হার্টবিট ডেস্ক
করোনায় আক্রান্ত অনেকের শরীরে এক ধরনের মারাত্মক ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে। যার নাম ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় মিউকরমাইকোসিস। যাদের শরীর তুলনামূলক বেশি দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে দেখা দিচ্ছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।
কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ার পর অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন মিউকরমাইকোসিসে। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ বাড়াবাড়ি জায়গায় পৌঁছে গেলে কেউ দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছেন, তা কারও বাদ যাচ্ছে চোয়াল। কেন এই সংক্রমণ? এর থেকে মুক্তির উপায়ই বা কী?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কী?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় মিউকোরমায়কোসিস বলা হয় এটি মূলত একটি বিরল ফাঙ্গাল সংক্রমণ। এই সমস্যা দেখা দিলে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। প্রায় ৫৪ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে থাকে এই আশঙ্কা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় সংক্রমিত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠলেও রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়। আর সেই সুযোগে শরীরে বাসা বাঁধতে পারে এই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। যেসব আক্রান্ত ব্যক্তি একটানা অনেকদিন আইসিইউ-তে থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন বা যাদের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের উপসর্গ


ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে সংক্রমিত হলে গালে ব্যথার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এটি হতে পারে গালের যেকোনো একপাশে কিংবা উভয় দিকেই। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নামক ছত্রাক সংক্রমণের প্রাথমিক লক্ষণ এটি। মরণঘাতি এই সংক্রমণের কারণে পরবর্তীতে তৈরি হতে পারে মুখের ক্ষতও। এসবের পাশাপাশি এই সংক্রমণের কারণে ত্বকে আরও অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এই ছত্রাক সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যে উপসর্গগুলি দেখা যাচ্ছে তা হল নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া ও নাক থেকে রক্ত পড়া; চোখ জ্বালা করা ও চোখে ব্যথা, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা ও শেষ পর্যন্ত দৃষ্টি চলে যাওয়া। নাকের চারপাশে কালো ছোপ পড়তেও দেখা যেতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন তাঁদের কাছে রোগীরা দেরি করে আসছেন, যখন তারা দৃষ্টি হারাতে শুরু করে দিচ্ছেন, ফলে অস্ত্রোপচার করে চোখ বাদ দেওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কি চোখকে প্রভাবিত করে?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস চোখকে প্রভাবিত করতে পারে এমনটাই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ছত্রাকের কারণে চোখে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে। সেইসঙ্গে দৃষ্টিশক্তি হয়ে যেতে পারে দুর্বল। এসব সমস্যার পাশাপাশি চোখ লাল হয়ে যাওয়াও হতে পারে এই সমস্যার প্রধান লক্ষণ।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কীভাবে ছড়ায়?
এই বিরল সংক্রমণটি সাধারণত মাটি, গাছপালা, সার বা পচনশীল ফল ও সব্জির মধ্যে যে শ্লেষ্মা থাকে, তার থেকেই ছড়ায়। মানুষের দেহের সাইনাস, মস্তিষ্ক ও ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এই সংক্রমণ। এটি একটি ছত্রাক সংক্রমণ, যা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে মানুষের নাক, চোখ ও কোনও কোনও সময় মস্তিষ্কের কোষকে আক্রমণ করে।ডায়বেটিস-এ আক্রান্ত ব্যক্তি বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অত্যন্ত কম অথবা ক্যান্সার কিংবা এইচআইভি/এইডস-এ আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই সংক্রমণ প্রাণহানিকর হয়ে উঠতে পারে।


কোভিড রোগীদের মধ্যে কী ভাবে ছড়াচ্ছে এই সংক্রমণ?
চিকিৎসকরা মনে করছেন, গুরুতর অসুস্থ কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় যে স্টেরয়েড ব্যবহার করা হচ্ছে, সম্ভবত তা থেকেই ছড়াচ্ছে এই সংক্রমণ। স্টেরয়েড, ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু স্টেরয়েড রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয় এবং রোগীর রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। চিকিৎসকরা মনে করছেন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াই মিউকরমাইকোসিস সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছোঁয়াচে কি না ?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছোঁয়াচে কি না তা এই প্রশ্ন অনেকেরই। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এটি ছোঁয়াচে নয়। এটি একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে সরাসরি ছড়াতে পারে না। মারাত্মক এই ছত্রাক ক্ষতিগ্রস্ত করে ফুসফুসকে। এই সংক্রমণের ফলে চোখের সমস্যা থেকে শুরু করে ত্বকের সমস্যা, অনেককিছুই দেখা দিতে পারে। এটি কতটা ক্ষতি করতে পারে তা নির্ভর করে ফাঙ্গাস কতটা শক্তিশালী এবং রোগীর শরীরের অবস্থার ওপর। অনেক করোনা রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণ হলো এই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বলতে বিশেষ ধরনের অণুবীক্ষণিক ছত্রাকের সংক্রমণজনিত বিভিন্ন রোগকে বোঝায়। এই ছত্রাক সর্বব্যাপী- মাটি, পানি ও বাতাসে ছড়িয়ে থাকলেও সংক্রমণ ক্ষমতা এতই কম যে এক লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র এক-দুই জনের দেহে এই জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। কোনো কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলেই কেবল এই সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, যেটা লাখে ২০ থেকে ৩০ জন হতে পারে।
কী ভাবে প্রতিরোধ করা যাবে এই সংক্রমণ—
১.ধুলোবালি থাকা কোনও নির্মাণস্থলে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরুন।
২.বাগানের মাটি, সার নিয়ে ঘাঁটার সময় জুতো, লম্বা প্যান্ট, লম্বা হাতা জামা পরুন।
৩ ব্যক্তিগত পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মেনে চলুন, নিয়মিত স্নান করুন।


