লিভার বা যকৃৎ হল একটি আবশ্যিক প্রত্যঙ্গ, যা পাচকনালী থেকে আসা রক্তকে পরিস্রুত করে পুরো শরীরে ছড়িয়ে দেয়। পেশি গড়ে তুলতে, সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে ও রক্তকে জমাট বাঁধতে না-দেওযার জন্য প্রয়োজনীয় কেমিক্যালকে বিষমুক্ত বা ডিটক্সিফাই করা, ওষুধপত্রকে বিপাক বা মেটাবলাইজ করা এবং প্রোটিনকে সংশ্লেষিত বা সিন্থেসাইজ করার কাজ করে লিভার।
লিভার প্রতিস্থাপন কী এবং কখন এর প্রয়োজন হয়?
লিভার প্রতিস্থাপন হল এমন এক সার্জারি যার মাধ্যমে অসুস্থ লিভারকে সরিয়ে তার জায়গায় সুস্থ লিভার বসিয়ে দেওয়া হয়। লিভার যখন পর্যাপ্ত ভাবে কাজ করতে পারে না (লিভার বিকল হয়ে যায়) তখন লিভার প্রতিস্থাপন করার কথা ভাবা হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের লিভার প্রতিস্থাপন করা হয় মূলত সিরোসিস হলে, এবং শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রয়োজন হয় বাইলিয়ারি আট্রেজিয়া হলে। ভাইরাল হেপাটাইটিস, লিভার ক্যানসার ও বংশগত রোগ হলেও লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়ে থাকে।
প্রতিস্থাপন টিম
লিভার প্রতিস্থাপন করাটা ঠিক হবে কি না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন হয়। এই টিমে থাকেন:
লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ (হেপাটোলজিস্ট)
প্রতিস্থাপনকারী সার্জন
প্রতিস্থাপন সমন্বয় রক্ষী
পুষ্টিবিদ
ফিজিওথেরাপিস্ট
মনোবিদ
অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট
লিভার প্রতিস্থাপন সার্জারি
জীবিত লিভার-দাতার লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন সার্জারিতে জীবিত ও সুস্থ দাতার লিভারের একটা অংশকে বের করে এনে গ্রহীতার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। এটা সম্ভব হয় কেননা লিভারের ক্রিয়াশীলতাকে সংরক্ষণ করার ক্ষমতা বিশাল (70%) এবং এর পুনর্গঠিত হয়ে ওঠার ক্ষমতাও আশ্চর্য রকমের। দাতা ও গ্রহীতা দুজনেরই লিভারের অংশগুলো কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্বাভাবিক আকৃতি পেয়ে যায়।
মৃত লিভার-দাতার লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন সার্জারিতে দাতার মস্তিষ্ক চিরদিনের জন্য অকেজো হয়ে যায় এবং এই অবস্থার পুনরুদ্ধার করা যায় না। মৃত ব্যক্তির অন্যান্য প্রত্যঙ্গের মতো লিভারও দান করা হয় তাঁর নিকটতম আত্মীয়ের সম্মতি নিয়ে।
লিভার প্রতিস্থাপনের অপারেশন করতে সাধারণত 6 থেকে 10 ঘণ্টা সময় লাগে। অসুস্থ লিভারকে বের করে এনে তার জায়গায় দাতার লিভার বসানো হয়। নতুন লিভার প্রতিস্থাপন করার আগে সার্জন অসুস্থ লিভারকে পিত্তনালী ও রক্তনালী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন।
নতুন লিভার যাতে স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে থাকে এবং শরীর যাতে নতুন লিভারকে প্রত্যাখ্যান করতে না-পারে, তার জন্য প্রতিস্থাপন পরবর্তী পরিচর্যা, যেমন ওষুধপত্র খাওয়ানোর ব্যবস্থা রাখা হয় হাসপাতালে এবং বাড়িতে। সফল ভাবে লিভার প্রতিস্থাপন হলে পর একজন ব্যক্তি ফের তাঁর কাজের জগতে, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন।
লিভার প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন কখন হয়?
