোটেনশন অথবা শক মায়োকার্ডিয়াল ডিস্ফাংশন অর্থাৎ পেরিকার্ডাইটিস, মায়োকার্ডাইটিস, উচ্চ মাত্রার ট্রপনিন- রক্ত জমাট বাঁধার আলামত, ডায়রিয়া, পেটের ব্যথা এবং বায়োমার্কার উচ্চমাত্রার, উচ্চমাত্রার সিআরপি, প্রো-ক্যালসিটনিন ইত্যাদি এবং কোভিড ছাড়া অন্য কোনো কারণে অসুস্থতার প্রমাণ-না-পাওয়া, আরটি-পিসিআর পজিটিভ হওয়া।
এমআইএসসিতে আক্রান্ত হওয়ার গড় বয়স হলো ৮-৯ বছর। বড়দের এআরডিএস হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হলে ২৫ শতাংশ বাঁচে।
মেলোটানিন: শিশুদের রক্তে মেলোটানিনের পরিমাণ বেশি থাকে, যার মধ্যে আছে অ্যান্টিইনফ্লামেটরি ও অ্যান্টি-অক্সিডেটিভ ক্ষমতা। এই হরমোন ন্যাচারাল কিলার সেল, টি-লিম্ফোসাইট, বি-লিম্ফোসাইট, গ্রানিউলসাইট, মনসাইট প্রভৃতি বাড়িয়ে দেয়; ফলে ইন্ন্যাট ইমিউনিটি ক্ষমতা বেড়ে যায়। অন্য দিকে যেসব প্রোটিন সাইটোকাইন স্টোরম তৈরিতে ভূমিকা রাখে যেমন- আইএল-৬, টিউমার নেক্রসিস ফ্যাক্টর (টিএনএফ) প্রভৃতি কমিয়ে দেয়। মেলাটোনিন ভাইরাল ইনফেকশনের কারণে হিমোরিজিক শক কিংবা এআরডিএসের হাত থেকে রক্ষা করে ছোটদের।
টার্গেট ইফেক্টস অব লাইভ ভ্যাকসিন: অন্য রোগের বিরুদ্ধে যেমন- বিসিজি, ওপিভি ও মিসিলস কন্টেইনিং ভ্যাকসিন (এমসিভি), এমএমআর প্রভৃতি ধরনের লাইভ ভ্যাকসিন শিশুর শরীরে প্রয়োগ করলে তা দিয়ে সারস-কভ-২-এর ইনফেকশনের হাত থেকে কিছুটা হলেও সুরক্ষা দেয়। একে অব টার্গেট ইফেক্টস অব লাইভ ভ্যাকসিন বলে।
ভাইরাল লোড ও ইনটেন্সিভ ভাইরাল এক্সপোজার কম: ছোটদের অসুখ মারাত্মক হওয়া না হওয়া নির্ভর করে প্রাথমিক ভাইরাল লোডের ওপর। অফিস-আদালত, হাসপাতালে বড়দের সংস্পর্শে আসার সুযোগ খুব কমই পায়। ফলে ছোটদের ইনটেনসিভ ভাইরাল এক্সপোজার কম হয়। ছোটরা আশ্চর্যজনকভাবে অন্য রেসপিরেটরি ভাইরাস দ্বারা সহজেই মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হলেও করোনাভাইরাসে খুব কমই মারাত্মক উপসর্গ প্রকাশ করে। এ ছাড়াও ছোটরা পূর্বেকার ইনফেকশন ও ভ্যাকসিন থেকে বড়দের চেয়ে বেশি সুরক্ষা পেয়ে থাকে।
সাধারণত শিশুদের থেকে বড়দের মধ্যে রোগ ছড়ায় না, বরং বড়দের মধ্য থেকে ছোটদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ঘটে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। ‘নেচার মেডিসিন’ গবেষণা মতে- ২০ বছরের কম বয়সীরা তার উপরের বয়সীদের চেয়ে অর্ধেক সম্ভাবনা থাকে করোনা সংক্রমিত হওয়ার।
শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে কোভিড-১৯-এর উপসর্গের চরিত্রগত পার্থক্য: শিশু করোনা রোগী বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গযুক্ত করোনা রোগী হয়। বড়দের মধ্যে উপসর্গযুক্ত, মারাত্মক উপসর্গযুক্ত, হাসপাতালে ভর্তিযোগ্য এবং মৃত্যু হার বেশি।
১২ মাসের কম বয়সী, অতিরিক্ত ওজনধারী এবং অ্যাজমা, হার্ট ডিজিজ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ শিশুরা এমআইএস-সি হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বড়দের এন্ডোথেলিয়াল ডেমেজ, ক্লটিং ফেক্টরের আধিক্য, এঞ্জিওটেন্সিন কনভার্টিং এঞ্জাইমের এফিনিটি ও সংখ্যার আধিক্য, ইমিউনোসেনেসেন্স (বয়সের সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কমে যাওয়া), ভিটামিন-ডি রক্তে কমে যাওয়া এবং উচ্চমাত্রার কো-মর্বিডিটি থাকায় বড়রা করোনাভাইরাসের উচ্চ ঝুঁকিতে।
