এক মাস বয়সী হাফসা এখন হাসছে, মায়ের কোলে হাত-পা ছড়িয়ে খেলা করছে। মেয়ের হাসির ঝিলিক ফুটে উঠেছে মা রুম্পা খাতুনের চোখেমুখেও। প্রাণবন্ত এই মা-মেয়ে রাজশাহী নগরীর হাদিরমোড় বউবাজার এলাকার বাসিন্দা।
দিন কয়েক আগেও চিত্রটি এমন ছিল না। গত ২৬ জুন হঠাৎ সাড়াশব্দহীন হয়ে পড়ে হাফসা। ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে যাওয়া কোমল শরীর বুকে চেপে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পথে দৌড় দেন মা। নিরুপায় হয়ে মেয়ের ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে অনবরত শ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করেন। মেয়েকে বাঁচাতে মায়ের এই প্রাণান্তকর চেষ্টা ধরা পড়ে গণমাধ্যমকর্মীদের ক্যামেরায়। পরে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
দুদিন চিকিৎসা শেষে ২৮ জুন মেয়েকে নিয়ে ঘরে ফিরেছেন মা রুম্পা খাতুন। হাফসা এখন পুরোপুরি সুস্থ। তার হাসিতে পুরো বাড়ি উদ্বেলিত।
কী ঘটেছিল সেদিন? জানতে চাইলে হাফসার বাবা সজল মনি ওরফে সিজার জানান, ২৬ জুন বেলা ১১টার দিকে হাফসাকে গোসল করান তার দাদি স্বাধীনা বেগম। গোসলের পর পানি মোছানোর সময় দাদি টের পান হাফসা নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। ওই সময় বোঝা যাচ্ছিল না ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কি না। এরপর মুখ দিয়ে ফেনা জাতীয় পদার্থ উঠতে শুরু করে। বন্ধ হয়ে যায় দুচোখ। এমন উদ্বেগজনক মুহূর্তে তিনি বাড়িতে ছিলেন না।
তিনি আরও জানান, হাফসাকে প্রথমে তার মা বাড়ির পাশের হুজুরের থেকে দোয়া-দরুদ পড়ে শরীরে ফুঁ দেন। কিন্তু তাতেও কোনো সাড়াশব্দ মেলেনি। এক পর্যায়ে মায়ের মাথায় আসে মেয়েকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা। ঠিক তখনই হাফসা অচেতন হয়ে পড়ে। কোনো কিছু না ভেবে সিজারিয়ান অপারেশন করা মা বেরিয়ে পড়েন হাসপাতালের উদ্দেশে।
মা রুম্পা খাতুন জানান, মেয়েকে বুকে চেপে রাস্তায় নামেন তিনি। কিন্তু চলমান লকডাউনে ওই সময় বাড়ির সামনে কোনো যানবাহন পাননি। নিরুপায় হয়ে মেয়েকে বুকে চেপেই হাসপাতালের পথে দৌড় দেন। খবর দেন বাচ্চার বাবাকে। এই ফাঁকে পথে পেয়ে যান এক মোটরসাইকেল আরোহীকে। কিছু দূর এগিয়ে দেন ওই মোটরসাইকেল আরোহী। এর মধ্যে রিকশা পান হাফসার বাবা।
বাবা-মা যখন মেয়েকে নিয়ে রিকশায় উঠছিলেন এমন সময় পাশ থেকে এক ব্যক্তি বলেন, মুখ দিয়ে বাইরে থেকে বাতাস দিলে শিশুটির জীবিত থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। এ কথা শোনার পর রিকশায় উঠে এক বার বাবা এক বার মা সন্তানের মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন।
রুম্পা খাতুন আরও জানান, রিকশা যখন হাসপাতালের কাছে পৌঁছায়, তখন তিনি আর মুখ দিয়ে বাতাস দিতে পারছিলেন না। সে সময় বাবা মুখ দিয়ে মেয়েকে শ্বাস দেন। হাসপাতালের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর হঠাৎ কেঁদে ওঠে হাফসা। সেই মুহূর্তে তারাও যেন প্রাণ ফিরে পান।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা প্রথমেই হাফসাকে অক্সিজেন দেন। ভর্তি করান হাসপাতালের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে চিকিৎসকরা জানিয়েছে, খিঁচুনিজনিত সম্যসায় এমনটি হয়েছিল। দুই দিনের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠে হাফসা। সোমবার (২৮ জুন) হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র মেলে তার। ওই দিনই বাবা-মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফেরে হাফসা।
হাফসার দাদি স্বাধীনা বেগম জানান, হাসপাতালে নেওয়ার সময় তারা ভেবেই নিয়েছিলেন হাফসা আর ফিরবে না। কিন্তু মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার কারণেই হাফসা এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছে, মুখের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে (মাউথ টু মাউথ ব্রেদিং) শ্বাস দেওয়া প্রাথমিক চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার অংশ। এ প্রক্রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসনালিতে জোরে হাওয়া (অক্সিজেন) দেওয়া হয়। এটিকে বলা হয় আর্টিফিশিয়াল ভেন্টিলেশন বা কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস।সুত্র- ঢাকা পোস্ট
Discussion about this post