গুরুতর লিভার রোগ হলেই লিভার প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন হয়। এই রোগের নানা কারণ রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের লিভার প্রতিস্থাপন করার সবচেয়ে বড় কারণ হল সিরোসিস। এই সিরোসিস হলে লিভার আস্তে আস্তে খারাপ হতে থাকে এবং ক্রনিক আঘাতের ফলে অকেজো হতে শুরু করে। খারাপ কোষকলা লিভারের সুস্থ কোষকলার জায়গা দখল করে। এরা লিভার থেকে হওয়া রক্তপ্রবাহকে বাধা দেয় আংশিক ভাবে। সিরোসিস নানা কারণে হয়। যেমন হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস, মদ্যপান, লিভারের স্বয়ং-প্রতিরোধী রোগ, লিভারে চর্বি জমা হওয়া ও বংশগত লিভার রোগ।
অত্যধিক মদ্যপান করার ফলে লিভারে সিরোসিস হওয়া বহু লোকেরও লিভার প্রতিস্থাপন করার দরকার হয়। বহু রোগীই আবার দীর্ঘদিন লিভার প্রতিস্থাপন না-করেও বেঁচে থাকতে পারেন। তাঁদেরকে শুধু মদ্যপান থেকে বিরত থাকতে হয় এবং 6 মাস ধরে লিভার সংক্রান্ত নানা সমস্যার চিকিৎসা করাতে হয়। তবেই তাঁদের লিভার বেশ ভাল ভাবেই সুস্থ হয়ে ওঠে। যেসব রুগির লিভার রোগ খুব বেড়ে যায়, এবং বহুদিন ধরে মদ্যপান থেকে বিরত থেকে ও চিকিৎসা করা সত্ত্বেও যাঁদের লিভার সেরে ওঠে না, তাঁদের জন্য লিভার প্রতিস্থাপনই হল একমাত্র চিকিৎসা।
শিশুদের মধ্যে লিভার প্রতিস্থাপন করার সবচেয়ে বড় কারণ হল বাইলিয়ারি আট্রেজিয়া। সদ্যোজাত শিশুদের বাইলিয়ারি আট্রেজিয়া নামক এই বিরল রোগ হয় লিভার ও ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্যবর্তী অভিন্ন পিত্তনালী ব্লক হয়ে থাকলে বা এই পিত্তনালী একেবারেই না-থাকলে। লিভার থেকে পিত্তকে নিয়ে আসা পিত্তনালী না-থাকলে বা নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকলে বাধাপ্রাপ্ত পিত্তগুলোর জন্যই সিরোসিস হয়। পিত্তর কাজ হল খাবারকে হজম করানো। এই রোগ ধরা না-পড়লে লিভার পরে পুরো অকেজো হয়ে যায়। তবে এই রোগ কেন হয়, তা জানা যায় না। এর একমাত্র মোক্ষম চিকিৎসা হল নির্দিষ্ট কিছু সার্জারি বা লিভার প্রতিস্থাপন।
লিভার ক্যানসার, বিনাইন (বিপজ্জনক নয়) লিভার টিউমার ও বংশগত রোগের ক্ষেত্রেও লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়।
কার লিভার প্রতিস্থাপন করা দরকার তা কী ভাবে নির্ধারণ করা হয়?
লিভার প্রতিস্থাপন করাটা ঠিক হবে কি না তা নির্ধারণ প্রয়োজন হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন। আপনার মেডিক্যাল হিস্ট্রি ও অন্যান্য নানা ধরনের টেস্ট করে এই মূল্যায়ন করা হয়। আপনার লিভার প্রতিস্থাপন করার দরকার আছে কি না এবং প্রতিস্থাপনের কাজটা সুরক্ষিত ভাবে করা যাবে কি না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওযার জন্য প্রতিস্থাপন টিম রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রে ও অন্যান্য নানা টেস্ট করিয়ে থাকেন। সার্জারির ধকল সহ্য করতে পারার মতো জোর আপনার আছে কি না তা জানার জন্য আপনার স্বাস্থ্যের অন্যান্য দিক, যেমন আপনার হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, মানসিক স্বাস্থ্য ইত্যাদিও পরীক্ষা করে দেখা হয়।
লিভারের সমস্যা থাকা যে কোনও লোকই কি প্রতিস্থাপন করাতে পারেন?