আর ছোটদের উচ্চমাত্রার ইন্ন্যাট ইমিউনিটি, ঘন ঘন অন্য ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়া, বেশি মাত্রায় মেলাটনিনের উপস্থিতি, কম মাত্রার এসিই-২ এবং কম এক্সপোজার থাকায় বড়দের চেয়ে কম ঝুঁকিতে থাকে। গত ২০ জানুয়ারি ২০২০ সালে ‘বিএমসি ইনফেক্সাস ডিজিজ’ নামক জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বয়স্ক এবং ছোটদের কোভিড-১৯ এর তুলনামূলক অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গেছে।
ওই গবেষণার ফলাফল ও অন্য সব কিছু মিলিয়ে তুলনামূলক অবস্থান নিম্নরূপ–
এতে দেখা যাচ্ছে, বয়স্ক ও শিশুদের কোভিড-১৯ রোগের মারাত্মক উপসর্গ ও আল্টিমেট আওটকামের মধ্যে ভিন্নতা আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত কোভিড-১৯ বয়স্কদের যে উপসর্গ দেখায় তা হলো সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিন্ড্রোম (এআরডিএস)। বড়দের আরো একধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেটি হলো- নিউমোনিয়ার কারণে হাইপোক্সেমিয়া হয়ে ভেন্টিলেশন-পারফিউশন মিসম্যাচ। ফলে অক্সিজেন সেচুরেশন লেভেল কমে যায়। বড়দের প্রায় সবাই এআরডিএস নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।
বড়দের মারাত্মক উপসর্গের ৫০ শতাংশের মধ্যে সেকেন্ডারি ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। সারিয়ে তুলতেও মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন দেখা দেয় ৮১ দশমিক তিন শতাংশের ক্ষেত্রে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, করোনায় বড়দের এআরডিএস থেকে সেকেন্ডারি ইনফেকশন প্রবণতা বেশি এবং সারিয়ে তুলতে আইসিইউ-ভেন্টিলেটরি সাপোর্ট বেশি লাগে। কিন্তু ছোটদের বেলায় এমআইসিএস-সি থেকে হার্টের সমস্যা যেমন- মায়োকার্ডাইটিস ও পেরিকার্ডাইটিস প্রবণতা বেশি। সারিয়ে তুলতে ভেন্টিলেটরি সাপোর্টের চেয়ে আইনোট্রোপিক সাপোর্ট বেশি প্রয়োজন হয়।
আর ছোটদের বেলায় যদিও এসব উপসর্গ মৃদু আকারে আসে কিন্তু তা যখন জটিল পর্যায়ে পৌঁছে তখন আরো মারাত্মক আকারে শরীরের অনেক অরগানকে অকেজো করে অন্য ধরনের জটিলতা তৈরি করে যার নাম মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিন্ড্রোম (এমআইএস-সি)।
শিশুদের প্রায় সবাই ভর্তি হয় এমআইএস-সি জাতীয় জটিলতা নিয়ে। তাদের মধ্যে আইসিইউতে নিয়ে মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশনে চিকিৎসা নিতে হয় ৫০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে। শিশুদের সব রোগীরই আইনোট্রপিক সাপোর্ট লাগে। বড়দের ক্ষেত্রে এ সাপোর্ট লাগে মাত্র ৩৭ দশমিক পাঁচ শতাংশের ক্ষেত্রে। ছোটদের বেলায় তাদের সিরামে বায়োমার্কার যেমন প্রোক্যালসিটনিন, সিআরপি, ট্রপনিন ইত্যাদি বড়দের চেয়ে বেশি পাওয়া যায়। ছোটদের মৃত্যু হারও কম (০.০২ শতাংশ).
অন্য সব মহামারীতে টিকা কার্যক্রম শুরু হয় শিশু বয়স থেকে। কিন্তু কোভিড-১৯ টিকা শুরু করা হয়েছে ক্রমেই বড়দের থেকে ছোটদের দিকে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, চীন, ইসরাইলসহ কিছু দেশ এরই মধ্যে সীমিত পরিসরে শিশুদের টিকা দেয়া শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের করোনার টিকার আওতায় আনা উচিত। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার আগে এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ও দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্ত শিশুদের টিকা দেয়া উচিত। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ ফাইজার-বায়োন্টেককে ১২-১৫ বছরের শিশুদেরকেও টিকা দেয়ার পারমিশন দিয়েছে।
লেখক- সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, শের-ই-বাংলা নগর, ঢাকা।
Discussion about this post