প্রতাপ কুমার সরকার
নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ফিলিপাইনের র্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড ফাউন্ডেশন প্রতিবছর এশিয়ার কয়েকজন ব্যক্তিকে পুরস্কার দেয়। এশিয়ার নোবেলখ্যাত এই পুরস্কার দেওয়া হয় ফিলিপাইনের সাবেক রাষ্ট্রপতি র্যামন ম্যাগসেসের নামানুসারে। চলতি বছর র্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ফেরদৌসী কাদরী। ১২তম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। বিজ্ঞানে আত্মনিয়োগ, আন্তরিক প্রচেষ্টা ও লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচাতে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি এই পুরস্কারে পেয়েছেন।
ডক্টর ফেরদৌসী কাদরী বাংলাদেশের তো বটেই, বিশ্বেরও একজন প্রতিষ্ঠিত জীববিজ্ঞানী। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ থেকে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার কাজটি সহজ ছিল না। কঠোর পরিশ্রম আর আত্মনিবেদনের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে (তৎকালীন প্রাণরসায়ন বিভাগ) এমএসি করেন তিনি। তারপর উচ্চতর গবেষণার জন্য পাড়ি জমান ইংল্যান্ডের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে পিএইচডি শেষ করে দেশে এসে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে। পরে যোগদান করেন দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র অর্থাৎ আইসিডিডিআর,বিতে। সে সময়ের তরুণ গবেষক ডক্টর কাদেরীকে শুরু করতে হয়েছিল খালি হাতেই। কিন্তু হার না মানা সেই মানুষটি দক্ষতা ও একাগ্রতার সাথে নিজেকে উজাড় করে দেন আইসিডিডিআর,বিতে। স্বীকৃতি ও সম্মাননা মেলে দ্রুতই। স্বল্প সময়ের মধ্যেই দায়িত্ব পান ইমিউনোলজি ল্যাবের প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে। তারপর থেকে শুরু হয় ড. ফেরদৌসী কাদরীর সফলতার নতুন অধ্যায়।বিজ্ঞাপনবিজ্ঞাপন
বর্তমানে তিনি আইসিডিডিআর,বির একজন সিনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে আইসিডিডিআর,বির ইনফেকশাস ডিজিস ডিভিশনের বিভাগীয় পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন দক্ষতার সঙ্গেই। ড. কাদরীর গবেষণার লক্ষ্য মূলত সংক্রমণ রোগ নিয়ে। ১৯৮৮ সাল থেকে বিভিন্ন সংক্রমক রোগ যেমন, কলেরা, টাইফয়েড, ডায়রিয়া ইত্যাদির রোগতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা এবং এগুলো প্রতিরোধে টিকা—এসব নিয়েই আইসিডিডিআরবিতে কাজ করছেন তিনি। বিশেষ করে কলেরার টিকা নিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বের করেছেন লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানোর উপায়। সম্প্রতি কলেরা জীবাণু শনাক্ত করার দ্রুত নির্ণয় পদ্ধতি উদ্ভাবণ করেছেন। যেটার নাম কলকিট। এটা বাংলাদেশে লাইসেন্স পেয়েছে এবং এটি বাজারে ব্যাপক উৎপাদনের অপেক্ষায় আছে। কলকিট উদ্ভাবন ফেরদৌসী কাদরীর অন্যতম সেরা গবেষণা। ফলে অল্প সময়ে, অল্প খরচে বাংলাদেশের মানুষ কলেরা শনাক্ত করার সুযোগ পাবে।
২০১৮ সালে ফেরদৌসী কাদরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে টাইফয়েডের ভ্যাক্সিনের সফল ট্রায়াল হয়। ভ্যাকসিনটির নাম টাইফয়েড ভ্যাকসিন এক্সিলারেশন কনসোর্টিয়াম (টাইভ্যাক)-বাংলাদেশ। এই ট্রায়ালের গবেষণার ফল বিশ্বখ্যাত জার্নাল ল্যানসেট-এ প্রথম প্রকাশিত হয়। এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
কলেরার ওপর ফিরদৌসী কাদরীর দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ।বিশ্বখ্যাত এই জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশের স্বপ্ন বিশ্বের সব জীববিজ্ঞানীই দেখেন। কিন্তু সবার স্বপ্ন পূরণ হয় না। ফিরদৌসী কাদরী স্বপ্ন সফল হয়েছে, কারণ তাঁর সেই যোগ্যতা আছে। তার প্রবন্ধ দুটিও নিশ্চয়ই বিশ্বমানের এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাঁর এই গবেষণা কলেরার মতো জীবনঘাতী রোগ নির্মূলে সুদূর প্রসারী ভূমিকা রাখবে। শুধু কলেরা বা টাইফয়েডেরই সীমাবদ্ধ নয় ফিরদৌসী কাদরীর গবেষণা। সম্প্রতি ডক্টর কারীর নেতৃত্বে এন্টারোটক্সিজেনিক ই-কোলাই প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হয়েছে। এই ভ্যাকসিন ই-কোলাইয়ের কারণে হওয়া ডায়রিয়া নির্মূলে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।
জ্ঞানপিপাসু ড. কাদেরী কি শুধুই সংক্রামক রোগের গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন? ২০১২ সালে ফ্রান্সের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান মেরিয়াক্স ফাউন্ডেশন থেকে একটা পুরস্কারের অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আইদেশি (ideshi)। আইদেশি প্রতিষ্ঠার কাদেরীর পরিশ্রমের গল্পটা একটু ভিন্ন। ডক্টর কাদেরীর নেতৃত্বে আইসিডিডিআর,বির একদল তরুণ গবেষকরা সংক্রমক রোগ নিয়ে কাজ করছেন আইদেশিতে। জিনগত ব্যাধি ও এসব রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছেন আইদেশির গবেষকেরা। বর্তমানে আইদেশি কোভিড নির্ণয় ও করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেও বাংলাদেশ সরকারকে সর্বতোভাবে সাহায্য করছে। ফেরদৌসী কাদেরীর এই মহান উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়।
