অধ্যাপক ডা. জাহির আল-আমিন
গলার স্বর বসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের সবার কম বেশি হয়েছে। অনেক কারণে গলার স্বর বসে যেতে পারে। সাধারণ কারণ থেকে মারাত্মক যে কোনো কারণে গলার স্বর বসে যেতে পারে। আমরা সাধারণত যেসব গলার স্বর বসে যাওয়া রোগী দেখে থাকি তা সাধারণত সাধারণ সমস্যার জন্য হয়ে থাকে।
অল্প চিকিৎসাতে এ কারণগুলোর সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। খুব কম সময় মারাত্মক কোনো কারণের জন্য গলার স্বর বসে যায়।
স্বরযন্ত্র বা ভোকাল কর্ড কি?
আমাদের গলার স্বর যে যন্ত্রের দ্বারা তৈরি হয় তাকে আমরা স্বরযন্ত্র বলে থাকি। এটা আমাদের গলার মধ্যভাগে অবস্থিত। একে এদাম অ্যাপল বলা হয়। এর একটু নিচে স্বরযন্ত্র অবস্থিত। এদাম অ্যাপল হল গলার সম্মুখ ভাগে যে উঁচু অংশ থাকে সেটি এবং এটি ঢোক গেলার সঙ্গে ওঠানামা করে।
আমরা স্বরযন্ত্র দ্বারা গলার স্বরের পিচ এবং ফ্রিকোয়েন্সি নির্ধারণ করে থাকি। স্বরযন্ত্র বা ভোকাল কর্ড দুই দিকে দুটি থাকে যা কথা বলার সময় ভাইব্রেট করে থাকে। ছেলেদের ক্ষেত্রে প্রতি সেকেন্ডে এটা ১৫০ থেকে ২০০ বার এবং মেয়েদের ২০০ থেকে ২৫০ বার ভাইব্রেট করে থাকে। এ থেকে বোঝা যায়, এটা কত সূক্ষ্ম একটা যন্ত্র।
এ ভোকাল কর্ড দুটি কিছু মাংসপেশি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। আমাদের দেহে চোখের কিছু মাংসপেশি ছাড়া এত sophisticated কোনো মাংসপেশি শরীরে আর নেই। এ মাংসপেশিগুলোর কার্যকারিতার মাধ্যমে ভোকাল কর্ডের টেনশন এবং ভাইব্রেশন নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। যদি এ টেনশন ভাইব্রেশনের কোনো অসামঞ্জস্য হয় তা হলে দেখা যায়, ভোকাল কর্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। আগেই জানলাম এই যন্ত্র কতখানি সূক্ষ্ম এবং জটিল কাজ নিয়মিত করে যাচ্ছে।
আমরা কথা বলার সময় প্রতিনিয়ত এটা কাজ করছে। শ্বাস নেয়ার সময়ও প্রতি মুহূর্তে এর মুভমেন্ট হচ্ছে। কাশি দিচ্ছি বা গলা পরিষ্কার করছি তখনও এটা কাজ করছে। কথা বলার সময় গলার স্বরযন্ত্রের ওপর যে চাপ পড়ে গলা পরিষ্কার করার সময় বা কাশি দেয়ার সময় এটার ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে। আমরা এ কাজের ওপর সন্তুষ্ট না হয়ে গলার ওপর আরও অন্যান্য কারণে চাপ দিয়ে থাকি।
বিভিন্নভাবে কথা বলি কোনো সময় নিচু গলায় কোনো সময় উঁচু গলায়। কেউ গলা সাধনা করে গলার স্বরের পরিবর্তন ঘটাতে চেষ্টা করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গলার চর্চা চলে। কেউ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত কেউ আধুনিক গান আবার কেউ ব্যান্ডসঙ্গীত চর্চা করে থাকেন।
এ রকম সূক্ষ্ম এবং জটিল যন্ত্র নিয়ে আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং কর্ম ব্যবস্থার অন্ত নেই। এ চোখের মাংসপেশি দিয়ে সাধারণ কাজের অতিরিক্ত কোনো কাজই আমরা করি না- দু-একটি ক্ষেত্রে নৃত্যশিল্পীদের চোখ নাচানো ছাড়া সাধারণ মানুষের অতিরিক্ত কোনো কাজ এ চোখের মাংসপেশি করে না। স্বরযন্ত্রের ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়। সাধারণের অতিরিক্ত অনেক অসাধারণ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত কাজই আমরা অনেক সময় এ স্বরযন্ত্রের মাধ্যমে করে থাকি।
গলার স্বর বসে যায় কেন ?