আপনি প্রতিস্থাপন করাতে পারবেন না, যদি:
আপনার শরীরের অন্য কোনও অংশে ক্যানসার থাকে
আপনার হৃদযন্ত্র, ফুসফুস বা স্নায়ুর গুরুতর কোনও রোগ থাকে
আপনার মদ ও মাদকাসক্তি থাকে
আপনার কোনও সক্রিয় ও গুরুতর সংক্রমণ থাকে
আপনি ঠিক মতো ডাক্তারের বলে দেওয়া নিয়ম মেনে চলতে না-পারেন
প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত কী ভাবে নেওয়া হয়?
রুগির পরিচর্যায় যুক্ত সমস্ত লোক, ডাক্তার ও রুগির পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিবারের লোকের মত নেওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা যেন স্পষ্ট ভাবে বোঝেন যে লিভার প্রতিস্থাপনের কী কী ঝুঁকি আছে এবং এর থেকে কী কী লাভই বা পাওয়া যায়।
নতুন লিভার পেতে কত সময় লাগে?
আপনি যদি লিভার প্রতিস্থাপনের সক্রিয় প্রার্থী হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার নাম প্রতীক্ষারতদের তালিকায় রাখা হবে। রক্তের প্রকার, শরীরের আকৃতি ও মেডিক্যাল কন্ডিশন (রুগি কতখানি অসুস্থ) অনুযায়ী রুগিদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। প্রত্যেক রুগিকে সাধারণ কয়েকটা রক্ত পরীক্ষার (ক্রিয়েটিনাইন, বিলিরুবিন ও INR)ভিত্তিতে প্রায়োরিটি স্কোর বা প্রাধান্য প্রদান পূর্বক নম্বর দেওয়া হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এই স্কোর MELD (মডেল অব এন্ড স্টেজ লিভাৰ ডিজিজ) নামে পরিচিত এবং শিশুদের ক্ষেত্ৰে এই স্কোর পরিচিত PELD (পেডিয়াট্রিক এন্ড স্টেজ লিভার ডিজিজ) নামে।
সর্বোচ্চ স্কোর প্রাপক রুগিদের সবার প্রথমে লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়। তাঁরা যত বেশি অসুস্থ হতে থাকেন, ততই তাঁদের স্কোর বাড়তে থাকে এবং এই ভাবে প্রতিস্থাপনের ব্যাপারে তাঁদের প্রাধান্যও বাড়তে থাকে। এই ভাবে সবচেয়ে অসুস্থ রুগিরই সবার আগে লিভার প্রতিস্থাপন করা হয়। আগে থেকে এটা অনুমান করাটা সম্ভব নয় যে, লিভার পেতে ঠিক কত সময় লাগবে। প্রতীক্ষারতদের তালিকায় আপনার নাম কত নম্বরে আছে তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য আপনি সব সময়েই আপনার প্রতিস্থাপন সমন্বয় রক্ষীকে পাবেন। আপনি নতুন লিভার পাওয়ার অপেক্ষায় থাকার সময় ডাক্তারের সঙ্গে আপনি এই কথা আলোচনা করে নিতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয় যে সার্জারি না-হওয়া অবধি আপনি কী ভাবে নিজেকে শক্ত রাখবেন। নতুন লিভারের যত্ন কী ভাবে নিতে হয় সে সম্পর্কেও আপনি জানার চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারেন।
প্রতিস্থাপনের জন্য লিভার কোথা থেকে আসে?
