তুষার আবদুল্লাহ
টিলো এক্সপ্রেস খেলা এখন চূড়ান্ত পর্বে। খেলায় একটি পক্ষ নিয়মিত ম্যাচ জিতে যাচ্ছে। অপর পক্ষ কখনো কখনো সমতায় ফিরে আসা বা জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করলেও, শেষ পর্যন্ত আর পেরে উঠেনি। হেরে গেছে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। প্রায় দেড় বছরের খেলায় এখন ভয়াবহ ভরাডুবির মুখে বাংলাদেশ।
অদৃশ্য অণুজীব মহাসমারোহে জয়যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। প্রতিদিন শতকরা ত্রিশ ভাগ হারে আক্রান্ত করছে মানুষকে। প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে দুইশ’র বেশি মানুষের। মে মাসে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশ করোনাকে অনেকটাই প্রতিরোধ করতে পেরেছে। সংক্রমণের হার একক অঙ্কের কাছাকাছি চলে এসেছিল। মৃত্যুর হারও নেমে এসেছিল কুড়ির কাছে। কিন্তু ডেল্টা, আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট যখন সক্রিয় হলো, কাবু করে ফেলল গোটা ভারতকে, তখনই আশঙ্কা করা হচ্ছিল, ঐ ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে আঘাত করবে। একই বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বাংলাদেশে।
সীমান্ত এলাকা থেকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট রাজধানীমুখী হলে, সরকার ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন রাখার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সেই উদ্যোগ ছিল কাগুজে। বাস্তবে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি ঢাকাকে।
সতর্কতা জরুরি ছিল যখন, তখন সচেতন হইনি আমরা। সীমান্ত এলাকায় প্রতিরোধ তৈরি করতে দেরি হয়ে যায়। ভারত থেকে আসা যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হলেও, তাদের হাসপাতাল, হোটেলে আটকে রাখা যায়নি। শুরু হয় গণ সংক্রমণ।
সীমান্ত এলাকায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের রোগী শনাক্ত হতে শুরু করে। সীমান্ত এলাকা থেকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট রাজধানীমুখী হলে, সরকার ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন রাখার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সেই উদ্যোগ ছিল কাগুজে। বাস্তবে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি ঢাকাকে। মানুষ, পরিবহন সবই চলেছে অবাধে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টও সহজে দখল নিতে থাকে রাজধানীর।
এক সময় গ্রামের মানুষেরা বুক চিতিয়ে বলতেন, গ্রামে করোনা নেই। কারো মুখে মাস্ক দেখলে উপহাস করা হতো। একে বলা হতো বড়লোকের রোগ। গরিবের এই রোগ হয় না এমন প্রলাপ ছড়িয়ে, শহর এলাকাতেও মানুষ বেপরোয়াভাবে চলাচল শুরু করে। এবার দেখা গেল করোনা কারো প্রতি করুণা দেখাল না। ছোবল দিলো গ্রামে।
গ্রামের মানুষ দেরিতে হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন, ফলে অনেকের জীবন রক্ষা করা যাচ্ছে না। রাজশাহী, খুলনাতে একই দিনে মৃতের সংখ্যা ৬০ পর্যন্ত পৌঁছায়। এর বাইরেও মৃত্যু আছে। যারা হাসপাতালে আসেননি। মারা গেছেন উপসর্গ নিয়ে। গ্রাম, জেলা থেকে রাজধানীমুখী হতে থাকেন রোগীরা। সংক্রমণ দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। এই বাস্তবতায় সরকার কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রথম ভাবা হয় পুরো দেশ শাটডাউন করে দেওয়ার। পরে সেখান থেকে ছাড় দিয়ে বলা হয় কঠোর লকডাউনের কথা। সাতদিনের সেই লকডাউনের ঘোষণা আসে, দিন তিনেক আগে। যদিও তখনো সারাদেশে চলছিল কোমল লকডাউন। বন্ধ ছিল গণ পরিবহন চলাচল। কিন্তু কঠোরের আগে যতটুকু ফুরসত দেওয়া হলো, তাতেই রাজধানী ছেড়ে মানুষ গ্রামমুখী হতে থাকে উন্মাদের মতো। যে যেভাবে পেরেছে হেঁটে, পণ্যবাহী ট্রাকে, রিকশায়, ভাড়া গাড়িতে ছুটেছে গ্রামে। এই তালিকায় নিম্নআয়ের মানুষ ছিল বেশি। তারা ভেবেছিল কঠোর লকডাউনের কারণে তারা ঈদে বাড়ি ফিরতে পারবে না। এতে বোঝা যায়, তারা এখনো বিধিনিষেধ কর্তৃপক্ষের মন বুঝে উঠতে পারেনি।
