হার্টবিট ডেস্ক
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে করোনায় বিপর্যস্ত ভারত সীমান্তবর্তী ১৭ জেলায় সংক্রমণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় এরই মধ্যে তা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলাগুলো হলো: চাঁপাইনবাবগঞ্জ, খুলনা, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জয়পুরহাট, নওগাঁ, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
দেশের সীমান্ত অঞ্চলে করোনা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক উল্লেখ করে গত ১৮ মে ৩৭টি জেলাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের সূত্রে জানানো হয়, বর্তমানে শতকরা ৪০ ভাগের ওপরে সংক্রমণ রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও খুলনায়। ২০ থেকে ২৯ ভাগ সংক্রমণ রয়েছে সিলেট, ঝালকাঠি, রাজশাহী, নাটোর, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও ফরিদপুরে।
এছাড়া নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শতকরা ১০ থেকে ১৯ ভাগ সংক্রমণের হার রয়েছে দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ফেনী, রংপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, বরিশাল, সাতক্ষীরা, গাজীপুর বগুড়া, গোপালগঞ্জ, যশোর, মাদারীপুর, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, মাগুরা, নওগাঁ, কক্সবাজার, ভোলা, নড়াইল, লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা ও টাঙ্গাইলে।
এ অবস্থায় গত ২৪ মে উত্তরের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউন ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এছাড়া আরও বেশকিছু অঞ্চলে লকডাউনের কথা ভাবছে সরকার। সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হলে সাতক্ষীরা, রাজশাহী ও খুলনাতেও লকডাউনের পরিকল্পনার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
সংক্রমণের এ অবস্থায় করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ভারতে যে নতুন ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিয়েছে, তা অনেক বেশি সংক্রমণের ক্ষমতা রাখে এবং অনেক বেশি প্রাণঘাতী। এই ভ্যারিয়ন্ট আক্রান্ত কিছু রোগী বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। যেহেতু সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ বেড়েছে সেহেতু আশঙ্কা করা হচ্ছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবেই তা বৃদ্ধি পেয়েছে।’
আঞ্চলিক লকডাউন নতুন করে সংক্রমণে কার্যকরী সমাধান উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর তা সীমান্ত অঞ্চলেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেখান থেকে সারাদেশে যেনো ছড়িয়ে না পরে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেখানে লকডাউন দেওয়া হয়েছে, লকডাউন যেন যথাযথ বাস্তবায়ন হয় সে দিকে স্থানীয় প্রশাসনকে লক্ষ্য রাখতে হবে। অন্যথায় তা সারাদেশে ছড়িয়ে পরবে।’
‘সরকার ইতিমধ্যে বেশকিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যেমন: ভারতফেরত বাংলাদেশি নাগরিকদের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। কোনোরূপ উদাসীনতা প্রদর্শন করা চলবে না। অবহেলার কারণে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পরলে দেশের জন্য নতুন করে সংকট তৈরি হতে পারে,’ যোগ করেন অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ।
আঞ্চলিক লকডাউনের কার্যকারিতা ও যথার্থতা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য, করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও ভাইরোলোজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারকে আমরা পরামর্শ দিয়েছি অধিক সংক্রমিত এলাকাগুলোতে সকলধরণের সামাজিক কার্যক্রম বন্ধ করতে এবং ব্যাপক হারে করোনার নমুনা পরীক্ষা পরিচালনা করতে। এ অবস্থায় সংক্রমণ রোধে নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের আইসোলেশন ও তাঁর পরিবারের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের মানুষ লকডাউন বুঝে না, আর সরকারও তা সম্পূর্ণভাবে কার্যকর করতে পারেনা। তাই সারাদেশে লকডাউন না করে রেপিড টেস্টের মাধ্যমে করোনা রোগী শনাক্ত ও সেই এলাকায় লকডাউন করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় নির্দিষ্ট পরিবারকে লকডাউন করা ও বাকিদের মুক্ত রাখা।’
অধিক সংক্রমিত এলাকায় ব্যবস্থাগ্রহণ
সাম্প্রতিক সময়ে করোনা সংক্রমণের হারে শীর্ষে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও সিলেট। চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা সংক্রমণের হার শতকারা ৬৩ ভাগ এবং পার্শ্ববর্তী জেলা রাজশাহীতে এই হার ৪১ ভাগ পর্যান্ত ছিল। এছাড়াও কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনাসহ বেশ কিছু অঞ্চলে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, ‘সম্প্রতি জেলার সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গত সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ৪০ ভাগের উপর ছিল এখন তা শতকরা ৩৪ ভাগে নেমে এসেছে। জেলায় বর্তমানে একটিভ করোনা রোগীর সংখ্যা ৪৭১ জন।’
স্থানীয়ভাবে কঠোর লকডাউনের সুফল পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতির অন্যতম কারণ জনগণের স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যপারে অনীহা। এছাড়া সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়াও একটি কারণ হতে পারে। আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছি। লকডাউনের সুফল আমরা পেয়েছি। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। তবে পরিস্থিতির আর অবনতি না হলে লকডাউনের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না।’
স্থানীয় প্রশাসনের কার্যক্রম তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘ভারত থেকে আগতদের কোয়ারেন্টাইন ও নমুনা পরীক্ষা নিশ্চিত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে আম বাজারসহ সকল ধরনের বাজার-হাট নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। জনগণকে মাস্কসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে।’
জেলা প্রাশাসনের গৃহীত প্রদক্ষেপ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা স্থলবন্দর দিয়ে আগত যাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করছি। যাত্রীরা ভারত থেকে আরটিপিসিআর নেগেটিভ হয়ে দেশে প্রবেশ করছে। তারপরও আমরা আবার নমুনা সংগ্রহ করছি। পুনরায় নেগেটিভ হওয়ার পর তাদের দুই সপ্তাহের হোম-কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হচ্ছে। আর যারা পজেটিভ হচ্ছেন তাঁদের হাসপাতালে আইসোলেশনে পাঠানো হচ্ছে।’
‘প্রতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন ও নমুনা সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে যে ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন তা জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সকলের সহযোগিতায় তা করা হচ্ছে’—যোগ করেন ডা. একরাম উল্লাহ।
প্রসঙ্গত, চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া বৈশ্বিক করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত বাংলাদেশেসহ সারাবিশ্ব। সম্প্রতি করোনা সংক্রমণের কেন্দ্র পরিণত হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে করোনার সংক্রমণ হার কমে আসলেও দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নতুন করে শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এক সপ্তাহে সীমন্তবর্তী সাত জেলায় ১০১ থেকে ৫০০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। সেসব অঞ্চলে নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তহার অত্যন্ত উচ্চহারে রয়েছে।
Discussion about this post