হার্টবিট ডেস্ক
রক্ত থেকে অতিরিক্ত তরল ও বর্জ্যকে বের করে দেওয়াই কিডনি বা বৃক্কের কাজ। কিডনির এই পরিস্রুত করার ক্ষমতা চলে গেলেই শরীরে প্রচুর তরল ও বর্জ্য জমা হয়ে যায়, যার ফলে কিডনি বিকল হয়ে যায়।
কিডনি প্রতিস্থাপন কখন করার প্রয়োজন হয় এবং এটা কী ভাবে করা হয়?
কিডনি যখন তার স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপের শুধু একটা ভগ্নাংশ সম্পন্ন করে, তখন সেটাকে বলা হয় শেষ পর্যায়ের কিডনি রোগ। এই পর্যায়ের কিডনি বিকলতা থাকা রুগিদের নিয়মিত ডায়ালিসিস করিয়ে তাঁদের রক্তপ্রবাহ থেকে বর্জ্যকে বের করে আনা হয় বা তাঁদের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
যে-ব্যক্তির কিডনি ঠিক করে কাজ করছে না, তাঁর শরীরে কোনও জীবিত বা মৃত ব্যক্তির সুস্থ কিডনি নিয়ে এসে বসিয়ে দিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
শেষ পর্যায়ের কিডনি রোগ হওয়ার বিভিন্ন কারণ
ডায়াবেটিস
ক্রনিক, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ
ক্রনিক গ্লামেরুলোনেফ্রাইটিস, এ এমন এক প্রদাহ যার ফলে অবশেষে কিডনির মধ্যকার ছোট ছোট ছাকনিতে দাগ বসে যায়
পলিসিস্টিক কিডনি রোগ
কিডনি প্রতিস্থাপনের টিম
কিডনি প্রতিস্থাপন করাটা ঠিক হবে কি না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের মতামতের প্রয়োজন হয়। এই টিমে থাকতে পারেন:
ইউরোলজিস্ট
প্রতিস্থাপনকারী সার্জন
প্রতিস্থাপন সমন্বয় রক্ষী
ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে আলোচনার জন্য সমাজকর্মী
মনোবিদ
অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট
যদি কোনো রোগীর কিডনি কাজ না করে, তবে তাকে আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে কিডনি প্রতিস্থাপন করার জন্য চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন হয়। ১৯৫০ সাল থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় এবং তখন থেকেই কীভাবে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কিডনি প্রত্যাখ্যান প্রতিরোধ করা যায় তা জানার চেষ্টা হচ্ছে। কিডনি প্রতিস্থাপন হলেই যে একটি রোগী সম্পূর্ণ সু্স্থ হয়ে যাবে। তা কিন্তু না_ রোগীকে আজীবন ওষুধ খেতে হবে। একটি সফল কিডনি প্রতিস্থাপন নির্ভর করে মেডিকেল টিমের (কিডনি বিশেষজ্ঞ, কিডনি প্রতিস্থাপন সার্জন, ফার্মাসিস্ট, সমাজকর্মী) সম্মিলিত প্রয়াসে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সাহায্য লাগে রোগীর নিজের ও রোগীর পরিবারের সদস্যদের। রোগীর নিজ ও রোগীর পরিবারের সদস্য এবং মেডিকেল টিমের সম্মিলিত সেবায় রোগী সুস্থ ও স্বাভাবিক কর্মজীবন লাভ করতে পারেন।
কিডনির কার্যকারিতা যখন হারায় : সুস্থ কিডনি অতিরিক্ত পানি, মিনারেল ও বর্জ্য পদার্থ শরীর থেকে বের করে দেয়। কিডনি অবশ্য হরমোন তৈরি করে আমাদের শরীর সুস্থ ও হাড় শক্ত রাখে। যখন কিডনি কার্যকারিতা হারায়, ক্ষতিকর বর্জ্য শরীরে জমা হয়ে রক্তচাপ বাড়ায়, শরীরে অতিরিক্ত পানি জমা হয় এবং পর্যাপ্ত লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হয় না। তখন রোগীর অকার্যকর কিডনির প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়।