স্বরযন্ত্রের আশপাশের কিছু অঙ্গের সমস্যার প্রভাবও এ স্বরযন্ত্রের ওপর পড়ে থাকে। আমাদের নাকের সর্দি বা শ্লেষ্মা নাকের পেছন দিয়ে গলার ভেতরে চলে যায়। পেটের এসিড অনেক সময় উল্টা পথে গলার মধ্যে চলে আসে। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ধুলাবালি, ধোঁয়া এবং পরিবেশের দূষণীয়তা অনেক সময় আমাদের স্বরযন্ত্রে ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। কেউ যদি নাক বন্ধ থাকার কারণে নাক দিয়ে শ্বাস না নিয়ে মুখ দিয়ে শ্বাস নেন তাদের ক্ষেত্রে এ বিরূপ প্রভাব আরও বেশি হয়ে পড়ে।
সাধারণত যে কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গলার স্বর বসে যায় সেটা হল আমাদের গলার ওপর অতিমাত্রায় চাপ পড়া। সুস্থ গলা বেশকিছু চাপ সহ্য করে; কিন্তু অসুস্থ গলা পারে না। যেমনটি বলেছি যদি আমাদের নাকের প্রদাহ থাকে, নাক বন্ধ হয়ে থাকে, পেটের এসিড গলার ভেতরে চলে আসে, পরিবেশ দূষণীয় মাত্রা বেশি পরিমাণ থাকে, আমরা যদি ধুলাবালির মধ্যে কাজ করি, যদি সিগারেট খাই- এগুলোর অনেক কারণেই আমাদের গলা বা স্বরযন্ত্র তার স্বাভাবিক সুস্থতা হারায়।
এ অসুস্থ গলা বেশি মাত্রায় চাপ সহ্য করতে পারে না। অল্প কথা-বার্তাতেই এ অঙ্গ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে যাকে আমরা সাধারণ কথায় গলার স্বর বসে যাওয়া বলে থাকি। যদি গলা সুস্থ থাকে; কিন্তু ইনফেকশন হয়, অতিমাত্রায় গলাবাজি করে থাকি বা অতিমাত্রায় গলা খাকারি দিয়ে গলার ওপর প্রেসার তৈরি করে থাকি তাহলেও সুস্থ গলা অনেক সময় এ বেশি মাত্রার চাপ নিতে পারে না।
ফলে গলা বা স্বরযন্ত্র তার কর্মক্ষমতা হারায় এবং আমাদের গলা বসে যায়। কদাচিৎ দেখা যায়, আমরা গলা বা স্বরযন্ত্র দ্বারা সুচারুরূপে কাজ করতে পারি না। এ ক্ষেত্রে নরমাল কথাবার্তা বললেও গলার ওপর অতিরিক্ত প্রেসার পড়ে যায়।
গলার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়লে কয়েকটাভাবে এটা আমাদের স্বরযন্ত্রকে আক্রান্ত করতে পারে। যারা বেশি চেঁচামেচি করেন বা উচ্চ গলায় কথা বলেন তাদের স্বরযন্ত্রের ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। একে আমরা বলি ভোকাল কর্ড নডিউল। যদি গলায় বেশি মাত্রায় প্রদাহ হয় তাহলে অনেক সময় স্বরযন্ত্রের ত্বকের আবরণী মিউকোসা ফুলে যেতে পারে। একে আমরা ভোকাল কর্ড পলিপ বলি। যদি স্বরযন্ত্রের ওপর বেশি মাত্রায় টেনশন পড়ে তাহলে অনেক সময় পুরো স্বরযন্ত্রের ভেতরে পানি জমে যেতে পারে যাকে আমরা ভোকাল কর্ড ইডিমা বলি। স্বরযন্ত্রের ভেতর যক্ষ্মা বা সিফিলিস হয়েও গলার স্বর বসে যেতে পারে। আমাদের দেশে যক্ষ্মার সমস্যা প্রকট কিন্তু স্বরযন্ত্রের যক্ষ্মা খুব বেশি হয় না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে গলার ভেতরে হঠাৎ ইনফেকশন হলেও গলার স্বর বসে যেতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটা ঠাণ্ডা লাগা যাকে মেডিকেল ভাষায় কমন কোল্ড বলা হয়ে থাকে।
একটা কথা অবশ্যই বলে রাখা দরকার অনেক সময় স্বরযন্ত্রের ক্যান্সার হলে গলার স্বর বসে যেতে পারে। মাথা ও গলায় ক্যান্সারের মধ্যে স্বরযন্ত্রের ক্যান্সার বিদেশে সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। আমাদের দেশে মুখ এবং জিহ্বার ক্যান্সার পান-সুপারিজাতীয় জিনিস খাওয়ার ফলে বেশি হয়ে থাকে। তবুও স্বরযন্ত্রের ক্যান্সারের মাত্রা নিতান্ত কম নয়। আমরা সচরাচর যে রকম গলার স্বর বসে যাওয়া দেখে থাকি এদের মধ্যে খুব কম লোকেরই গলাতে টিউমার বা ক্যান্সার আছে। গলায় যদি ক্যান্সার হয়ে থাকে তাহলে খুব প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করা বাঞ্ছনীয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করালে গলার ক্যান্সারও ৯৫ শতাংশের ওপরে নিরাময় হয়।
গলার স্বর বসে গেলে কী করব?