লিভার প্রতিস্থাপনের দুটি বিকল্প আছে: জীবিত দাতার লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন এবং মৃত দাতার লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন।
যেসব রুগির এন্ড-স্টেজ লিভার রোগ হয়েছে, তাঁদের জন্য জীবিত দাতার লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সুস্থ ও জীবিত দাতার লিভারের একটা অংশ নিয়ে গ্রহীতার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দাতা ও গ্রহীতা, দুজনেরই লিভারের অংশগুলো বেড়ে স্বাভাবিক আকৃতি পেয়ে যায়।
রুগির রক্তের সম্পর্কের ব্যক্তি, স্বামী/স্ত্রী বা বন্ধু লিভার-দাতা হতে পারেন। প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারা ঝুঁকিকে যতটা সম্ভব কম করার জন্য দাতার চিকিৎসা সংক্রান্ত ও মনস্তাত্ত্বিক দিকের গভীর মূল্যায়ন করা হয়। কে উপযুক্ত দাতা হতে পারেন, তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রক্তের প্রকার ও শরীরের আকৃতি। প্রতিস্থাপন সার্জারির আগে জীবিত দাতাদের ও তাঁদের থেকে নেওয়া লিভারকে পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। এইসব টেস্ট করে দেখা হয় যে লিভার যেন সুস্থ থাকে, আপনার রক্তের প্রকারের সঙ্গে যেন মিলে যায় এবং এর আকৃতিও যেন ঠিক থাকে, যাতে আপনার শরীরে এই লিভার খুব ভাল করে কাজ করার সুযোগ পায়।
যে গ্রহীতার শরীররে জীবিত দাতার লিভার প্রতিস্থাপন করা হবে তাঁকে প্রতিস্থাপনের প্রতীক্ষারত তালিকায় সক্রিয় থাকতে হবে। তাঁদের স্বাস্থ্যও যথেষ্ট মজবুত হতে হবে যাতে তাঁদের শরীরে প্রতিস্থাপন সর্বোত্তম সফল ভাবে করা যেতে পারে।
মৃত দাতার লিভার নিয়ে প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে মৃত ব্যক্তি হয়তো দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন, বা তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছিল বা মাথায় চোট পেয়েছিলেন। এই অবস্থায় দাতার হৃদযন্ত্র তখনও সক্রিয় থাকে, কিন্তু তাঁর মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এমন ব্যক্তিকে আইনত মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়, কারণ তাঁর মস্তিষ্ক চিরকালের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং তাঁর মস্তিষ্ককে পুনরায় সক্রিয় করে তোলা যায় না। এই সময়টাতে দাতাকে সাধারণত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়। পুরো লিভারটাই সদ্যমৃত ব্যক্তির থেকে বের করে আনা হয়। এমন ব্যক্তির নিকটতম আত্মীয়ের সম্মতি নিয়ে লিভার নেওয়া হয়। মৃত দাতা এবং তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে থাকা পরিস্থিতিগুলোকে গোপন রাখা হয়।
দাতা ও গ্রহীতা এই দুজনেরই কি কোষকলার প্রকার, লিঙ্গ, বয়স ইত্যাদি মিলতে হবে?
না। লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য শুধুমাত্র দাতা ও গ্রহীতার লিভারের আকৃতি প্রায় একই হতে হবে এবং রক্তের প্রকারও উপযোগী হতে হবে। অন্য কিছু মেলানোর প্রয়োজন নেই।
লিভার প্রতিস্থাপন করা কি সুরক্ষিত?
লিভার প্রতিস্থাপন করাটা সুরক্ষিত। কারণ, লিভারের সংরক্ষণ ক্ষমতা খুব বেশি এবং এর একটা অংশ বের করে আনার পর (2-3 মাসের মধ্যে) এটা পুনর্গঠিত হয়ে নিজের প্রকৃত আকৃতি পেয়ে যায়। দাতার স্বাস্থ্যে এর কোনও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে না, তাঁকে 2-3 সপ্তাহের বেশি ওষুধ খেতে হয় না এবং এক মাসের মধ্যেই তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। তিন মাসের মধ্যে শ্রমসাধ্য কাজ (ভারী জিনিস তোলা ইত্যাদি) করতে পারবেন।
সার্জারির আগে ও পরে কী কী ধরনের বড়সড় ঝুঁকি দেখা দিতে পারে?
সার্জারির আগে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হল এটাই যে লিভারের রোগের কিছু গুরুতর জটিলতা দেখা দিতে পারে, যার ফলে রুগির সার্জারি করাই হয়তো সম্ভব না-হতে পারে। প্রতিস্থাপন করা হলে সার্জারি সংক্রান্ত যে কোনও ধরনের ঝুঁকিই থাকতে পারে। তার উপর আবার অসুস্থ লিভার বাদ দেওয়া এবং দাতার লিভার প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে টেকনিক্যাল সমস্যাও দেখা দিতে পারে। রুগির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হতে পারে এটাই যে কিছু সময়ের জন্য তাঁর লিভার হয়তো কোনও কাজই করবে না। সার্জারির ঠিক পরেই রক্তপাত, প্রতিস্থাপিত লিভারের ঠিকঠাক কাজ না-করা এবং সংক্রমণ ইত্যাদি বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে। রুগির শরীর নতুন লিভারকে প্রত্যাখ্যান করছে কি না তা দেখার জন্য রুগিকে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ভাল করে নজরে রাখতে হবে।
হাসপাতালে কী হয়?