কখন সতর্ক হবেন:
১ সাইনাসাইটিস – নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া বা নাকে সর্দি জমা, নাক দিয়ে সর্দি বের হওয়া (কালচে/রক্তসহ), চোয়ালের হাড়ে ব্যথা।
২.মুখের এক দিকে ব্যথা, অসাড় হয়ে আসা বা জ্বালা করা।
৩ নাকের আগায় বা চার পাশে কালচে হয়ে গিয়ে ত্বকের রং বদলে যাওয়া।
৪ দাঁতে ব্যথা, দাঁত আলগা হয়ে আসা, চোয়াল আটকে যাওয়া।
৫ চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া বা দু’টো করে দেখা ও চোখে ব্যথা, জ্বর, ত্বকে জ্বালা, থ্রম্বোসিস ও নেক্রোসিস।
৬ বুকে ব্যথা, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা বাড়তে থাকা।
কী করতে হবে:
১ হাইপারগ্লাইসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
২.কোভিডের চিকিৎসার পর ছাড়া পেয়ে ও ডায়াবেটিসে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দেখে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৩ সঠিক ভাবে স্টেরয়েড ব্যবহার করতে হবে – সঠিক সময়, সঠিক ডোজ ও কোর্স পূর্ণ করতে হবে।
৪.অক্সিজেন থেরাপির সময় পরিস্কার ও ফোটানো জল ব্যবহার করা।
৫.সঠিক ভাবে জেনে ছত্রাক সংক্রমণ প্রতিরোধকারী/অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হবে।
৫. ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের অন্যতম উপসর্গ দেখা যায় মুখের ভিতর ক্ষত । আর তাই চিকিৎসকরা প্রথম থেকেই মুখের ভিতরের যত্ন নিতে বলছেন।


কী করবেন না:
১ এই সংক্রমণের উপসর্গ অবহেলা করবেন না।
২ নাক বন্ধ হওয়ার ঘটনাকে ব্যাকটেরিয়াজনিত সাইনোসাইটিস বলে অবহেলা করবেন না, বিশেষত যেখানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম
৩ ছত্রাক সংক্রমণ হচ্ছে কি না, জানতে বিশদে পরীক্ষা করাতে দ্বিধা করবেন না (কেওএইচ স্টেইনিং ও মাইক্রোস্কোপি, কালচার, এমএএলডিআইটিওএফ)।
৪. মিউকরমাইকোসিসের চিকিৎসা শুরু করার ক্ষেত্রে একটুও সময় নষ্ট করবেন না।
কীভাবে সামলাবেন: ( চিকিৎসকদের জন্য)
১ ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিক কেটোঅ্যাসিডোসিস নিয়ন্ত্রণ করুন।
২ স্টেরয়েডের ব্যবহার কমান।
৩ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে এমন ওষুধ বন্ধ করুন।
৪ নেক্রোটিক উপাদান বাদ দেওয়ার জন্য অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হলে তা অবশ্যই করান।
৫.কোনও রকম অ্যান্টি-ফাংগাল প্রফিল্যাক্সিস নয়।
চিকিৎসার উপায়?
ক্যাথিটার লাগানো (পিআইসিসি লাইন)।
শরীরে জলের ভারসাম্য বজায় রাখা।
অন্তত ৪-৬ সপ্তাহ সাধারণ স্যালাইন চালু রাখা, অ্যান্টিফাঙ্গাল থেরাপিতে অ্যাম্ফোটেরিসিন বি চালু করার আগে।
রোগী কী ভাবে চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন বুঝতে রেডিও-ইমেজিং করতে হবে।
Discussion about this post