লেখা – মুশফিক মোবারক ও আসিফ সালেহ্
কোভিড-১৯-এর প্রাণঘাতী ঢেউ আমাদের আবার মনে করিয়ে দিল, কিছুতেই অসতর্ক হওয়া চলবে না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ভারতের শহরগুলোয় ইতিমধ্যে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামাঞ্চলেও এভাবে যদি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে যে বিপর্যয় দেখা দেবে, তা আমরা এখন যে পরিস্থিতি দেখছি, তাকেও ছাড়িয়ে যাবে। গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় গ্রামের বাসিন্দাদের হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ সীমিত। শহরবাসীর মতো তারা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ এবং অক্সিজেন পাবে না। গ্রামের হাসপাতালগুলোর যে সক্ষমতা, তাতে অল্প কয়েকজন রোগীতেই সেগুলো উপচে পড়বে। তা ছাড়া এসব এলাকায় ব্যাপকভাবে টিকাদান শুরু করতেও কয়েক মাস লেগে যাবে। তাই চলমান করোনাভাইরাস মহামারির নতুন ঢেউ সামাল দিতে মাস্ক পরার মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়াই এখন পর্যন্ত আমাদের সর্বোত্তম হাতিয়ার।
সাধারণ মানুষের মধ্যে মাস্ক পরার অভ্যাস তৈরি করা যে সহজ নয়, তা আমরা সবাই মোটামুটি জেনে গিয়েছি। ব্র্যাক ও যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের সর্বত্র সাধারণ মানুষের মাস্ক পরার অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁরা দেখতে পেয়েছেন, দেশের কোথাও মাস্ক পরার সুষ্ঠু অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল, স্ট্যানফোর্ড, এনজিওস ইনোভেশন ফর পভার্টি অ্যাকশন ও গ্রিন ভয়েসের একটি দল বাংলাদেশ সরকারের এটুআই কর্মসূচি এবং বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সঙ্গে মিলে দেশের সর্বত্র সব জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তুলতে কী করা যায়, তা বের করার উদ্যোগ নেয়।বিজ্ঞাপন
চার কৌশলের সমন্বয়
গবেষকেরা মাস্ক পরার হার বাড়ানোর জন্য এক ডজনের বেশি কৌশল নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁরা বাংলাদেশের ৬০০ গ্রামের সাড়ে তিন লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। এর মাধ্যমে তাঁরা সাধারণ মানুষের মধ্যে সঠিকভাবে মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তুলতে চারটি কৌশলের সমন্বয়ে তৈরি একটি পদ্ধতি বের করেন। কৌশল চারটির সমন্বিত প্রয়োগে দেখা গেছে, মাস্ক পরার হার আগের চেয়ে এবং অন্যান্য গ্রামের তুলনায় তিন গুণ বেড়েছে। এর মাধ্যমে মাস্ক পরার অভ্যাসের ধারাবাহিকতাও পেয়েছে।
গবেষণায় ১০ সপ্তাহ বা তার চেয়ে বেশি সময় ওই সব এলাকায় মানুষের মাস্ক পরার ওপর পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখা গেছে, এ বিষয়ে জনগণকে উৎসাহিত করার কার্যক্রম বন্ধ করার পরও মাস্ক পরার হার ছিল অনেক বেশি।
চারটি কৌশলের সমন্বয়ে তৈরি মডেল পদ্ধতিটিকে ইংরেজিতে নর্ম (NORM) বলা হচ্ছে। শব্দটির বাংলা অর্থ রীতি। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে
মাস্ক পরার চর্চাকে একটি সামাজিক রীতিতে রূপ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কৌশল চারটি হলো বিনা মূল্যে মাস্ক বিতরণ, সঠিকভাবে মাস্ক পরা বিষয়ে সচেতনতা তৈরি, স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে ও অন্যান্য উপায়ে রাস্তায় বা জনপরিসরে চলাচলকারী ব্যক্তিকে সঠিকভাবে মাস্ক পরতে মনে করিয়ে দেওয়া এবং স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে মাস্ক পরার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা। এ পদ্ধতিতে নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার অভ্যাসও বেড়েছে। পবিত্র জুমার নামাজের পর এ বিষয়ে ইমামদের বয়ান আরও ইতিবাচক ফল আনতে পারে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