আপনার জন্য কোনও লিভারকে শনাক্ত করার পর আপনাকে সার্জারির জন্য প্রস্তুত করা হবে। আপনি যখন হাসপাতালে এসে পৌঁছবেন তখন আপনার অপারেশনের আগে আপনার অতিরিক্ত কিছু রক্ত পরীক্ষা, ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম ও বুকের এক্স-রে করানো হবে। আপনার লিভার যদি কোনও জীবিত দাতার থেকে নেওয়া হয়, তাহলে আপনাকে ও দাতাকে দুজনকেই একই সঙ্গে সার্জারি করা হবে। আপনি সদ্যমৃত দাতার থেকে লিভার পেয়ে থাকলে সেই লিভার হাসপাতালে এসে পৌঁছনোর পরেই আপনার সার্জারি আরম্ভ হবে।
সার্জারি করতে কত সময় লাগে?
লিভার প্রতিস্থাপন করতে সাধারণত 4 থেকে 14 ঘণ্টা লাগে। অপারেশনের সময় সার্জনরা আপনার লিভারকে বের করে এনে তার জায়গায় দাতার লিভার বসিয়ে দেবেন। আপনার অসুস্থ লিভারকে বের করে আনার আগে সার্জন ওই লিভারকে আপনার পিত্তনালী ও রক্তনালী থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন। লিভার থেকে প্রবাহিত রক্তকে মেশিনের সাহায্যে আটকে দিয়ে আপনার শরীরের বাকি অংশে তাকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সার্জন এরপর সুস্থ লিভারটাকে সঠিক জায়গায় বসিয়ে সেটাকে আপনার পিত্তনালী ও রক্তনালীর সঙ্গে যুক্ত করে দেন। প্রতিস্থাপনের অপারেশনটা খুব বড়সড় একটা চিকিৎসা পদ্ধতি বলে সার্জনরা আপনার শরীরের বিভিন্ন অংশে টিউব লাগিয়ে রাখেন। অপারেশনের সময় এবং তারপরেও আরও কয়েক দিন আপনার শরীর যাতে নির্দিষ্ট কিছু কাজ করে যেতে পারে, তার জন্যই এই টিউবগুলোর প্রয়োজন হয়।
পুরো সুস্থ হয়ে ওঠার সময় কী হয়?
শুরুতে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আপনার লিভার সহ পুরো শরীরের ক্রিয়াকলাপের উপর খুব ভাল করে নজর রাখার কাজটা করা হয়। রুগিকে একবার ওয়ার্ডে পাঠানো হয়ে গেলে ঘন ঘন তাঁর রক্ত পরীক্ষা করানোর মাত্রা কমিয়ে দেওয়া হয়, খাওয়াদাওয়া করতে দেওয়া হয়, পেশিকে ফের মজবুত করে তোলার জন্য ফিজিওথেরাপি করতে দেওয়া হয়। শরীর যাতে নতুন লিভারকে প্রত্যাখ্যান করতে না-পারে, তার জন্য শুরুতে শিরার মাধ্যমে এক বা একাধিক ওষুধ শরীরে ঢোকানো হয়, পরে আস্তে আস্তে ওষুধ খেতে দেওয়া হয়। প্রতিস্থাপনের সময় লিভারের ক্রিয়াকলাপ পর্যবেক্ষণ করার জন্য এবং প্রত্যাখ্যানের কোনও লক্ষণকে শনাক্ত করার জন্য ঘন ঘন নানা টেস্ট করানো হয়।
আমি কবে বাড়ি ফিরতে পারব?