আমাদের পরামর্শ হল এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। গলার স্বর বসে যাওয়া আমাদের শরীরের একটা প্রটেকটিভ রেসপন্ড টু ট্রমা অর্থাৎ আমাদের শরীর বলছে যে এটার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে যাচ্ছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে গলার স্বর বসে গিয়ে। এ পর্যায়ে গলার বিশ্রাম দরকার।
হাঁটতে গেলে পায়ে ব্যথা হলে আমরা যে রকম হাঁটা বন্ধ করে বসে পড়ি, ঠিক সে রকম কথা বলতে গিয়ে গলার স্বর বসে গেলে আমাদের উচিত কথা বন্ধ করে দেয়া। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য, আমরা সাধারণত এর উল্টাটা করে থাকি। আমরা আরও জোরে জোরে প্রেসার দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করি। এটা ভুল।
গলার স্বর বসে গেলে গলাকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দেয়া উচিত। জোরে জোরে কথা বলার চেষ্টা করা উচিত নয়। অনেকে আবার এ রকম অবস্থাতেই কথা না বলে ফিসফিস করে কথা বলে থাকেন- এটাও ঠিক নয়। ফিসফিস করে কথা বললে দেখা যায়, গলার ওপর আরও বেশি মাত্রায় চাপ পড়ে যায়। কথা বন্ধ মানে হচ্ছে কথা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখা। যদি দু-একটা কথা বলতেই হয় তাহলে সাধারণভাবে কথা বলা উচিত। কথা বন্ধ রাখাটা ২ থেকে ১ দিন থেকে ২ থেকে ১ সপ্তাহ পর্যন্ত অসুখের প্রকারভেদে মেনে চলা উচিত।
অনেক সময় গলায় ইনফেকশন থাকলে এন্টিবায়োটিক খাওয়া লাগতে পারে। যাদের গলায় পেট থেকে এসিড চলে আসে, যাকে আমরা রিফ্লাক্স ইসোফ্যাজাইটিস বলি, তাদের সাধারণ এসিডের ওষুধ খেলেই সমস্যার সমাধান হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ উপায়েই গলা বসা সমস্যার নিরাময় হয়ে থাকে। ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে গলার স্বর সম্পূর্ণ বা মোটামুটি ফেরত না এলে অবশ্যই গলার ভেতর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করে নেয়া উচিত। গলার ভেতর মারাত্মক কোনো সমস্যা তৈরি হচ্ছে কিনা। আগে আমরা আয়না দিয়ে গলার ভেতর পরীক্ষা করতাম, এখন এনডোস্কোপের সাহায্যে অতি সহজে গলার ভেতর পরীক্ষা করে দেখতে পারি। এতে রোগীর কোনো অসুবিধা হয় না, আমাদের দৃষ্টি খুব ভালো হয় এবং গলার ভেতর রোগীকেও স্ক্রিনের মাধ্যমে দেখা সম্ভব।
কী ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন?
কী ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন তা নির্ভর করে আমরা গলার মধ্যে কী সমস্যা পাচ্ছি তার ওপর। গলার ভেতরে নডিউল পলিস ইডিমা হলে মাইক্রোসার্জারির মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। গলার ভেতর যদি খারাপ কিছু দেখা যায় তাহলে আমরা অনেক সময় বায়োপসি করে দেখি এটা টিউমার বা ক্যান্সার কিনা। গলার ভেতরে ক্যান্সার হলে এবং তা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে ছ্যাঁক বা রেডিওথেরাপির মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা সম্ভব। গলার ক্যান্সার যদি দেরি করেও ধরা পড়ে তাহলে অপারেশনের মাধ্যমে এর অনেকটাই নিরাময় সম্ভব। অবশ্য বলে রাখা দরকার ক্যান্সারকে কোনো সময় অবহেলা করা উচিত নয়। যত প্রাথমিক পর্যায়ে এর চিকিৎসা শুরু করা যাবে ততই চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ হবে এবং চিকিৎসা সাফল্যও বেশি হবে।
লেখক : নাক, কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন
Discussion about this post