বাংলাদেশের মাস্কবিষয়ক গবেষণার ফল অন্য দেশে প্রয়োগ
স্ট্যানফোর্ডের প্রকৌশলীরা এ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানায় যেসব উপকরণ পাওয়া যায়, সেগুলো দিয়েই উঁচু মানের দুই ধরনের মাস্ক তৈরি করেছেন। এর একটি কাপড়ের মাস্ক, অপরটি সার্জিক্যাল মাস্ক। এ দুটোর মধ্যে সার্জিক্যাল মাস্ক বেশি জনপ্রিয়। সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরিতে কাপড়ের মাস্কের তুলনায় আট ভাগের এক ভাগ খরচ হয়। অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ফিল্টারেশনের ক্ষেত্রে এসব মাস্কের কার্যকারিতা বেশি। এগুলো বারবার ধুয়ে ব্যবহার করা যায়। স্ট্যানফোর্ড এবং ভারতের গবেষণাগারে পরীক্ষায় দেখা গেছে, সাবান–পানিতে ২০ বার ধোয়ার পরেও এই মাস্কের কার্যকারিতা প্রায় একই রকম রয়েছে। গবেষণায় অংশ নেওয়া লোকজনও সার্জিক্যাল মাস্ক পরার দিকেই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন। বিশেষ করে আবহাওয়া গরম ও বেশি আর্দ্র হওয়ায় এগুলোর দিকেই তাঁরা বেশি ঝুঁকে পড়েন। মহামারির ঢেউ চলাকালে এসব মাস্ক কম টাকায় দ্রুত উৎপাদন করা যায়। প্রতিটি মাত্র পাঁচ টাকা ব্যয়ে এই মাস্ক দিনে লাখ লাখ উৎপাদন করা সম্ভব।
সাধারণ মানুষের আচরণ পরিবর্তন বিষয়ে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের বিশেষায়িত জ্ঞান, মাস্কের নকশা ও জনস্বাস্থ্য
বিষয়ে স্ট্যানফোর্ড মেডিকেল স্কুলের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান এবং বাংলাদেশজুড়ে এগুলোর সফল বাস্তবায়ন—এই তিনের সমন্বয়ে দেশি এ উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে মাস্ক পরার অভ্যাস গড়ে তুলে দারুণ ব্যয়সাশ্রয়ী উপায়ে জীবন বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে। গবেষণার ফলাফল এত আকর্ষণীয় যে ভারত-পাকিস্তান তো বটেই, লাতিন আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি এই উদ্ভাবনের প্রয়োগ ঘটানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেরও নজর কেড়েছে এই উদ্ভাবন। ‘বাংলাদেশের মাস্কবিষয়ক গবেষণা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে ভারত’ শিরোনামে খবরও প্রকাশিত হয়েছে।বিজ্ঞাপন
বেঁচে যাবে হাজার হাজার প্রাণ
মাস্ক পরার অভ্যাস ছড়িয়ে দিতে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন। এ বছর পবিত্র ঈদুল ফিতরের সাত দিন আগে এ গবেষণার ওপর একটি উপস্থাপনা দেওয়া হয় তাঁকে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির সব শপিং মল ও যানবাহন থামার জায়গায় সবাই যাতে সঠিকভাবে মাস্ক পরেন, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারকে এ উদ্যোগে শামিল করেন তিনি। এ ছাড়া নর্ম পদ্ধতির তৃতীয় কৌশল, অর্থাৎ মানুষের কাছে গিয়ে উদ্বুদ্ধ করার কাজেও নেতৃত্ব দেন তিনি নিজে। ঢাকা উত্তর সিটির বিভিন্ন জনসমাগমস্থানে উপস্থিত হয়ে মানুষকে সঠিকভাবে মাস্ক পরার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন মেয়র।
যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ভারতকে যেতে হচ্ছে, বাংলাদেশে তা এড়াতে হলে দেশজুড়ে প্রত্যেককে মাস্ক পরার সঠিক অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য কার্যকর আরও সব উপায় বের করতে হবে এবং সেগুলো দ্রুত ছড়িয়ে দিতে হবে। সেটি করার জন্য প্রস্তুত ব্র্যাক, ঠিক যেভাবে অতীতেও জনস্বাস্থ্য ও উন্নয়ন ক্ষেত্রে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সংস্থাটি। এ ক্ষেত্রে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ব্র্যাকের মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের নেটওয়ার্কের কাজ আরও জোরদার করতে গবেষকেরাও হাত মিলিয়েছেন। এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নর্ম মডেলকে দেশের ৭ কোটি ৭০ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন তাঁরা। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বড় এই জনগোষ্ঠীকে যদি সঠিক ও ধারাবাহিকভাবে মাস্ক পরার অভ্যাস করানো যায়, তাহলে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে। তার ফলে বাংলাদেশ ও বিশ্বে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বেঁচে যাবে।
দরকার সবার অংশগ্রহণ
মাস্কবিষয়ক অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি দেশের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয় কারুশিল্পীদের থেকে সঠিকভাবে তৈরি মাস্ক কিনছে ব্র্যাক। এর মাধ্যমে স্থানীয় কারুশিল্পীদের আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। নর্ম মডেল বাস্তবায়নে সংস্থার মাঠপর্যায়ে কর্মরত স্বাস্থ্যসেবিকা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বৃহৎ নেটওয়ার্ককে সহায়তা করার লক্ষ্যে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে স্বেচ্ছাসেবক ও সাহায্যকারীদের দলও গঠন করছে ব্র্যাক। এভাবে গঠিত বিপুল এক বাহিনী নর্ম মডেলে অন্তর্ভুক্ত সব কটি ধাপ বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করবে। ঘরে ঘরে মাস্ক বিতরণ, স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করা, গ্রামাঞ্চলের মানুষকে সচেতন করা ও উৎসাহিত করা এবং জনপরিসরে কোনো ব্যক্তি মাস্ক না পরে এলে ভদ্রভাবে তাঁকে বুঝিয়ে বলা। তবে এ কার্যক্রমকে পুরোপুরি সফল করতে প্রয়োজন বৃহত্তর ঐক্য। বহুল পরিমাণে মাস্ক তৈরি ও সংগ্রহ করতে হবে, যে কাজে সরকার ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। ভারতে কার্যক্রমটির দ্রুত প্রসারে কিছু ব্যক্তির উদারতার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে আমাদের।
এ কর্মসূচির মাধ্যমে অত্যন্ত কম খরচে জীবন বাঁচানো সম্ভব। কর্মসূচিটির বাস্তবায়ন অর্থনীতিকে অনিবার্যভাবে লাভবান করবে। কারণ, এর ফলে লকডাউনের সময় ও কঠোরতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, যার ফলে অর্থনীতি কোটি কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচবে। কানাডার সঙ্গে যৌথ এক কার্যক্রমে ব্র্যাক ইতিমধ্যে নিজস্ব মানবসম্পদ ও তহবিল প্রয়োগে ৭ কোটি ৭০ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছাতে কাজ করে যাচ্ছে। এ কাজে আমাদের আরও প্রয়োজন সাড়ে পাঁচ কোটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য সার্জিক্যাল মাস্ক, যা তৈরিতে খরচ পড়বে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। পুরো কার্যক্রমের লক্ষ্য সফল প্রমাণিত পদ্ধতিটির বিস্তৃত প্রয়োগ, অভ্যাস পরিবর্তন এবং সংক্রমণ হ্রাস। রোগতাত্ত্বিক উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এতে আগামী কয়েক মাসে বাংলাদেশে ১৫ হাজার জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে। এত কম বিনিয়োগে এই সফলতা যেকোনো সরকার, দাতা বা ব্যবসায়ীর জন্য রীতিমতো বিস্ময়কর। নর্ম মডেলটি ঠিক সেই সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে, যেখানে একটি প্রাণ বাঁচানোর ব্যয় মাত্র ১৭ হাজার টাকা (২০০ মার্কিন ডলার)। মডেলটি বিস্তারের মূল তাৎপর্য এখানেই। তা–ই যদি না হতো, তবে নর্ম মডেল নিয়ে এত মাথাই–বা কে ঘামাত?
● মুশফিক মোবারক, অর্থনীতির অধ্যাপক, ইয়েল ইউনিভার্সিটি এবং আসিফ সালেহ্, নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক।
Discussion about this post