আইসিডিডিআর,বির উন্নয়নে ফেরদৌসী কাদেরী কতটুকু ভুমিকা রেখেছেন? সাম্প্রতিক কিছু জরিপ থেকে দেখা গিয়েছে দেশের ১৮ ভাগ গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় আইসিডিডিআর,বি থেকে। ১৯৬০ সালে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠানটি আজ দেশ তথা বিশ্বের কাছে অতিপরিচিত একটি গবেষণা কেন্দ্র। দীর্ঘ ৩৩ বছর আইসিডিডিআরবি,র সঙ্গে যুক্ত আছেন ড. ফেরদৌসী কাদরী। এই প্রতিষ্ঠান থেকে সবচেয় গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে ড. কাদরী ও তাঁর দলের। বর্তমানে ড. কাদেরীর সাথে গবেষণায় সম্পৃক্ত আছেন হার্ভার্ড, ম্যাসাচুসেটস, অক্সফোর্ড, মেলবোর্ন, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা।
বিশ্বের প্রথিতযশা বিজ্ঞানীদের কাছে আইসিডিডিআর,বিকে অন্যতম একটি সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপস্থাপন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন ড. ফেরদৌসী কাদেরী। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং গবেষণাগুলিকে আন্তর্জাতিক মানের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য আইসিডিডিআর,বিকে সহায়তা করে যাচ্ছেন ড. ফেরদৌসী কাদরী। উন্নত মানের পরীক্ষাগার তৈরির জন্য প্রয়োজন দক্ষ বিজ্ঞানী, আধুনিক মেশিন ব্যবস্থা ও আর্থিক সহযোগিতা ইত্যাদি। এসব ব্যাপারগুলোও এখন অনেকটাই সমাধানের পথে আইসিডিডিআর,বি। বিশেষ করে ফিরদৌসী কাদেরীকে অনুসরণ করে অনেক দক্ষ তরুণ বিজ্ঞানীই এখন ঝুঁকছেন আইসিডিডিআর,বির দিকে।


আইসিডিডিআর,বি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার অর্থ সহযোগিতার ফলে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সেক্ষেত্রে বিদেশি দাতব্য-সংস্থার কাছে আইসিডিডিআর,বিকে উন্নত মানের প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রকাশ করতে দেশীয় বিজ্ঞানীরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আর এ কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফেরদৌসী কাদরী। বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ড. কাদরীকে গবেষণার জন্য অনুদান দেওয়া হয়েছে। বিল গেটসের প্রতিষ্ঠিত এই ফাউন্ডেশনটিই এখন আইসিডিডিআরবি,র অন্যতম বন্ধুপ্রতিম প্রতিষ্ঠান। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের RO1 প্রজেক্ট পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ডক্টর কাদরীকে। এই ধরনের প্রজেক্টের দায়িত্ব পাওয়া বিশ্বের যে কোনো বিজ্ঞানীর জন্যই পরম আরাধ্য।
বিশ্বের কাছে আইসিডিডিআর,বির যে সুনাম-মর্যাদা তৈরি রয়েছে, সেটা অনেকটাই রক্ষা করে চলেছেন ফিরদৌসী কাদরী। বিনিময়ে তাকে লড়তে হয়েছে অনেক অসামঞ্জস্যতার সাথে, করতে হচ্ছে কঠোর পরিশ্রম। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, বর্তমানে তিনি পাঁচ শ দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটা দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আইসিডিডিআর,বিতে। কতখানি কর্মদক্ষতা থাকলে এ কাজে সফল হওয়া যায়, ভেবে দেখুন!
তার গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ করে সহজেই অনুমান করা যায়, তিনি নতুন কিছু ভাবতে, নতুন কিছ ভাবতে ভালোবাসেন। তিরি একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করতে পছন্দ করেন, তাই তাঁর গবেষণা জীবনে এত বৈচিত্র। ২০২০ সালের মার্চ মাসে যখন দেশব্যাপী কোভিড ১৯ মহামারির কারনে লক ডাউন ঘোষণা হয়, তখন ড. কাদরী তার গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইদেশিকে কর্মপরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে কোভিড গবেষণার উপযোগী করে গড়ে তুললেন। সত্তর বছর বয়সী মানুষটির ভিতরে ভয় কাজ করেনি সেদিন, কাজ করেছে দেশের মানুষের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ। তাঁর নেতৃত্বে আইসিডিডিআর,বির গবেষণাগারে কোভিড-১৯-এর বিভিন্ন ভ্যাকসিন ট্রায়ালের নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু হয়েছে। এটাই হয়তো দেশ ও বিশ্বের মানুষের কাছে আশীর্বাদ হয়ে আসবে ।
র্যামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড কর্তৃপক্ষ ২০২১ সালে বাংলাদেশের যোগ্য ব্যক্তির হাতেই পুরস্কার তুলে দিয়েছে, এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাঁর কর্মজীবনের সংগ্রাম ও ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ড. ফিরদৌসী কাদরী একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, যিনি সর্বদা গবেষণার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান বহুদূর। বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে রোলমডেল করার স্বপ্নটাকে সর্বদা লালন করা ড. কাদরী, আপনি ভালো থাকুন নিরন্তর।
লেখক: গবেষণা কর্মকর্তা, আইসিডিডিআর,বি
Discussion about this post