যেভাবে প্রতিস্থাপিত কিডনি কাজ করে : কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে একজন অসুস্থ মানুষের অকার্যকর কিডনির বদলে কোনো সুস্থ মানুষের কিডনি স্থাপন করা। নতুন স্থাপিত কিডনি অকার্যকর কিডনির বদলে কাজ করে। কিডনি সার্জন নতুন কিডনি তলপেটে স্থাপন এবং রক্তনালির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন। নতুন স্থাপিত কিডনির ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার পর স্বাভাবিক কিডনির মতো মূত্র তৈরি করে। যদি কোনো সংক্রমণ বা উচ্চ রক্তচাপ না হয়, তবে আগের কিডনি রেখে দেওয়া হয়। কিডনি প্রতিস্থাপন : কিডনি প্রতিস্থাপন সব রোগীর লাগে না। যখন বিকল্প চিকিৎসা না থাকে তখন কিডনি চিকিৎসক পরামর্শ দেন কিডনি প্রতিস্থাপনের।
কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, যেমন_ রক্ত, এক্স-রে এবং অন্যান্য পরীক্ষা, যা প্রতিস্থাপিত কিডনি রোগীর দেহে ভালো থাকবে কি-না তা জানা যায়। মেডিকেল টিম অবশ্য দেখে রোগী এত বড় অপারেশনের জন্য উপযুক্ত কি-না? ক্যান্সার, সংক্রমণ, হৃদরোগ থাকলে কিডনি প্রতিস্থাপন সফল নাও হতে পারে। যদি কোনো পরিবারের সদস্য অথবা কোনো বন্ধু কিডনি দান করতে ইচ্ছুক হন, কিডনি প্রতিস্থাপন সফলতার জন্য তাকেও কিছু পরীক্ষা করতে হয়। যদি পরিবারের সদস্য অথবা কোনো বন্ধু কিডনি দান করতে ইচ্ছুক না হন, তবে রোগীকে কিডনি প্রতিস্থাপনের অপেক্ষমাণ তালিকায় নাম লিখতে হবে, যাতে কোনো মৃত রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায় (কিন্তু এটা বাংলাদেশে প্রযোজ্য নয়)। সরকার নিয়মিতভাবে কিডনি দানের উৎকৃষ্ট ও নিরাপদ পন্থা পর্যবেক্ষণ করছে।
কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য কিছু পরীক্ষা দরকার :
রক্ত : গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ (এ, বি, এবি, ও) অবশ্যই দাতার রক্তের সঙ্গে মিলতে হবে।
এইচএলএ ফ্যাক্টর : এটা হচ্ছে হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন, যা বংশগতভাবে শ্বেত রক্তকণিকায় থাকে।
অ্যান্টিবডি কিডনি প্রতিস্থাপন অপারেশন : যদি জীবিত মানুষের কিডনি পাওয়া যায়, তবে দাতা এবং গ্রহীতার অপারেশন একই সময়, পাশাপাশি রুমে করা হয়। এক মেডিকেল টিম দাতার কিডনি কেটে আনে, অন্য মেডিকেল টিম গ্রহীতাকে কিডনি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করে। নতুন কিডনির রক্তনালি গ্রহীতার রক্তনালির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। প্রতিস্থাপিত কিডনির মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিডনি মূত্র তৈরি করে। অনেক সময় কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে।
কিডনি অপারেশনের পরবর্তী অবস্থা : যে কোনো বড় ধরনের অপারেশনের পর রোগী বেশ অসুস্থ বোধ করতে পারেন। আবার অনেক রোগী অপারেশনের পরপর খুব ভালো বোধ করেন। রোগী সুস্থবোধ করলেও রোগীকে কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়। আর যদি জটিলতা সৃষ্টি হয় তাহলে আরও বেশি দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। কিডনি প্রতিস্থাপন অপারেশন পরবর্তী যত্ন : গ্রহীতার ইমিউনো সিস্টেম নতুন কিডনি বহিরাগত হিসেবে বিবেচনা করে। এজন্য গ্রহীতাকে কিছু ওষুধ খেতে হয়। নতুন কিডনি প্রত্যাখ্যান :নতুন কিডনি প্রত্যাখ্যান না হওয়ার জন্য যেমন ওষুধ খেতে হয়, তেমনি জ্বর, পেটে ব্যথা ও মূত্র তৈরির পরিমাণের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হয়। যদি কোনো সমস্যা হয় তবে সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল টিমকে জানাতে হবে। সবকিছু স্বাভাবিক থাকার পরেও কিডনি প্রত্যাখ্যাত হতে পারে এবং রোগীকে ডায়ালাইসিস করতে হতে পারে।