করোনাকালের দেড় বছরে কর্তৃপক্ষ ঠিকঠাকভাবে জনগণকে ঈদে গ্রামে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তাদের বদান্যতায়, প্রতি ঈদের পরই বেড়েছে সংক্রমণের হার। ভ্যাকসিন দেওয়া শুরুর পর যেখানে করোনা নিয়ন্ত্রণে চলে আসার কথা ছিল, সেখানে করোনা বারবার টিলো এক্সপ্রেস খেলায় জিতে গেছে। এবারও নিশ্চিত তাদের জয়।
বলা হচ্ছে, অর্থনীতির মন্দা এড়াতে, জীবিকার কথা বিবেচনায় রেখে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা দোকান খুলতে রাজি নয়। কারণ যা আর্থিক ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে।
কারণ যখন করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাগত দিকে বাংলাদেশ শীর্ষ দশে জায়গা করে নিয়েছে, তখন কঠোর লকডাউনকে শিথিল করা হলো। ঘোষণা এলো, নয় দিন সব ধরনের গণপরিবহন চলবে। ১৫-২২ জুলাই কোরবানির পশুর হাটের পাশাপাশি খোলা থাকবে সকল মার্কেট, শপিংমল।
মানুষকে ঈদ করতে দেওয়ার সুযোগ দিলো স্বাস্থ্য বিভাগ বা বিধিনিষেধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। শিথিলতার ঘোষণার পরেই প্রজ্ঞাপন এলো-২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট আবার কঠোর লকডাউনে যাবে দেশ। তখন গার্মেন্টসসহ সকল কারখানাও বন্ধ থাকবে। এমন দুই ঘোষণায় ও প্রজ্ঞাপনে করোনা পরামর্শক কমিটিই শুধু নয়, হতভম্ব জনগণও। তারা বলছেন, তাহলে শিথিল সময়টাতে কি অদৃশ্য জীবাণু ঈদের ছুটি কাটাবে? সংক্রমণ বন্ধ রাখবে? পরামর্শক কমিটি বলছে, এমন এক ঝুঁকি ও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে লকডাউন শিথিল করা মানে আমরা সকলে আক্রান্ত হবো। লড়াই করে টিকে থাকব যারা, শুধু বেঁচে থাকব তারা। হারাতে হবে অনেককে।
বলা হচ্ছে, অর্থনীতির মন্দা এড়াতে, জীবিকার কথা বিবেচনায় রেখে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা দোকান খুলতে রাজি নয়। কারণ যা আর্থিক ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। ঈদ-উল-আযহাতে মানুষ কেনাকাটা করে কম। এখন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে দোকান খুললে আরও বেশি ক্ষতির মধ্যে পড়তে হবে। কিন্তু দোকানের ঝাঁপ এরই মধ্যে খুলতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা।
ঈদের আগে সারাদেশই অতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। দূরত্ব থাকবে না কারো মধ্যে। একেবারে ঈদের আলিঙ্গন। ঈদের ছুটিতে করোনার সঙ্গে যে মোলাকাত হবে, তা নিকট ভবিষ্যতে মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গনকেও আরও নিবিড় করবে বলে শঙ্কা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি গত দেড় বছরে একবারের জন্য সত্যিকার কঠোর লকডাউন দেওয়া যেত, করোনাকে মুঠোবন্দী রাখা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু শুরু থেকেই সমন্বয়হীনতার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টির ঘাটতি, আমাদের শুধু মৃত্যু আলিঙ্গনের দিকেই নিয়ে গেছে।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী
Discussion about this post