হার্টবিট ডেস্ক
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গুর যে ভ্যারিয়েন্টটি বেশি ছড়াচ্ছে, সেই একই ভ্যারিয়েন্ট ২০১৯ সালে বিপর্যয় ঘটিয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্যান্য বারের তুলনায় এবার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়েছে ডেঙ্গুর। যেসব নির্দেশনা মেনে চিকিৎসা করা হতো সেসবে আনতে হচ্ছে পরিবর্তন। তাদের বিশ্লেষণ বলছে, এবারে ডেঙ্গু তার চরিত্র বদল করেছে, হয়ে উঠেছে ভয়ংকর ও মারাত্মক। এবারে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি এবং সময়ও পাওয়া যাচ্ছে অল্প। শুরুতেই একাধিক অঙ্গ (অর্গান) আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকার ভেতরে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। দুই হাজার ৩৮৪ জনের মধ্যে হাসপাতাল ছেড়েছেন দুই হাজার ২১৩ জন আর মারা গেছেন ১৩ জন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আর বর্তমানে ভর্তি আছেন ১৫৮ জন।
তবে এই হাসপাতালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের। তাদের মৃত্যুর ঘটনা পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানোর জন্য পাঠানো হয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ( আইইডিসিআর)।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানাচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬৩ জন। আর বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এক হাজার ১৯১ জন। আর চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ হাজার ২২৮ জন। এখন পর্যন্ত ৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায় ২০১৯ সালে। কিন্তু সেবার অন্তত পাঁচ থেকে ছয়দিনের আগে রোগীর অবস্থা জটিল হতো না। কিন্তু এবারে চট করেই রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এবারে আর এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম বিরল নয়, বরং বেশিরভাগ রোগীই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে ডেঙ্গুর এই ধরন নিয়ে।শিশুদের ক্ষেত্রে এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম, অর্থাৎ লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডের জটিলতা তৈরি হতে সময় লাগছে না, দ্রুত রোগী শকে চলে যাচ্ছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে, বুকে-পেটে পানি জমছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব হলেও রোগীদের অবস্থা এত খারাপ হতো না, জটিল হতো না। কিন্তু এবারে চট করেই রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে, চিকিৎসা করার মতোও সময়টাও পাওয়া যাচ্ছে না।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার পেডিয়াট্রিকস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মাদ মনির হোসেন বলেন, যে নির্দেশিকা ( গাইডলাইন) মেনে এখন ডেঙ্গুর চিকিৎসা করা হচ্ছে সেটা এবার আর টিকছে না। এবারে ডেঙ্গু এক্সপান্ডেড সিনড্রোমে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি শিশুরা। কিন্তু ২০১৮ সালে প্রণীত ন্যাশনাল গাইডলাইন ফর ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট অব ডেঙ্গু সিনড্রোমে এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমকে খুবই বিরল বলে আখ্যা দেওয়া আছে।
চলতি বছরে ডেঙ্গুর সবচেয়ে ক্ষতিকর ধরনগুলোর একটি ডেনভি-৩ – এ বাংলাদেশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলেছেন, ডেঙ্গুর এই ধরনের কারণে দ্রুত রোগীদের রক্তের কণিকা প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। সে কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাদের হাসপাতালে নিতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে এ কারণেই চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি, দিনকে দিন রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ডেঙ্গু ভাইরাসের জিন-নকশা (জিনোম সিকোয়েন্স) উন্মোচন করে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিক গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা এসব কথা জানিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মো. আফতাব আলী শেখ জানান, এবারে সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ডেঙ্গু হওয়ার পর রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত নেমে যাচ্ছে, আগে যেটা ধীরগতিতে নামত।
এবছরের ডেঙ্গু রোগীরা দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই খুব খারাপ প্রেজেন্টেশন নিয়ে আসছে। যেমন ‑ পেটে-বুকে পানি চলে আসা, রক্তক্ষরণ হচ্ছে, অতিরিক্ত বমি হওয়া, লিভার-গলব্লাডার ইনভল্ভ হয়ে যাওয়ার কারণে রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
হাসপাতালে যত ভর্তি রোগী রয়েছে, তার মধ্যে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগীরই এ অবস্থা জানিয়ে ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ২০১৯ সালে যেসব রোগীদের অবস্থা খারাপ হতো, আক্রান্ত হবার ষষ্ঠ বা সপ্তম দিনে তাদের অবস্থা খারাপ হতো। কিন্তু এবারে আক্রান্ত হবার দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনেই মধ্যেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে।এটাই হচ্ছে ২০১৯ আর ২০২১ এর মধ্যে ডেঙ্গুর পার্থক্য।
“এবারের ডেঙ্গুতে সময় নষ্ট করার মতো সময় হাতে থাকছে না” মন্তব্য করে তিনি বলেন, নিজে নিজে বাসায় বসে চিকিৎসা, ফার্মেসি থেকে স্যালাইন নিয়ে চিকিৎসা করার মতো অবকাশ এবারে নেই। কোনওভাবেই বাসায় থেকে স্যালাইন নেওয়া যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে শরীরে পানির সংকট যেমন হচ্ছে এবারে, তেমনি বেশিরভাগ রোগী যারা মারা যাচ্ছেন ‑ তারা ‘ফ্লুয়িড ওভারলোড’ অর্থাৎ, শরীরে বেশি পানির কারণে মারা যাচ্ছেন, বেশি স্যালাইন নেবার কারণে মারা যাচ্ছেন।
Discussion about this post