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া :কিছু ওষুধ শরীরের ইমিউনো সিস্টেমকে দুর্বল করে। এতে সংক্রমণ হতে পারে। কিছু ওষুধের জন্য মুখে পানি, ওজন বাড়া, মুখে ব্রণ, মুখে চুল হতে পারে। কিন্তু সব রোগীর এ রকম হয় না। এ জন্য সুষম খাদ্য ও সঠিক পরিচর্যা করতে হবে। কিছু ওষুধের জন্য ক্যান্সার, চোখের ছানি, অতিরিক্ত অম্ল, উচ্চ রক্তচাপ, হাড়ের রোগ হতে পারে। অনেক দিন এসব ওষুধ খাওয়ার ফলে লিভার ও কিডনি রোগ হতে পারে। আর্থিক অবস্থা :কিডনি প্রতিস্থাপন ব্যয়বহুল চিকিৎসা হলেও এখন ঢাকার অনেক হাসপাতালে এ চিকিৎসা করা হয়। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে কিডনি প্রতিস্থাপন হয় ১২০টি এবং ২০১০ সালে ১৭৫টি। বাংলাদেশের অনেক নতুন হাসপাতাল এখন কিডনি প্রতিস্থাপনে এগিয়ে আসছে।
কিডনি দান :
মৃত ব্যক্তির কিডনি দান :
বিদেশে সবচেয়ে বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন হয় মৃত ব্যক্তির কিডনি দান থেকে। কিন্তু বাংলাদেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য মৃত ব্যক্তির কিডনি প্রায়ই পাওয়া যায় না। পরিবারের সদস্যদের অজ্ঞতার জন্য অনেক উপযুক্ত কিডনি কোনো কাজে আসে না। যারা কিডনি দান করতে চান তাদের উচিত এ ব্যাপারে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা এবং জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশনের উচিত একটি কিডনি দান কার্ড প্রদান করা। কিডনি দান কার্ডে ব্যক্তির কিডনি দানের ইচ্ছার কথা লেখা থাকবে।
জীবিত ব্যক্তির কিডনি দান :
জীবিত পারিবারিক সদস্য অথবা বন্ধুদের কিডনি দানের জন্য কিডনি প্রতিস্থাপন ধীরে ধীরে বাড়ছে। কিডনিদাতা ও কিডনি গ্রহীতার কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, যাতে তাদের পরবর্তী জীবন বিপদমুক্ত থাকে। যদিও অনেকেই কোনো রকম বিপদ ছাড়াই কিডনি দান করতে পারেন। বর্তমান আইনে আমাদের দেশে শুধু পারিবারিক সদস্যরা কিডনি দান করতে পারেন। মৃত ব্যক্তির কিডনি থেকে জীবিত ব্যক্তির কিডনি দান অনেক সুবিধা। জীবিত পারিবারিক সদস্য অথবা বন্ধুদের কিডনি দানের জন্য কিডনি প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে না। জীবিত ব্যক্তির কিডনি দানের জন্য অনেক সময় এবং অপারেশনের জন্য উপযুক্ত সময় পাওয়া যায়। জীবিত পারিবারিক সদস্যের কিডনি অনেক ভালো কাজ করে, যদিও এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। জীবিত ব্যক্তির কিডনি অন্য জায়গা থেকে আনার প্রয়োজন হয় না এবং এজন্য কিডনির অবস্থাও ভালো থাকে। জীবিত ব্যক্তির কিডনি দান মৃত ব্যক্তির কিডনি দানের তালিকাকে দীর্ঘায়িত করে না।
সরকারি কিডনি প্রতিস্থাপন কেন্দ্র :
জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, ঢাকা। বেসরকারি কিডনি প্রতিস্থাপন কেন্দ্র : জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশন ও হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল, পপুলার স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল, অ্যাপোলো হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল, ঢাকা। টিস্যু টাইপিং ও অন্যান্য পরীক্ষা কেন্দ্র : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল, ফাস্ট ল্যাব, ঢাকা। ফাস্ট ল্যাব রাজধানীতে কিছুদিন আগে যাত্রা শুরু করেছে; যেখানে অনেক দ্রুত মানসম্মতভাবে টিস্যু টাইপিং করা হয়।
Discussion about this post