ডা. এ টি এম রফিক উজ্জ্বল
করোনা সংক্রমণের মধ্যে এবার বর্ষার শুরু থেকে ডেঙ্গুরোগীও বাড়ছে। শিশুরাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুদের ডেঙ্গুজ্বরে নানা জটিলতা হওয়ার ঝুঁকি আছে।
অন্যান্য বছর ডেঙ্গু ভাইরাসের ডেন–১ বা ডেন–২ ধরনের সংক্রমণ দেখা গেছে। কিন্তু এবার এই ভাইরাসের ডেন–৩ ও ডেন–৪ ধরনের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। এ কারণে জটিলতাও বেশি হচ্ছে। রক্তের প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আক্রান্ত রোগীদের অনেকেরই যকৃৎ আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে, কিডনির কার্যকারিতায়ও বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে। পানি আসছে বুকে ও পেটে এবং মাঝে মাঝে নিউমোনিয়া দেখা যাচ্ছে। কারও কারও ক্ষেত্রে ঘাম, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা, রক্তচাপ কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এবার তাই জ্বর হলেই করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর কথাও মাথায় রাখতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই।
যেসব লক্ষণে বুঝবেন শিশুদের ডেঙ্গু জ্বর
১. জ্বরের মাত্রা ১০২ ও ১০৩ বা এর থেকেও বেশি থাকতে পারে। এভাবে জ্বরটা তিন থেকে পাঁচ দিন থাকে।
২. মাথাব্যথা, চোখব্যথা, বমি, পেটেব্যথা সঙ্গে পাতলা পায়খানা থাকতে পারে।
৩. শরীরে দানা দানা র্যাশের মতো দেখা দিতে পারে। এ সময় শিশু একেবারে নিস্তেজ হয়ে যায়।
৪. পালস খুব কম, পানি শূন্যতা ও অনেক শিশুদের শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
৫. প্লেটিলেট খুবই কম। অনেক সময় দেখা যায় তিন লাখ থেকে চল্লিশ হাজারে নেমে যায়।
পরীক্ষা
যেকোনো জ্বরের রোগীরই ডেঙ্গু অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করানো উচিত হবে। তবে জ্বর যদি পাঁচ দিনের বেশি থাকে, তাহলে ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করাতে হবে। পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে আনুষঙ্গিক অন্যান্য পরীক্ষা করাতে হবে। এর মধ্যে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট অন্যতম। এই পরীক্ষায় প্লাটিলেট পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। পাশাপাশি শিশুর রক্তের গ্রুপ জেনে নিন। ডেঙ্গুর পরীক্ষার পাশাপাশি করোনার পরীক্ষাও করাতে হবে। কারণ, কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এখন দুটি সংক্রমণ একসঙ্গেই হতে দেখা যাচ্ছে।
করণীয়
জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ইত্যাদি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু ধরা পড়লে শিশুকে বিশ্রামে রাখুন, প্রচুর পানি বা তরল খাবার যেমন, ডাবের পানি, স্যুপ, শরবত বেশি বেশি করে দেবেন।খেতে দিন। জ্বর যদি ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হয় তাহলে প্যারাসিটামল সিরাপ বা বড়ি ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা পরপর খেতে দিন।
গা ঠান্ডা রাখতে ও জ্বর কমাতে মাথায় পানিপট্টি দিতে হবে।জ্বর বেশি হলে গা মুছিয়ে ঠান্ডা রাখতে হবে।স্বাভাবিক গোসল বন্ধ করবেন না, প্রয়োজনে কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করাবেন।
অনেকসময় প্যারাসিটামল দেওয়ার পরও জ্বর কমতে চায় না। তাই জ্বর খুব বেশি হলে (১০৩°F – ১০৫°F), সাপোজিটরি ব্যবহার করতে পারেন। মনে রাখবেন, একটা সাপোজিটরি ব্যবহারের ৮ ঘন্টার মধ্যে আর নতুন করে সাপোজিটরি দিতে পারবেন না। সারাদিনে তিনবারের বেশি সাপোজিটরি ব্যবহার করা যাবে না।
ডেঙ্গুতে ২–৩ দিন পর যখন জ্বর কমে যায়, তখনই জটিলতা দেখা দেওয়ার সময়। এ সময় প্রায় প্রতিদিন রক্তের অণুচক্রিকার পরিমাণ দেখা উচিত।
অণুচক্রিকার সংখ্যা কমতে থাকলে শিশু বারবার বমি করলে, খেতে না পারলে, পেটে ব্যথা হলে, শিশুর মধ্যে অতি অস্থিরতা বা নিস্তেজ ভাব দেখা দিলে, মুখ–দাঁত–নাক দিয়ে রক্তপাত হলে কিংবা কালো পায়খানা অথবা কালো রক্তবমি কিংবা রক্তের মতো প্রস্রাব করলে অবশ্যই হাসপাতালে নিন। মুখ-চোখ ফ্যাকাশে মনে হলে, হাত–পা অতিরিক্ত ঠান্ডা মনে হলে, ৪ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব না করলে শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
সতর্কতা
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন ওষুধ খাওয়া যাবে না। অনেক সময় জ্বর প্যারাসিটামলে না কমলে অনেকে ক্লোফেনাক সাপোজিটরি ব্যবহার করেন। এই জাতীয় জ্বর কমানোর ওষুধে ডেঙ্গি রোগীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে যেতে পারে। এগুলো কোনোভাবেই দেওয়া যাবে না। ডেঙ্গি হলে বাসায় থাকা নিরাপদ না, হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই উত্তম।
জ্বর যদি ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হয় তাহলে প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়াবেন ছয় ঘন্টা পর পর। তবে অপ্রয়োজনে বা জ্বর না মেপেই ওষুধ খাওয়াবেন না। ভুলেও বা অপ্রয়োজনে প্যারাসিটামল বা ক্লোফেনাক জাতীয় বা অন্য কোন NSAID জাতীয় ব্যথার ঔষধ; আবারও বলছি, ভুলেও খাওয়াবেন না।
এগুলো শরীরের প্লেটলেটের উপর বিরূপ প্রভাব (প্লেটলেট এগ্রিগেশনে বাঁধা দেয়া) ফেলে এবং হঠাৎ ব্লিডিং শুরু হতে পারে ও কিডনি বিকল করে দিয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল হতে পারে।
প্রতিরোধ
মশার কামড় থেকে বাঁচাতে শিশুদের সাদা বা হালকা রঙের ফুলহাতা পোশাক পরান। হাতে–পায়ে মশা নিরোধক মলম লাগাতে পারেন। বাড়িতে নেট ও মশারি ব্যবহার করুন। বাসার আশপাশ ও বারান্দা, টবে যেন পানি জমে না থাকে। নিয়মিত বাসার আশপাশে স্প্রে করুন। মনে রাখতে হবে, সবার সার্বিক প্রচেষ্টা ছাড়া ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ করা সম্ভব নয়।
ডা. এ টি এম রফিক উজ্জ্বল, রেজিস্ট্রার শিশুরোগ বিভাগ, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, ঢাকা
Discussion about this post