লিভার প্রতিস্থাপনের পর মোটামুটি দুই থেকে তিন সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়। কোনও কোনও রুগিকে আরও আগে ছেড়ে দেওয়া হয়। আবার, নতুন লিভার কেমন কাজ করছে এবং নতুন কোনও সমস্যা দেখা দিতে পারে কি না, এসবের উপর নির্ভর করে কোনও কোনও রুগিকে হাসাপাতালে আরও বেশি দিন রাখা হয়। এই দু ধরনের সম্ভাবনার জন্যই আপনাকে প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হবে। আপনাকে একবার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে রেগুলার নার্সিং ফ্লোরে পাঠিয়ে দেওয়া হলেই আপনাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া সংক্রান্ত ডিসচার্জ ম্যানুয়াল দেওয়া হয়। এতে লেখা থাকে যে বাড়ি ফিরে আপনাকা কী কী নিয়ম মেনে চলতে হবে। হাসপাতালে থাকাকালীনই আপনি আস্তে আস্তে খাওয়াদাওয়া করা শুরু করে দেবেন। প্রথমে আপনাকে স্বচ্ছ তরল খেতে দেওয়া হবে, তারপর আপনার নতুন লিভার কাজ করতে শুরু করলেই আপনাকে গোটা খাবার দেওয়া শুরু হবে।
আপনি জানতে পারবেন যে কী ভাবে আপনি নিজের যত্ন নেবেন এবং আপনার নতুন লিভারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আপনি কী ভাবে নতুন ওষুধপত্র খাবেন। এইসব কাজ নিয়মিত করতে করতে আপনি নিজেরই স্বাস্থ্য পরিচর্যায় একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠবেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার আগে আপনি জানতে পারবেন যে লিভারকে আপনার শরীরকে প্রত্যাখ্যান করার এবং লিভারের সংক্রমণের লক্ষণগুলো কেমন হয় এবং কখন ডাক্তার ডাকা দরকার হবে তা-ও জানতে পারবেন। সুফল পাওয়ার জন্য প্রতিস্থাপনের পর যা যা নিয়ম মেনে চলতে বলা হবে সেগুলোকে ভাল করে মেনে চলার মতো ইচ্ছা রুগির মনে থাকতে হবে।
লিভার প্রতিস্থাপনে কী কী সমস্যা দেখা যায়?
লিভার প্রতিস্থাপন করার পর সবচেয়ে বড় যে দুটো সমস্যা দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো হল শরীরের দ্বারা নতুন লিভারকে প্রত্যাখ্যান এবং লিভারের সংক্রমণ।
লিভারকে প্রত্যাখ্যান করা মানে কি?
একজন ব্যক্তি (দাতা)-র থেকে লিভার নিয়ে অপর ব্যক্তি (গ্রহীতা)-র শরীরে প্রতিস্থাপন করলেই গ্রহীতার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা নতুন প্রত্যঙ্গটাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, ঠিক যেমন এই ক্ষমতা শরীরের বাইরের কোনও উপাদানের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠে সেইরকম। এরপর একের পর এক এমন কিছু ব্যাপার ঘটতে থাকে যে, প্রতিস্থাপিত প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াটাকেই বলে প্রত্যাখ্যান। এটা খুব দ্রুত হতে পারে (তীব্র প্রত্যাখ্যান). বা দীর্ঘ সময় ধরেও হতে পারে (ক্রনিক প্রত্যাখ্যান)।
প্রত্যাখ্যানের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো কী?
প্রতিস্থাপিত লিভারকে প্রত্যাখ্যান করার লক্ষণ ও উপসর্গের তালিকা নীচে দেওয়া হল:
100 ডিগ্রির উপরের জ্বর
অবসান ও অতিরিক্ত ঘুম পাওয়া
খামখেয়ালি ভাব
মাথা ব্যথা
পেট ফোলা, নরম হওয়া বা ব্যথা
অরুচি বেড়ে যাওয়া
জন্ডিস (ত্বক ও চোখ হলদে হয়ে যাওয়া)
ঘন (খয়েরি) রঙের প্রস্রাব
চুলকানি
বমি বমি ভাব
যৌনতা- লিভার প্রতিস্থাপনের পর অধিকাংশ লোকই স্বাভাবিক যৌন জীবনে ফিরে আসতে পারেন। মহিলাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিস্থাপনের পর এক বছরের মধ্যে তাঁরা যেন গর্ভবতী হয়ে না-পড়েন। প্রতিস্থাপনের পর যৌন জীবন ও প্রজননের ব্যাপারে কী করা যেতে পারে সেসব কথা আপনি নিজের প্রতিস্থাপন টিমকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
যে কোনও কিছই নতুন করে শুরু করার আগে আপনার ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে বিশদে সব জেনে নিন।
Discussion about this post