হার্টবিট ডেস্ক
বিশ্বভ্যাপী প্রাণঘাতী করোনা মহামারিকালে চিকিৎসা গবেষণার উন্নয়নে গত বছরের ন্যায় এবারও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও (২০২০-২১) সমপরিমাণ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতির অভাবে চিকিৎসা গবেষণায় দেওয়া ১০০ কোটি টাকা এখনো পড়ে আছে।
বৃহস্পতিবার (৩ জুন) জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতের অর্জনসমূহ টেকসই করা এবং ভবিষ্যতে মহামারির অভিঘাত হতে পরিত্রাণ পাওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। এজন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য-শিক্ষা, প্রযুক্তি নির্ভর ও গবেষণা ভিত্তিক স্বাস্থ্য-শিক্ষার সম্প্রসারণ। চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের গবেষণার উন্নয়নে সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ তহবিলের জন্য চলতি অর্থবছরের ন্যায় আগামী অর্থবছরেও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হবে এবং তহবিলটি কার্যকরের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, বিজ্ঞানের নতুন ধারা ও কলাকৌশল উদ্ভাবনের জন্য ফেলোশিপ ও অনুদান প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার কাজে এ তহবিল থেকেও অর্থ বরাদ্দ করা হবে।
করোনাভাইরাস দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুর চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম আর নড়বড়ে স্বাস্থ্য খাতের প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সেবায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ খাতে ব্যাপক গবেষণা দরকার, কিন্তু এজন্য তেমন কোনো অর্থই বরাদ্দ রাখা হয় না। এরপরই ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল’ নামে একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘এক সময় এদেশে চিকিৎসা গবেষণা ছিল না বললেই চলে। তখন বিএমআরসিতে (বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ) নামমাত্র কিছু ফান্ড (অর্থ) দেওয়া হতো। কিন্তু গত বছর বিএমআরসিতে চিকিৎসা গবেষণার জন্য ১০০ কোটি টাকার একটা ফান্ড দেওয়া হলেও সেই টাকা তারা খরচ করতে পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই দেশের চিকিৎসা গবেষণা আরও ব্যাপক আকারে হোক, সেক্ষেত্রে আরও অর্থের প্রয়োজন হলে সরকার সেই টাকা বরাদ্দ দিক। তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে, বরাদ্দকৃত টাকাটা কীভাবে খরচ হচ্ছে, কী গবেষণা হচ্ছে বা কাদের মাধ্যমে কোথায় খরচ হচ্ছে। এ জায়গাটায় যদি আমরা শৃঙ্খলা আনতে পারি, তাহলে আমাদের মানসম্মত গবেষণা হবে। আর যদি শৃঙ্খলা আনতে না পারি, তাহলে এক হাজার কোটি টাকায়ও ভালো কোনো গবেষণা বেরিয়ে আসবে না।’
সৈয়দ আব্দুল হামিদ আরো বলেন, ‘শৃঙ্খলা আনার ক্ষেত্রে যে কাজটি করতে হবে তা হলো- যখনই যে গবেষণাটি করা হচ্ছে, সেই গবেষণার আউটপুট বের করে আনতে হবে এবং সেটিকে পলিসি মেকিংয়ে কাজে লাগাতে হবে। যদি এ আউটপুট কোনো কাজে লাগানো যায়, তখন বুঝতে হবে যে গবেষণাটি সাকসেসফুল (ফলপ্রসূ) হয়েছে। আর যদি আউটপুট কাজে লাগানো না যায়, তাহলে বোঝা যাবে গবেষণাটি কী মানের হয়েছে। আগে আমাদের মানসিকতা ঠিক করতে হবে যে গবেষণাটিকে আমরা কোন কাজে লাগাব। স্বাভাবিকভাবেই আপনি যদি কোনো একটা জিনিস কাজে লাগান, তখনই বুঝতে পারবেন এর মান কেমন হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক গবেষণা হচ্ছে এবং গবেষণার ফলও বের হচ্ছে। কিন্তু কোনোটি ওভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। ফলে জানাও যাচ্ছে না সেই গবেষণাটির কার্যকারিতা কেমন হয়েছে। এর ফলে এখানে কিছু সুযোগসন্ধানী লোকও এসে জায়গা দখল করে নেয়। এমনকি গবেষকদেরও গবেষণার প্রতি কোনো আগ্রহ থাকে না। গবেষণার জন্য বরাদ্দ টাকাও ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যায়। সবমিলিয়ে আমি মনে করি, ১০০ কোটি টাকাই গবেষণার জন্য যথেষ্ট। তারপরও আমরা চাই চিকিৎসা নিয়ে দেশে আরও বেশি গবেষণা হোক এবং আরও বেশি বরাদ্দ দেওয়া হোক।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) পরিচালক ডা. মাহমুদ-উজ জাহান জানান, ‘চিকিৎসা গবেষণায় শুধু টাকা দিলেই হবে না, গবেষক তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি গবেষণার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এমনকি গবেষণাকেও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আমাদের এ বিষয়গুলোতে এখনও উদ্যোগের অভাব রয়েছে। আমাদের দেশে আসলে গবেষণার সেরকম পরিবেশও নেই। সবার আগে গবেষণার জন্য ভালো একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ কাজগুলো করতে গেলে টাকা-পয়সাও লাগবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে গবেষণাতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে তাদেরকে উৎসাহ দিতে হবে। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যেন গবেষণায় মনোনিবেশ করতে পারেন, ওই ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এখন আমি রোগীও দেখব, মেডিকেল কলেজে ছাত্রও পড়াব, প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করব, আবার গবেষণাও করব— তাহলে হবে না। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কারা, কী গবেষণা করবে, কে গবেষক হবে—সেগুলো নির্ধারণ করে দিতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান গবেষণাসংশ্লিষ্ট, সেগুলোকে বরাদ্দ দিতে হবে যেন তারা গবেষকদের গবেষণার প্রতি উৎসাহ দিতে পারে।’
চলতি অর্থবছরে গবেষণা খাতে ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হলেও খরচ করা যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বিএমআরসি ভালো বলতে পারবে। আমি যেহেতু বিএমআরসিতে নেই, উত্তর দেওয়াটাও আমার পক্ষে ঠিক হবে না। তাদের হয়তো এটা নিয়ে নিজস্ব কোনো পরিকল্পনা আছে। আমি যখন ছিলাম তখন বিএমআরসিতে কোনো টাকা বরাদ্দ ছিল না। ন্যূনতম দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা আমাদের দেওয়া হতো স্বাস্থ্য অধিদফতরের মাধ্যমে।
Discussion about this post